প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ব্যাংকারদের বছর সমাপ্তি : প্রেক্ষিত ২০২৩
শিক্ষক হওয়ার টার্গেটের জীবন ব্যাংকিং পেশায় প্রায় পঁচিশের কাছাকাছি। আলহামদুলিল্লাহ কুল্লিহাল। শিক্ষকদের সাথে দেখা বা কথা হলে তারা বলছেন, ‘দোস্ত-ব্যাংকিংয়ে এসে ভালই করেছো’। অর্থাৎ শিক্ষকতার মহান পেশায় মনে হয় অনেকেই স্বস্তি বা কমফোর্ট ফিল করছেন না। ব্যাংকাররা ভাবছি, ব্যাংকিং এখন একটি টাফ জব হয়ে গেলো কি না! অর্থাৎ কমপ্লেক্স ও কমপ্লিট চ্যালেঞ্জমোড়ানো জবে পরিণত একটি জব এখন ব্যাংকিং। কবির কথাই যেন সঠিক---
'নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সকল সুখ আমার বিশ্বাস'!
একসময় ব্যাংকিং পেশার মূল কাজ ছিলো, জনগণের আমানত যথাযথ ভাবে গচ্ছিত রাখা এবং এ আমানত পেশাদার ব্যবসায়ীদের কাছে বিনিয়োগ করা এবং সময়মত আদায় করা। বর্তমান ডিজিটাল প্লাটফর্মে ব্যাংকিং সেবা দ্রুত গতিতে দৌড়াচ্ছে। সেবার ক্ষেত্র, মাত্রা, গতি, মান এবং প্রতিযোগিতা বহুমাত্রিক হচ্ছে।
আশির দশকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা বেসরকারি মালিকানায় প্রবেশ করেছে। ব্যাংকিংয়ে ইসলামী ব্যাংকিং কনসেপ্ট দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (বর্তমানে পিএলসি) গত প্রায় অর্ধশতাব্দী থেকে আমানত, বিনিয়োগ, আমদানি, রপ্তানি, বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণ, অপারেটিং প্রফিট, ইথিকস ও সুশাসন, স্যোশাল রেসপনসেবলিটি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ক্রীড়া উন্নয়ন, পল্লী উন্নয়নে বাংলাদেশে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রিতে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে। একক ভাবে ইসলামী ব্যাংক দেশ বিদেশে বাংলাদেশকে নতুন মর্যাদায় উন্নীত করছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে দশটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ও অনেক ট্রেডিশনাল ব্যাংক পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা বা উইন্ডো খুলছে। এর গর্বিত পথপ্রদর্শক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
সম্প্রতি দুটো মিডিয়ায় ইসলামী ব্যাংক সহ পাঁচটি ব্যাংকের কয়েকটি নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে গিয়ে এমন ভাবে সংবাদ শিরোনাম করেছে যে, ২৬/১২/২০২৩ তারিখে ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক উচ্চ শিক্ষিত ও জ্ঞানী গ্রাহকগণ দেশ-বিদেশ থেকে প্রশ্ন করছেন, ২৬ ডিসেম্বর ইসলামী ব্যাংকের কী হবে, আমাদের ডিপোজিটের কী হবে? আমরা দৃঢ়তার সাথে বলেছি, আপনার আমার রিজিকের মালিক মহান আল্লাহ। ২৬ ডিসেম্বরও ইসলামী ব্যাংকই বিজয়ী হবে, ইনশাআল্লাহ!
ব্যাংক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ব প্রণোদিত হয়ে এ সংবাদের লিখিত ও মুখপাত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছে। মুখপাত্র মহোদয় বলেছেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রায় ৫২% বৈদেশিক রেমিটেন্স আহরণই নয়, শিল্প-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। সকল সূচকে তারা ভাল করছে। বড় ব্যাংকগুলো বিশাল ব্যবসায় ভলিউমের কারণে সঙ্গতভাবেই নানা সমস্যা বা বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে নিয়মমাফিক সতর্কতামূলক চিঠি দিচ্ছে। এ ভাবে সকল ব্যাংককেই চিঠি দিয়ে তদারকির আওতায় রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পত্রিকা বা মিডিয়াগুলো দুই পা এগিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে গ্রাহক সমাজে ভীতি ও অস্থিরতা তৈরি করছে। এট কাম্য নয়।
বর্তমানে টোটাল ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবলা করে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ মাধ্যমগুলো ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সুশাসন, দুঃশাসন, দুর্বল শাসন নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
দেশ বিদেশের গ্রাহক-শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেকটা অস্বস্তি ও আতঙ্কে থাকছে।
নভেম্বর ২০২২-এর কিছু মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণায় ভয় পেয়ে অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নেন। কিছু কেইস স্টাডি ছিলো এমন--
কয়েকমাস আগে এক মধ্যবয়স্ক গৃহিণী আমার শাখায় বিপুল পরিমাণ টাকা জমা দিতে আসছেন। টাকাগুলো ছয়মাস যাবৎ তার বাসার স্যুটকেসে পড়ে থাকায় প্রায় অর্ধেক অংশ ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে, যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক কাউন্টারে জমা রাখতে পারে না। তিনি যেন তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন।
অন্য একজন গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে এক প্রতিবেশীর পরামর্শে কোনো এক সমবায় সমিতিতে অর্ধ কোটি টাকা লগ্নি করেছেন। বর্তমানে সেই সংস্থার অফিস বন্ধ করে উদ্যোক্তারা গা ঢাকা দিয়েছে। তার পরিবার ও প্রতিবেশীর সম্পর্ক নরককুণ্ডে রূপ নেয়।
একজন মহিলা ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে বাসায় রাখলে সমস্ত টাকা চুরি হয়ে যায়। আর একজন জানালেন, তার মেয়ের জামাই তাকে পটিয়ে ব্যাংক থেকে উঠানো সব সঞ্চয় নিয়ে গেছে এবং টাকা ফেরৎ না দেয়ার অজুহাত হিসেবে মেয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী সকল সরল প্রাণ মহিলার ঘরে স্থায়ী অশান্তি ও চোখভরা নোনা পানির প্রবাহ কোনো বাধাই মানছে না।
এমন বোবাকান্নার অশান্তির উৎসটা এ সংবাদ মাধ্যমগুলোর বাড়াবাড়ির সংবাদ প্রকাশ নয় কি? এর দায়টা কে নেবে?
