রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ২৮ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৩১

সভ্যতা ও নৈতিকতার সূতিকাগার গৃহ আর সেই গৃহের প্রকৃত শিক্ষকই হচ্ছেন গর্ভধারিণী মা

রিপন কুমার সাহা
সভ্যতা ও নৈতিকতার সূতিকাগার গৃহ আর সেই গৃহের প্রকৃত শিক্ষকই হচ্ছেন গর্ভধারিণী মা

প্রাচীন সভ্যতার সাথে বর্তমান সভ্যতার বৈষম্য হচ্ছে, বর্তমান সভ্যতা আধুনিকতার ছোঁয়ায় আসলেও নৈতিকতা বিবর্জিত। এর কারণ অত্যধিক নারী স্বাধীনতায় পুরুষ মর্যাদাহীন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। প্রাচীনকালে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিলো, তাতে নারীর ক্ষমতায়ন তাদের নিজ নিজ গৃহে প্রাধান্য পেলেও নৈতিকভাবে নারী পুরুষকে মর্যাদাবান মনে করেই তার আদেশ প্রতিপালনে সচেষ্ট ছিলো, যা দেখে সন্তানরা সেই নৈতিক শিক্ষায় নিজেদের পরবর্তী জীবনের জন্যে গড়ে নিতো এবং পরবর্তীতে তাদের সংসার জীবনেও তা প্রয়োগ করতো। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে ‘মা’ই সন্তানের প্রথম শিক্ষক। মায়ের এমন শিক্ষকতার জন্যে কোনো প্রকার একাডেমিক শিক্ষার প্রয়োজন হতো না, কারণ মা তাঁর নিজ পরিবার থেকে সেই নৈতিক শিক্ষাটুকু অর্জন করে নিয়ে আসতেন। ফলে সংসারের মেয়েরা মায়ের আচরণকে এবং ছেলেরা বাবার আচরণকে অনুসরণ করেই পথ চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতো।

গড় আয়ু হিসেব কষলে বলা যায় এখন জীবন শেষ প্রান্তে, যে কোনো সময় যমরাজ তাঁর বার্তা নিয়ে আসতে পারেন পরপারের। জীবনের এ সময়টুকু অতিবাহিত করতে গিয়ে যেটুকু নৈতিক শিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করতে পেরেছি এবং প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি, সেই শিক্ষাটুকু আমার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। বাবাকে ছোটকালে হারানোর পর দীর্ঘ সময় মায়ের সান্নিধ্য লাভের কারণে আমার বোনেরাও তাদের সংসার জীবনে প্রয়োগ করে চলেছেন মায়ের দেয়া নৈতিক শিক্ষাকে।

বাবা যখন মারা যান তখন আমরা ছোট, কিন্তু মা আমাদের বাবার অভাবটা বুঝতে দেননি। আমাদের দুবেলা খাবার জুটাতে নিজে যেমন পরিশ্রম করেছেন, আবার আমাদের পড়ালেখার পাশাপাশি কাজও করিয়েছেন। সেই কষ্টের সময় পাশের বাড়ির ভাল রান্নার গন্ধ আসলে বলতেন, তোমাদের ভাগ্যে যেটা জুটেছে তাতেই খুশি থেকো, আর গোবিন্দকে ধন্যবাদ জানিও জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্যে এইটুকু খাবার তিনি দয়া করে প্রদান করেছেন বলে। বাবা মারা যাবার পর আমাদের আট ভাই-বোনকে ঘরের বাইরে খুব একটা যেতে দিতেন না মা, কারণ তাঁর ভয় ছিলো সন্তানরা যদি যত্রতত্র বিচরণ করে এবং অন্যদের গাল গল্পের সাথে মিশে যায়, তবে নৈতিক শিক্ষা থেকে বিবর্জিত হয়ে পড়বে, তাই রাখতেন কড়া শাসনে। আমাদের এমন ঘরমুখি রেখে বিদ্যা শিক্ষায় ব্রতী রাখার কারণে পাশের ঘরের অনেকেরই কটু কথা বিশেষ করে আমাদের পিশিমনি( ফুফু)-এর শুনতে হয়েছে। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে বুঝতে পারছি আমার মায়ের সেই নৈতিক শিক্ষার মূল্য।

