প্রকাশ : ২৮ মে ২০২২, ০০:০০
পর্ব-২৬
অভিভাবকের উদাসীনতা সন্তানের যে বিপদ ডেকে আনতে পারে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আমার এ শিক্ষকতা জীবনে হয়েছে। একজন সন্তানের কারণে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যেতে পারে নিমিষেই। আমি অনেক অভিভাবকের অসহায় আর্তনাদ স্বচক্ষে দেখেছি। অনেক অভিভাবকের না বলা কথাগুলো উপলব্ধি করেছি। অনেক অভিভাবককে একথাও বলতে শুনেছি, এমন ছেলে/মেয়ে জন্ম দিয়ে ভুল করেছি। সন্তানের যে সমস্ত অত্যাচার-নির্যাতন অভিভাবকদের সহ্য করতে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :-
১। মাদকাসক্তি ২। মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি ৩। অধিক রাত জাগা ৪। সময়মত ঘরে না ফেরা ৫। মা-বাবাকে ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইলিং করা ৬। অর্থের অপচয় করা।
অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মাঝে এর কোনো না কোনটি আসক্তি রয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের নিয়ে অভিভাবকরা অনেকটা স্বস্তিতে আছে। এগুলোর জন্য অভিভাবকরাও যে কোনো না কোনোভাবে দায়ী নয় সেটা বলা যাবে না। সন্তানের প্রতি অতিমাত্রায় স্নেহ-ভালবাসা সন্তানকে অনেকটা এগুলোর দিকে ঠেলে দেয়। সন্তানরা যখন যা চায় অভিভাবকরা সেটাতে সায় দেয়। একবারও ভাবে না সন্তানের অযৌক্তিক দাবির প্রতি সায় দিলে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
আমার নিজের একটা উদারহরণ দেই। আশির দশকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখান আমার জেঠু বাড়ি থেকে প্রতি মাসে যে টাকা পাঠাতেন তা দিয়ে কোনো রকমে চলে যেত। জেঠুকে একদিন একজন বলেছিলেন, এত অল্প টাকায় চলে কিভাবে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা দিলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে, অন্য পথে খরচ করতে পারে। আমার জেঠুর সেই ভাবনাটায় আমি সেদিন শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম, আজকের বাস্তবতায় সেটা আরো প্রাসঙ্গিক। প্রয়োজন হলে আমি যখনই জেঠুকে বলেছি তিনি টাকা পাঠাতেন। এই যে সন্তানের প্রতি অভিভাবকের কন্ট্রোল এবং নজরদারি তা বর্তমানে একেবারেই তলানিতে এসে ঠেকেছে।
যখনই কোনো শিক্ষার্থী অতিরিক্ত টাকা হাতে পায়, এই বয়সে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিতে থাকে। কখন যে বিপথগামী হবে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারে না বা অভিভাবকও বুঝতে পারে না। নিজের মধ্যে একটা হিরোইজমভাব চলে আসে। পিতাণ্ডমাতার কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়। বর্তমানে যুবসমাজে সবচেয়ে ভয়াবহ যে ব্যাধিটি তা হলো মাদক। হাতে অতিরিক্ত পরিমাণ অর্থ পেলে সন্তান অনেক সময়ে মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখান থেকে ফেরাতে তখন কঠিন হয়ে যায়। একটি পরিবার তখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ঠেকে।
আমাদের কলেজেরই একজন ছাত্রের কথা বলি। তার বাবা বিদেশ থাকে। প্রতিমাসে ছেলের অঢেল টাকা দিতো। সন্তানের প্রতি মা তার কোনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। কলেজে আসা ছেড়ে দেয়। নির্বাচনী পরীক্ষায় ফেল করার কারণে ফরম পূরণ করতে পারছে না। বাবা বিদেশে থেকে এ কথা শুনে দেশে চলে আসে। আমার কাছে এসে বিষয়টি জিজ্ঞেস করেন। আমি বললাম, আপনার ছেলেতো একবছর পর্যন্ত কলেজেই আসে না। হাজিরা খাতা দেখালাম। একটি পরীক্ষাও দেয়নি, সেটাও দেখালাম। অভিভাবক বিশ্বাসই করতে চাইলেন না। এতটা পুত্র স্নেহে তিনি অন্ধ হয়েছিলেন যে, একটি সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিলেন। তিনি আমাকে যা জানালেন তাতে আমি বিস্মিত হলাম। প্রতি মাসে ছেলেক বিশাল অংকের টাকা পাঠাতেন শিক্ষকের টিউশন ফি’র জন্য। অথচ ছেলে কোনো শিক্ষকের কাছে পড়তো না। এছাড়া প্রতিমাসে নানা অজুহাতে বাবার কাছ থেকে টাকা আনতো, যা বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে অপচয় করতো। বিষয়টি বোঝার পর তিনি দস্তুরমত হতভম্ব। তাকে অনেকটা সান্ত¡না দিলাম। বোঝানোর চেষ্টা করলাম আপনার প্রশ্রয় এবং স্নেহের সুযোগে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে। আমি সেই অভিভাবককে দু-চারটি কথা জিজ্ঞেসা করলাম, তিনি তার উত্তর দিতে পারেননি।