রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০

ফরিদগঞ্জে পুলিশের এই সাফল্য মনে রাখার মতো!
অনলাইন ডেস্ক

একসময় যেটা হতো, নিজের বাড়ি-ঘরের ঠিকানা বলতে না পারা শিশুরা অচেনা অজানা পরিবেশে সাধারণত নিখোঁজ হতো। ঘুরতে বা বেড়াতে গিয়ে বাবা-মা/বড় ভাই-বোন কিংবা অন্য কারো হাত থেকে, সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ জনস্রোতে হারিয়ে যেতো, কেউ ট্রেন/লঞ্চ/স্টিমারের মতো বড় যানবাহন থেকে ছিটকে পড়ে বাঁচলেও হারিয়ে যেতো। শিশুদের হারিয়ে যাওয়া কিংবা নিখোঁজ হবার বহুবিধ কারণ ছিলো বা আছে। কিন্তু ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম/গণমাধ্যমের কল্যাণে বর্তমান ডিজিটাল যুগে শিশুরা এখন অবলা হলেও হারায় না বা নিখোঁজ হয় না। তবে পরিবারের ভেতরে-বাইরে নানা নির্যাতন/নিগ্রহ, হুমকি-ধমকি, কড়া অনুশাসন, পড়ার চাপ সহ আরো কিছু কারণে শিশুরা স্বেচ্ছায়/অনিচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে নিখোঁজ হয়। এছাড়া অপহরণ, পাচার সহ কিছু দুর্বৃত্তপনার শিকার হয়েও শিশুরা নিখোঁজ হয়। এমন বাস্তবতার আলোকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে এক নিরীহ দিনমজুরের ফুটফুটে চেহারার ছেলেশিশু নিখোঁজ হলো সম্প্রতি। এর পেছনে কারো হাত থাকার কোনো সহজবোধ্য কারণ সন্দেহজনকভাবেও কারো মনে দানা বাঁধেনি। অবশেষে পুলিশ শিশুটির লাশ উদ্ধারের পর নিবিড় তদন্তে তার নিখোঁজ হবার রহস্য বের করতো সক্ষম হলো প্রধানত আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। একটি মোবাইল ফোনকলের সূত্র ধরে ফরিদগঞ্জ থানার পুলিশ দুর্ধর্ষ সিরিয়াল কিলার রসু খাঁকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছিল, শিশু সোহানের খুনিকেও প্রায় সেভাবেই খুঁজে পেয়েছে। তাই এটি মনে রাখার মতো একটি সাফল্য। যেটি নিছক ফরিদগঞ্জ থানার সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি, বিবেচিত হয়েছে পুরো চাঁদপুর জেলা পুলিশের সাফল্য হিসেবে। আর সে কারণে এই সাফল্যকে জেলা সদরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন জেলা পুলিশের কর্ণধার পুলিশ সুপার স্বয়ং।

