প্রকাশ : ০৫ মে ২০২৩, ০০:০০

সরকারি চাকুরি যারা করেন, তারা ৫৯ বছর কিংবা তদূর্ধ্ব সময় পর অবসর গ্রহণ করে গ্র্যাচ্যুয়িটি ও পেনশনের টাকায় আমৃত্যু মোটামুটি ভালোভাবে চলতে পারেন। বেসরকারি চাকুরি যারা করেন, তাদের অনেকেই নির্দিষ্ট সময় পর অবসর নিয়ে এককালীন কিছু পেয়ে ও স্বীয় সঞ্চয়ের অর্থে ভালোভাবে জীবন কাটানোর চেষ্টা করেন। পাশাপাশি সন্তানদের আয়-রোজগারও চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভূমিকা রাখে। যারা ব্যবসা করেন কিংবা স্বাধীন পেশার সাথে জড়িত, তারাও অসুস্থতা কিংবা অনিবার্য কারণে স্বেচ্ছায়/ অনিচ্ছায় অবসর জীবনে চলে আসেন। এমন অবসর জীবন সবার কপালে জোটে না। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কিনা জানি না, কারো কারো জীবনে অবসর গ্রহণের সুযোগই দেন না। এদেরই একজন শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইন। গতকাল তাঁকে নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ প্রতিবেদন। যার শিরোনাম 'বাঁশের তৈরি পণ্য বিক্রি করেই চলে শতবর্ষী বৃদ্ধ যদুলাল বাইনের সংসার'।
প্রতিবেদক তাপস চন্দ্র সরকার তার প্রতিবেদনে লিখেছেন, বাঁশ আর বেতকেই জীবিকার প্রধান বাহন হিসেবে ধরে রেখেছে মতলব উত্তর উপজেলাধীন ১৬নং সুলতানাবাদ ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি পরিবার। এদেরই একজন ১১৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ যদুলাল বাইন। তাঁর তিন ছেলে মনিন্দ্র চন্দ্র সরকার, বাবুল চন্দ্র সরকার ও প্রিয়লাল চন্দ্র সরকার এবং একমাত্র মেয়ে মণি রাণী সরকার। এর মধ্যে গেলো বছরের ২৫ ডিসেম্বর জন্ডিস ও লিভার কান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তার ছোট ছেলে, সুজাতপুর বাজারের টেইলর প্রিয়লাল সরকার (৪৫)। আর ৪/৫ বছর আগে মারা যান তাঁর সহধর্মিণী। প্রিয়তমা স্ত্রী আর আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে শতবর্ষী যদুলাল বাইন আজ অসহায়। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ বয়সেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর বাড়ি সুলতানাবাদ ইউনিয়নস্থিত কোয়রকান্দি গ্রামে। তাঁর নাতি অমল চন্দ্র সরকার বলেন, অতীতে গ্রামে গঞ্জে বাঁশের তৈরি সামগ্রীর কদর ছিল অনেক। এসব পণ্য শোভা পেতো প্রত্যেক বাড়িতে। গৃহস্থালির নিত্য ব্যবহারের দ্রব্যাদি ডালা, চালুন, ডুলি, খরপা, চাটাইসহ অসংখ্য জিনিস আজও তৈরি করে ক্রেতাদের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তবে ইদানীং প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন তা হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে এ ব্যবসায় মন্দাভাব থাকায় বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোর চলছে দুর্দিন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে বাঁশের পণ্য তৈরি ও তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন যদুলাল বাইনের মতো গ্রামের প্রায় অর্ধশত পরিবার। তিনি আরো বলেন, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা পেলে বাঁশ শিল্পের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। স্থানীয় ইউপি মেম্বার আবদুল হক মৃধা বলেন, বাঁশের তৈরি পণ্য বাঙালির পুরোনো ঐতিহ্য। পুরোনো এই ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু পূর্ব পুরুষের এই পেশাকে এখনো ধরে রেখেছে কোয়রকান্দি গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার। বাঁশের সামগ্রী তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঁশমালীরা। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় নানা রকমের বাঁশের পণ্য। পূর্ব পুরুষদের এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে তারা এখনো নিরলস।
আমরা এ সম্পাদকীয় নিবন্ধে শতবর্ষী যদুলাল বাইনকে নিয়ে লিখার উদ্দেশ্যই হলো, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। তিনি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বৃদ্ধ ভাতা পাচ্ছেন কি পাচ্ছেন না, তাঁর প্রতি কেউ দয়ার্দ্র হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বা দিবেন কিনা এ ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। স্ত্রী ও সন্তানকে হারানোর পরও তিনি শোক সংবরণ করে নিজেকে শতাব্দী-উত্তীর্ণ বয়সেও কর্মক্ষম রাখতে পেরেছেন--এটা নিঃসন্দেহে বিরল ঘটনা। হাতের যে কোনো কাজ জানা থাকলে এবং সুস্থ থাকলে মানুষ দীর্ঘজীবন লাভ করেও যে কাজ করে খেতে পারে, পরনির্ভরশীলতা এড়াতে পারে, মতলব উত্তরের শতবর্ষী যদুলাল বাইন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর প্রতি আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা। তাঁর জীবনযুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ যদি কোনো জাদুঘরে ঠাঁই পায়, তাহলে সেটি অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে উজ্জীবনী মন্ত্র। কথা হলো, এতোটা ঔদার্য কার আছে?