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বিদেশ থাকেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ছেলে-মেয়েদের জন্যে। আমি তাকে বললাম, বিদেশে থেকে নিশ্চয়ই লেবারের কাজ করেন। অনেক কষ্ট করে টাকা উপার্জন করেন। সেই টাকা পাঠান আর আপনার সন্তান আপনার কষ্টের মূল্যায়ন না করে আনন্দ ফূর্তি করে কাটিয়েছে। যাদের জন্যে আপনার এত কষ্ট তারাই যদি মানুষ না হয় তবে আপনার এত কষ্ট করার দরকার কি? তিনি শুধু চুপ করে রইলেন। পরে জানলাম তিনি বিদেশ ছেড়ে চলে এসেছেন। আমার আরেকটি অবজারবেশন হলো, যে সমস্ত বাবা বিদেশ থাকে তাদের অধিকাংশ সন্তানই এমন সঙ্কটে পড়ে।
ইমোশনার ব্ল্যাক মেইলিং করে মা-বাবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন আদায় করা আরেকটি বিষয়। অধিকাংশ কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের হাতে এখন স্মার্টফোন রয়েছে। তাদের এ সমস্ত ফোন ব্যবহৃত হয় গেম খেলা, ছবি তোলার কাজে। যা ব্যবহৃত হওয়া উচিত ছিল যোগাযোগ এবং পড়ালেখার কাজে। তারা ফোনটির সদ্ব্যবহার না করে অপব্যবহার করে থাকে। সন্তানের হাতে দামী ফোন তুলে দেয়াটা যে কতটা বিপজ্জনক তা একবারও অভিভাবকরা বুঝতে চায় না। এছাড়া ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সের ছেলেদের কৌতূহলটা বেশি থাকে। ইন্টারনেটের সুবিধার কারণে তারা নানা রকম সাইটে বিচরণ করে, যার ফলে অনেক সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ে অভিভাবকের অজান্তেই।
রাত জাগা এই জেনারেশনের আরেকটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো ছাত্রের পড়ালেখা শুরু হয় গভীর রাতে। আমাদের সময়ে আমরা সন্ধ্যার সময়েই পড়তে বসতাম। পড়ালেখা শেষ করে রাত ১২টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তাম। পরদিন ভোরে উঠে পড়তে হবে। এখন সে ধারা পাল্টেছে। ছাত্রদের পড়ালেখা শুরু হয় রাত ১২টার পর। যে সময়ে অভিভাবকরা থাকে ঘুমে। দরজা আটকিয়ে সে কি পড়ছে না অন্য কিছু করছে তা ক’জন অভিভাবক খবর রাখেন? এই সমস্ত ছাত্র ঘুম থেকে উঠে বেলা ১০টার পর। আমি অনেক ছাত্রকে দেখেছি চোখে ঘুম নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে ক্লাসে হাজির হতে। এখানেও অভিভাবকের দায়িত্বহীনতা এবং উদাসীনতার পরিচয় পাওয়া যায়।
সত্তর আশির দশকে আমরা যখন ছাত্র ছিলাম এই চাঁদপুর শহরে সন্ধ্যার পর কোনো ছাত্রকে শহরে দেখা যেতো না। রাস্তার পাশ দিয়ে গেলে পাশের বাসা থেকে পড়ার শব্দ শোনা যেত। চাঁদপুর শহরের কালীবাড়ির মোড় ছিল আভিজাত এলাকা। শহরের গুণীজন যারা ছিলেন তারা শ্রদ্ধেয় মুনির ভাইয়ের বইয়ের দোকানে এবং ওয়ান মিনিটে এসে বসতেন। কোনো ছাত্র এ সমস্ত যায়গায় যেতে সাহস করতো না গুণীজনকে সম্মান দেখিয়ে। কিন্তু আজ সেগুলো সব উবে গেছে। সেই সময়ে ওয়ান মিনিট ছিল চাঁদপুরের এলিট পার্সনদের বসার জায়গা। দোকানটিরও একটি আভিজাত্য ছিলো। এখন আর গুণীজনরা সেখানে তেমন একটা বসেন না। তবে দোকানের স্বত্বাধিকারী সেই আভিজাত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।
এই চাঁদপুর শহরেই দেখবেন রাত ১০টা পর্যন্ত ছাত্ররা রাস্তা-ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দিকে কিছু অভিভাবকের উদাসীনতা রয়েছে। অভিভাবকের কাছে প্রশ্রয় পেয়েই তারা তাদের লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করে ফেলেছে। বয়স্কদের সাথে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধটাও এখন আর নেই। এই যে জেনারেশন গ্যাপগুলো হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে ভাবছেন কি? (চলবে)