বাবার ব্যবসা হারানোর পর আমাদের অভাবের সংসারে নয়জন ভাই- বোনের দুবেলা খাবার সংস্থানের পাশাপাশি পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হতো। আমার মা মোহনপুর জমিদারের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তার ভাবসাব কখনও তাঁর সংসার জীবনে প্রদর্শন করেননি বা করতে আমরা দেখিনি। মায়ের এমন নৈতিক শিক্ষা আমাদের ঘরের সবার মাঝে প্রতিফলিত হয়েছে--এটা বলতে পারি। মাকে কখনও দেখিনি বাবার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলতে বা কোনো অন্যায় আবদার করতে। আমাদের ঘরের সাথে কাপড়ের দোকান থাকা সত্ত্বেত্ত মা কোনোদিন দোকানে গিয়ে কাপড় কিনেননি বা নিজের পছন্দে কোনো জিনিস কিনেননি। বাবা বাজার থেকে ৪/৫ টা শাড়ি এনে মাকে দেখাতেন বটে। কিন্তু মা বলতেন, তোমার যেটা পছন্দ সেটাই আমার আশীর্বাদ, আর কসমেটিক্স বলতে সেই তিব্বত স্নো আর পাউডার।

পাশের বাড়ির কেউ বা দূরবর্তী কোনো আত্মীয় নিমন্ত্রণ করতে আসলে যদি বাবা বাড়িতে না থাকতেন, তবে বলতেন ‘ওনাকে’ দেখা হলে বলে দেবেন, আর আপনি যে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছেন ‘ওনি’ বাড়িতে ফিরে আসলে জানাবো। এ বিষয়ে মাকে প্রশ্ন করা হলে বলতেন, দেখ তোদের বাবাই হচ্ছে ঘরের গার্জিয়ান (গার্ডিয়ান), ওনার কথা ছাড়া তো আমরা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবো না। ওনাকে বললেই ওনি এসে আমাকে বলবেন, নিমন্ত্রণের কথা, তারপর আমি তোদেরকে নিয়ে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবো। ঠিক মায়ের নৈতিক আচরণের প্রতিফলন আমার প্রয়াত সহধর্মিণী কৃষ্ণা রাণী রায় চৌধুরীর মধ্যে ছিলো। কেউ কোথাও যেতে বললে বলতেন, রামের বাবারে কন বা কেউ মোবাইলে নিমন্ত্রণের কথা বললে মোবাইলে একই কথা বলে কাছে থাকলে মোবাইলটি ধরিয়ে দিতেন আর কোনো জিনিস বা কাপড় পছন্দ করার কথা বললে বলতেন, তোমার পছন্দই তো আমার পছন্দ। অনেক সময় রাগ করে বলতাম, তোমার জন্যে শাড়ি গহনা এনে কী লাভ, পরো না কেন? তখন ছলছল চোখে বলতেন, দেখ না আমার বেনেরা পরে না! তারপর আর বুঝতে বাকি ছিলো না।

আমার মায়ের জীবনের সাথে আমার প্রয়াত সহধর্মিণীর জীবনাচারে যথেষ্ট সাদৃশ্য বিদ্যমান। উভয়েই জমিদার পরিবারের কন্যা এবং একান্নবতী পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। উভয়েই পারিবারিক নৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ ছিলেন। কখনও অকারণে ঘরের বাইরে যেতেন না, গৃহ কর্ম আর সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতেন। রাতে যথা সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে আবার ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রার্থনা সেরে নিতেন। আমার মায়ের কাঁশরের শব্দে যেমন ছোটকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গতো, তেমনি প্রয়াত সহধর্মিণীর কাঁশরের শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গতো। উভয়ের জীবন পর্যালোচনায় দেখেছি, অতি সাজ ও জাঁকজমক পোশাকহীন এবং জৌলুষ পরিহার করে প্রকৃত বাঙালি গৃহিণীর আদর্শ নারী চিত্র এবং পতিভক্তি পরায়নার পাশাপাশি ভক্ত সেবার জন্যে কোনো প্রকার দ্বিধা করতেন না, এক কথায় দেবীশক্তির দৃষ্টান্ত।

