প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৩, ০০:০০
বেগম রহিমা ওয়াদুদ : সার্থকতার অনন্য উদাহরণ

ঊননব্বই বছরের সার্থক জীবন শেষে জগতের অমোঘ নিয়মে পরপারের যাত্রী হয়েছেন বর্ণাঢ্য এক জীবনের নাবিক বেগম রহিমা ওয়াদুদ। আইনজীবী পিতা আব্দুল হাকিম সাহেবের ঘরে চাঁদের কণা হয়ে জন্মগ্রহণ করা রহিমা বেগম ছাব্বিশ বছর বয়সে ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদের জীবনসঙ্গিনীরূপে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেন। নিজের নামের সাথে স্বামীর প্রেমময় নামের অংশ জড়িয়ে নিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বেগম রহিমা ওয়াদুদ। সমাজ চাইলে সহজেই একজন রহিমা ওয়াদুদ তৈরি করতে পারে না। তার জন্যে দরকার অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা। চাঁদপুরের বিখ্যাত ও ইতিহাসঋদ্ধ মাতৃপীঠ স্কুলে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে শিক্ষকতা করে তিনি সমাজে বিলিয়ে গেছেন অকৃত্রিম জ্ঞানের আলো। তাঁর জ্ঞানের আলোকবর্তিকায় অন্ধকারময় সমাজে দিশাহীন বালিকারা সেদিন খুঁজে পেয়েছিল নিজেদের জীবনের পথ।
|আরো খবর
নিয়তি তাঁকে যে মানুষের সাথে বেঁধে দিয়েছিল গ্রন্থি, তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য মানুষ। বঙ্গবন্ধুর সাথে ভাষার জন্যে রাজপথে নির্যাতিত হওয়া এই মানুষটিই দৈনিক ইত্তেফাকের কর্মাধ্যক্ষরূপে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলার ঘরে ঘরে, সংবাদ প্রচারের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। চাঁদপুর সদরের রামপুর ইউনিয়নের রাঢ়ীরচর গ্রামের পাটোয়ারী বাড়ির সন্তান এমএ ওয়াদুদ পাটোয়ারী হয়ে ওঠেন তাঁর যোগ্য জীবনসঙ্গী। কালের পরিক্রমায় এই আলোকবর্তিকাবাহী শিক্ষিকাই হয়ে ওঠেন একজন রত্নগর্ভা মা। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ডাঃ জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ টিপু ডায়বেটিক ফুট সার্জন হিসেবে দেশজুড়ে খ্যাতিমান। তাঁরই রত্নকন্যা ডাঃ দীপু মনি এমপি বাবার দেখানো পথে রাজনীতিতে নেমে হয়েছেন দেশের প্রথম নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে দেশের প্রথম নারী শিক্ষামন্ত্রীরূপে দক্ষতার সাথে পালন করে চলেছেন তাঁর উপরে অর্পিত দায়িত্ব। একদা যাঁর হাতে জ্ঞানের আলো পেয়ে মানুষ হয়েছে এ সমাজের মেয়েরা, আজ তাঁর মেয়েই নিজগুণে হয়ে গেছেন জানা-অজানা অসংখ্য বাঙালি মেয়ের জীবনের ধ্রুবতারা।
পুত্র-কন্যার প্রতি এমএ ওয়াদুদ সাহেব কখনো অতিরিক্ত স্নেহ-বাৎসল্য দেখাতে গেলেই বেগম রহিমা ওয়াদুদ একজন আদর্শ মা হয়ে তার রাশ টেনে ধরেছেন। নিজেও কখনো অতি আদিখ্যেতায় পুত্র-কন্যাকে ভাসিয়ে দেননি। তারই সুফল আজ সময়ের কাছে আমরা হাতে হাতে পেয়েছি। যে সময়ে বেগম রহিমা ওয়াদুদরা নিজেদের তৈরি করে তুলছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে, সে সময়টা ছিল উত্তাল। বাঙালির জন্যে সে সময়টা ছিল আঁধারকে জয় করার যুদ্ধ। একদিকে ছিলো ইংরেজ ও পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল আর অন্যদিকে ছিল সামাজিক কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊষর সময়। লক্ষ্যে স্থির থেকে আইনজীবী পিতার মনোবলে বলীয়ান হয়ে বেগম রহিমা ওয়াদুদ কেবল নিজেই শিক্ষিত হননি, বরং শিক্ষিত করে তুলেছেন হাজার হাজার বাঙালি কিশোরীকে, যারা আজ নিজেরাই আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন সমাজের জন্যে।
একজন রহিমা বেগমের কাছে সমাজের অনেক কিছুই শেখার আছে। একজন সংগ্রামী রাজনীতিবিদকে কীভাবে যোগ্য সাহচর্য দিতে হয় তা তাঁকে দেখে কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। নারী জাগরণ ও প্রগতিশীলতা নিয়ে বেগম রোকেয়া-উত্তর যে ধারা তাঁরা বহন করে জাতিকে দিয়ে গেছেন, জাতি আজ তা সঠিকভাবে লালনে সক্ষম নয় বলেই প্রতীয়মান। নচেৎ আজকের সমাজেও ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বাড়াবাড়ি থাকতো না। ‘ভাষাবীর এমএ ওয়াদুদ স্মারক গ্রন্থ’ হতে বেগম রহিমা ওয়াদুদের লেখা স্মৃতিচারণমূলক গদ্য ‘আপনকথা’ হতে আমরা তাঁর জীবন-সন্তুষ্টি বিষয়ে অবহিত হই। তিনি একদিকে যেমন এম এ ওয়াদুদের মতো সহযোগিতার মনোভাবসম্পন্ন জীবনসঙ্গী পেয়ে কৃতজ্ঞ, তেমনি তিনি তাঁর রত্ন-সন্তানদ্বয়ের কারণেও আপ্লুত। ঊনিশশো ছাপ্পান্ন হতে ঊনিশশো তেষট্টি সাল পর্যন্ত মাতৃপীঠ স্কুলে শিক্ষকতার জীবনে তিনি ছড়িয়ে গেছেন প্রগতির দ্যুতি।
একজন রহিমা ওয়াদুদ সমাজের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রের গৌরবের হেতু। তাঁর মতো মানুষের মৃত্যু সমাজের জন্যে যেমন অপূরণীয় ক্ষতি তেমনি আপনজনের কাছে উপশমহীন বেদনার উৎস। তবুও জাগতিক নিয়মে মানুষকে সংসারের সাজানো বাগান ছেড়ে মহাকালের পথে পাড়ি জমাতেই হয়। তাঁর দৈহিক মৃত্যু হলেও কর্ম ও জীবনের মৃত্যু নেই। বর্তমান ও অনাগতকালের নারীদের কাছে বেগম রহিমা ওয়াদুদ হয়ে থাকবেন সার্থকতার অকৃত্রিম উদাহরণ। মহান আল্লাহ্ তাঁকে পরকালে উপযুক্ত পুরস্কারে ভূষিত করুন।