গ্রাহকগণকে প্রশ্ন করলে জানান, পত্র-পত্রিকা ও স্যোশাল মিডিয়ায় ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন ভিডিও ও খবর দেখে তারা ভয়ে টাকা ব্যাংক থেকে উঠিয়ে এমন দুরবস্থায় পড়েছেন। ভুক্তভোগীদের চোখের পানি এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাসগুলো একজন ব্যাংকার হিসেবে গেলো দু বছর থেকে আমাদের ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দেখে যেতে হচ্ছে।
আগেই উল্লেখ করেছি, ডিসেম্বর ২০২৩-এর মধ্যভাগে সেই মিডিয়া আর একটি ভয়াবহ খবর প্রকাশ করে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি সহ পাঁচটি ব্যাংক ২৬ ডিসেম্বর নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশ বিদেশের সাধারণ গ্রাহকগণ তাদের ঘাম ঝরানো শ্রমের টাকার নিরাপত্তা নিয়ে বাৎসরিক ভিত্তিতেই যেন আতঙ্কে পড়ে যাচ্ছে। যারা বুঝতে অক্ষম একটি ব্যাংক কীভাবে হয় বা কীভাবে বন্ধ হয় বা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে কয়টি ব্যাংকই বন্ধ হয়েছে, তারাই মারাত্মক শক খেয়েছেন। সাত মাসের পোয়াতি স্ত্রীকে শরীয়তপুর থেকে উথাল মেঘনার বুক চিরে ট্রলারে ইসলামী ব্যাংক চাঁদপুর শাখায় পাঠাতে বাধ্য হন প্রবাসে অবস্থানরত স্বামী। আমার কাছে আতঙ্কিত বোনটি অনুনয় করছেন,
স্যার, ‘টাকাটা উঠাই দেন তাড়াতাড়ি। ঘরে নিয়ে মাটির তলে কলসিতে ভরে রাইখা দিমু। আর সয় না। কয়দিন পরপরই পেপারে ইতা লেখে, টেকা না কি যাইব গি’।
এভাবে গত দুই বছরে ইসলামী ব্যাংক কর্মীরা আতঙ্কিত গ্রাহক সেবায় অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
দেশ বিদেশের গ্রাহকগণের প্রশ্ন, বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা যদি কিছুটা দুর্বল হয়ে থাকেও, এর পুরো দায়ভার ইসলামী ব্যাংকের কর্মী ও গ্রাহকদের বহন করতে হবে কেন? সেই মিডিয়াগুলো বলে দিতে পারে, বাংলাদেশের কোন ব্যাংকগুলো ইসলামী ব্যাংক থেকে ভালো আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশ গঠনে কোন ব্যাংকটির অবদান সবচেয়ে বেশি? না হয় মনে করবো, ইসলামী ব্যাংকের সফলতা নিশ্চয়ই তাদের অবিরত কষ্ট দিচ্ছে। তাই পিরিয়ডেক্যালি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিপক্ষে লিখতেই হবে!
কিছু সম্মানিত গ্রাহক বলছেন, যখন মিডিয়াগুলো বিরূপ লিখছে, তখনই ইসলামী ব্যাংক দেশের সর্বোচ্চ কর দাতার পুরস্কার পায়, সেই মাসেই একক ভাবে ৩৭% বৈদেশিক রেমিট্যান্স আহরণ করে। আহা! দেশের জন্যে সোনার ডিমপাড়ারত রাজহাঁসটিকে যদি সকল পক্ষ একটু সুষ্ঠুভাবে লালন করতো, পালন করতো, মহব্বত করতো! তাহলে হয়তো ইসলামী ব্যাংকের মতো আরো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতো।
আলহামদুলিল্লাহ! ইসলামী ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের চেয়ে মাথা উঁচু করেই গত একচল্লিশ বছর ধরে চল্লিশ দিলকুশা ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারসহ সারা বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছে ১৯৮৩ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত। ইনশাআল্লাহ ২০২৪-এর নতুন সূর্যোদয় থেকে কিয়ামত অবধি সুদের অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার মিশন অব্যাহত রাখবে।
মহান আল্লাহর দরবারে একজন নগণ্য ইসলামী ব্যাংক কর্মী হিসেবে কায়মনোবাক্যে এই দোয়া গত পঁচিশ বছর থেকে করে যাচ্ছি, অব্যাহত আছে, থাকবে ইনশাআল্লাহ। কারণ এ ব্যাংক আমার অস্তিত্বের সাথে এক হয়ে আছে। দু কোটি গ্রাহক এতো দিন থেকে মনে করে আসছে, ‘ইসলামী ব্যাংক-আমার ব্যাংক’। অগুণিত গ্রাহক শুভাকাঙ্ক্ষী অবিরত দোয়া করছেন এ প্রতিষ্ঠানটির জন্যে। আল্লাহ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি কে সাবিতকদম রাখুন।
মোঃ নূরুজ্জামান : ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শাখাপ্রধান, আইবিবিপিএলসি, চাঁদপুর শাখা।