উপদেশ প্রদানকালে মা প্রায়ই আমাদের বলতেন, সব সময় মনে রাখবি, যারা পারিবারিক জীবনে ধনী ছিলো এবং মনে প্রাণে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা কখনও ফুটানি করে না এবং যখন-তখন কাউকে না বলে অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয়ে যায় না, অকারণে অপচয় করে না। ভদ্র সমাজের মানুষ বা ভদ্র ঘরে বেড়ে উঠা সন্তান কারো সাথে অকারণে তর্কে জড়ায় না, বড়দের সাথে এবং স্বামীর মুখে মুখে তর্ক বা অশ্রাব্য ভাষা বা তুই- তোকারি করে না। এমন আচরণ সাধারণত ছোটলোকের স্বভাব! আরও বলতেন, মেয়ে খারাপ হয় চাটে ( আড্ডায়) আর বৌ খারাপ হয় ঘাটে এবং ছেলে খারাপ হয় বাজারে। বোনদের সবসময় যেটা বলতেন, ঠিক একই কথা বিবাহের পরদিন বিদায়কালে শ্বশুর বাড়ির লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন, মনে রাখবে আমরা আজ থেকে তোমার কাছে পর, আর যে বাড়িতে যাচ্ছ তারাই আপন। এ বাড়ি থেকে যে সভ্যতা ও নৈতিক শিক্ষা নিয়ে যাচ্ছো, তা-ই তোমার শ্বশুরালয়ে প্রদর্শন করবে, তারা যা বলে তা তোমার বিবেক দ্বারা যাচাই করে করবে, কখনও তর্ক বা ঝগড়া করবে না। মেয়েদের জীবনটা জোয়ার-ভাটার মতোই, যখন যে অবস্থার সম্মুখীন হবে সেই অবস্থাকেই মানিয়ে নিবে নিজের ভাগ্য মনে করে। তোমার আচরণ তাদের কাছে ভাল না হলে তারা তোমার সাথে সাথে আমাকেও গালমন্দ করবে, ঠিক এমন করেই আমার প্রয়াত সহধর্মিণীও বলতেন আমার দুই ছেলেকে নৈতিক শিক্ষা প্রদানকালে। এমন বলার কারণই হচ্ছে বাস্তব জীবনে নিজেকে আদর্শবান করে গড়ে তোলা।

বর্তমান আধুনিক সমাজে প্রযুক্তি ছোঁয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, সোস্যাল মিডিয়ার অন-লাইনের চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে কেনাকাটার ব্যস্ততায় প্রতারিত হবার পাশাপাশি অনৈতিক উপার্জনে মনোনিবেশ, সৎ ও অসৎ পথে রুটি- রুজি বেড়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও বেড়েছে বটে! কিন্তু আদর্শ নারী সত্তা যেমন বাড়েনি, তেমনি হারিয়ে গেছে মায়েদের দেয়া সেই নৈতিক শিক্ষা। ফলে আমাদের বাস্তব এবং সাংসারিক জীবনে নিজ নিজ কর্ম ও আচরণের জন্যে গর্ভধারিণী মাকে গালমন্দের ভাগিদার করা হচ্ছে। এ সমাজকে আবার পূর্বের ধারায় ফিরিয়ে নিতে হলে নারী শক্তিকে যেমনি করে আদর্শবান এবং নৈতিকতাসম্পন্ন হতে হবে, তেমনি করে পুরুষকে হতে হবে চরিত্রবান এবং সৎ গুণাবলিসম্পন্ন। তবেই প্রাচীন কালের ন্যায় প্রতিটি সংসার নিজ নিজ গর্ভধারিণী মায়ের আদর্শে সভ্যতা ও নৈতিক শিক্ষার সূতিকাগার হিসেবে গড়ে উঠবে আর পরিবর্তিত হবে বর্তমান নৈতিকতাহীন সমাজ ব্যবস্থা, রোধ হবে অনাচার ও অসামাজিকতা।

আদর্শবান নারীরা জাগলেই সমাজ জাগবে এবং পাল্টাবে আর সবার মনে রাখতে হবে, নারীর কলুষিত ভাব যেমনি করে কলঙ্কিত পুরুষ সৃষ্টি করে, তেমনিই আবার নারীর দেবীত্ব ভাব সমাজে সুসন্তান আনয়ন করে থাকে।

বি. দ্র. জগতের সকল নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টি যেন হয় নিজ মাতৃস্বরূপ, আর নারী যেন মনেপ্রাণে ভাবেন তিনি দেবীত্বপ্রাপ্ত মা। তবেই সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টাবে।

রিপন কুমার সাহা : সভাপতি, শারদাঞ্জলি ফোরাম, চাঁদপুর।

রচনাকাল-১৬/০৩/২০২৫ খ্রি.।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়