প্রেস ব্রিফিং ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ মে মাগরিবের নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে শিশু আদিল মোহাম্মদ সোহান নিখোঁজ হয়। পরদিন তার বাবা আনোয়ার হোসেন থানায় এ সংক্রান্ত একটা জিডি করেন। নিখোঁজের ৪দিন পর গত ১৯ মে শুক্রবার সকালে বাড়ির পাশের একটি জমি থেকে মাটিচাপা অবস্থায় সোহানের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ব্যাপারে ওইদিনই সোহানের পিতা আনোয়ার হোসেন ফরিদগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ঘটনার তদন্তের এক পর্যায়ে সোহানের গৃহশিক্ষক ও এসএসসি পরীক্ষার্থী আঃ আহাদকে সন্দেহজনক হিসেবে আটক করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আঃ আহাদ (১৮) হত্যার কথা স্বীকার করে। সে জানায়, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল সিআইডি দেখে সে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল দেখে এ অপরাধটি করার চিন্তা করে। ঘটনার দিন ১৫মে মাগরিব নামাজের পর সোহান বাড়ি ফেরার সময় সে বাড়ির পাশের একটি পুকুরের সামনে বসে মোবাইল ফোন দেখছিলো। এ সময় সোহানকে তার গৃহশিক্ষক আহাদ কৌশলে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী নার্সারীতে নিয়ে মুখ ও গলা চেপে ধরলে সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সোহান অজ্ঞান হয়েছে মনে করে সেখান থেকে উঠে গিয়ে আহাদ তার নিজের মায়ের মুঠোফোনের মধ্যে নতুন সীমকার্ড সংযুক্ত করে। পরে সে মুঠোফোন দিয়ে সোহানের মা ফাতেমা বেগমের মুঠোফোনে মুক্তিপণ আদায়ের জন্যে কল করে। কিন্তু সোহানের মা কল রিসিভ না করায় সে ফিরে গিয়ে সোহানের নিস্তেজ দেহ দেখে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়। পরে তার মরদেহ নার্সারীতে ফেলে রাখে। এরপর সে নিজেও সোহানের পরিবারের অন্য সদস্যের মতো সোহানকে খুঁজতে বের হয়। রাত গভীর হলে আহাদ তার চাচীর রান্না ঘর থেকে হাত দা নিয়ে বাড়ির পাশের একটি জমিতে গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেয় সোহানকে। পরবর্তীতে সে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয় এবং পুকুরের মধ্যে নতুন সীমকার্ডটি ফেলে দেয়।

পুলিশ জানায়, আঃ আহাদ হত্যার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয়ার পর তার দেয়া তথ্য মতে তাকে সাথে নিয়ে হত্যার সময় ব্যবহৃত জামা-কাপড় ও হাত দা উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে শিশু সোহান নিখোঁজ হওয়ার পর এবং পরবর্তীতে লাশ উদ্ধারের পর থেকে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামে পুলিশ। পুলিশ সুপার মোঃ মিলন মাহমুদের দিক নির্দেশনায় এবং সার্বক্ষণিক তদারকিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) পলাশ কান্তি নাথের নেতৃত্বে ফরিদগঞ্জ থানার ওসি আঃ মান্নান, ওসি (তদন্ত) প্রদীপ মণ্ডল, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জামাল হোসেন, এসআই রুবেল ফরাজী, এএসআই আবু নঈম টানা ৫ দিন এই মামলার রহস্য ভেদ করতে দিন-রাত পরিশ্রম করেন। অবশেষে তারা সফলতার মুখ দেখেন। এ ব্যাপারে ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আঃ মান্নান জানান, চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) পলাশ কান্তি নাথের নেতৃত্বে আমরা থানার পুলিশ ৫দিনের পরিশ্রমে ক্লুলেস এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছি।

আমরা শিশু সোহান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যে অবশ্যই ফরিদগঞ্জ থানার সাফল্যকে স্মরণকালের সেরা সাফল্যের একটি হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই। এজন্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই অভিনন্দন এবং শোকাহত ও বিচারপ্রার্থী প্রতিটি মানুষের পক্ষ থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। আমরা মনে করি, এ সাফল্যে আছে অভিভাবকদের জন্যে অনেক কঠোর বার্তা। আহাদের মতো মেধাবী কিশোর ছাত্রের হাতে মোবাইল ফোন যে কোনোভাবে চলে আসলে সেটা যে কতো বড়ো আসক্তি ও অঘটনের জন্ম দিতে পারে, আট বছর বয়সী শিশু সোহানের মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। একটি মোবাইল ফোন এলাকায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত একজন কিশোরকে কতোটা অপরিণামদর্শিতা, বিপথগামিতায় আচ্ছন্ন করে প্রেম ও বাল্যবিয়ে এবং অতঃপর নিজের শিশুছাত্র অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের প্রয়াস ও খুনের নেশায় মত্ত করতে পারে, সেটার জন্যে কিশোর খুনি আহাদই হতে পারে নিকৃষ্ট উদাহরণ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়