প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৩, ০০:০০

চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি মসজিদের ইমাম প্রায় এক দশক ইমামতি করে ঈদ জামাতের আয়সহ মসজিদের সামগ্রিক আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতার প্রমাণ দিতে না পেরে অসম্মানজনকভাবে বিদায় নেন। অথচ তিনি চাঁদপুর শহরের মসজিদসমূহের ইমামদের মধ্যে তার সমকালে ছিলেন ভীষণ প্রভাবশালী, নেতৃস্থানীয় এবং উচ্চকণ্ঠ। তার বিদায়ের পর কমবয়সী এক ইমামকে নিয়োগ দেয়া হলো। তিনি মুসল্লিদের নিকট থেকে দান-অনুদান সংগ্রহ করে মসজিদ ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণসহ সামগ্রিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন। এতে তিনি মুসল্লিদের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যান এবং মুসুল্লিদের প্রদত্ত অর্থে ওমরাহ হজ্ব করার সুযোগ পান। কিছুদিন পর দেখা গেলো, তিনি মোটরসাইকেলের পেছনে এক নারীকে নিয়ে প্রায়শই ঘুরতে বের হন। এতে কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু মুসল্লিরা জানতে পারেন, এই নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী, যাকে তিনি প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া বিয়ে করেছেন, যে বিয়ের প্রমাণ হিসেবে মসজিদ কমিটিকে তিনি কাবিন তথা বিয়ে রেজিস্ট্রির কাগজ দেখাতে সক্ষম হননি। অনৈতিকতা ও ব্যভিচারের অভিযোগে তিনি মুসল্লিপ্রিয়তার আকাশ থেকে যেনো ধপাস করে মাটিতে পড়ে যান এবং অসম্মানজনকভাবে ইমামতির চাকুরি হারান। এভাবে বিভিন্ন মসজিদে ইমামগণ ব্যক্তিগত অস্বচ্ছতা ও অনৈতিকতা ছাড়াও কমিটির লোকজনের রোষানলে পড়ে কোনো ধরনের দোষ ছাড়াই চাকুরি হারান। আবার কোনো কোনো ইমাম মসজিদ কমিটির লোকজনকে তোষামোদি করে সুস্পষ্ট অপরাধ সত্ত্বেও চাকুরি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, যদিও সজাগ-সচেতন মুসল্লির কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয় না। এমন বাস্তবতায় যখন জানা যায়, কোনো মসজিদে এক ইমাম ৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে ইমামতি করে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেছেন, তখন বিস্ময়ে চোখ তো কপালে তুলতেই হয়।
এমন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী এক ইমাম সম্পর্কে আমরা জানতে পারি গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে। সংবাদটির শিরোনাম দেয়া হয়েছে '৫১ বছর ইমামতির পর সম্মানজনক বিদায়'। সংবাদটি লিখেছেন চাঁদপুর কণ্ঠের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মোঃ আবদুর রহমান গাজী। সংবাদটির বিবরণ হচ্ছে : হাজীগঞ্জ উপজেলার ১০নং গন্ধর্ব্যপুর ইউনিয়নের পশ্চিম দেশগাঁও জামে মসজিদে ৫১ বছর ইমামের দায়িত্ব পালনের পর বিদায় সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। ১২ মে ২০২৩ শুক্রবার বাদ জুমা এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদের ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, আমার বয়স হয়ে গেছে। আর আমি মানুরী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা থেকেও অবসর নিয়েছি। এখন আর পারছি না। আমার মসজিদ কমিটি আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছেন। একই মসজিদে ৫১ বছর খেদমত করেছি। এই এলাকার মানুষ আমার পরিবারের সদস্যদের মতো। দীর্ঘ ৫১ বছর ধরে এখানকার মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছি। বিদায়কালে উনারা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে ইমাম বানিয়ে সম্মানিত করেছেন। পরিশেষেও সম্মানিত করেছেন। আমি আয়োজকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ওই গ্রামের মোঃ শাহাদাত হোসেন জানান, আমার জানামতে দেশগাঁও ইউনিয়নে এই প্রথম সংবর্ধনার মাধ্যমে কোনো ইমামকে বিদায় দেয়ার পাশাপাশি প্রশংসা কুড়িয়েছেন মসজিদ পরিচালনা কমিটি। মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান হুজুর ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুয়াটোবা গ্রামের মজুমদার বাড়ির সন্তান। আমি যতটুকু দেখিছি, তিনি একজন রাসূল প্রেমিক। তিনি ১৯৭৩ সালে এই মসজিদে ইমাম হিসেবে যোগদান করেন। এরপর দীর্ঘ ৫১ বছর এই মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন বয়সের কারণে আর পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি অবসরে গেছেন।
শুধু ইমাম কেনো, যে কোনো পেশাজীবী যদি তার কর্মস্থলে সুনামের সাথে দায়িত্বপালন করে সম্মানজনকভাবে এলাকাবাসী/সেবাগ্রহীতাদের স্বতঃস্ফূর্তায় ও সহকর্মীদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় বিদায় নিতে পারেন, তাহলে সেটি তার জন্যে যথার্থ মূল্যায়নের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এমনটি খুব কম লোকেরই ভাগ্যে জোটে। কিছু অসৎ ও ক্ষমতাধর পেশাজীবী যখন টের পায় যে, তার বদলি কিংবা অবসরগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত বিদায় সংবর্ধনা জুটবে না, তখন তারা বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে কৃত্রিম উপায়ে বা জোর খাটিয়ে বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করে। সমাজের এমন বাস্তব চিত্রের আলোকে আমরা হাজীগঞ্জের ১০নং গন্ধর্ব্যপুর ইউনিয়নের পশ্চিম দেশগাঁও জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানকে যাঁরা সসম্মানে লাগাতার ৫১ বছর ইমামতির সুযোগ দিয়েছেন এবং স্বেচ্ছায় তাঁর অবসরগ্রহণের প্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্ত বিদায় সংবর্ধনা প্রদান করেছেন, তাদেরকে সপ্রশংস অভিব্যক্তিতে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এরা এমন সম্মান প্রদর্শনের প্রতিদান ইহকাল ও পরকালে লাভ করুক--মহান স্রষ্টা আল্লাহর দরবারে সে প্রার্থনা জানাচ্ছি।