প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৭
শবে বরাত বা নিসফ শা’বানের ডাক

আল্লাহ আ’আলা তাঁর বান্দানের জন্য যে মাসগুলোতে বিশেষ কল্যাণ ও বারাকাহ রেখেছেন সেগুলোর অন্যতম মাহে শাবান। এটি একটি মুবারক মাস। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ মাসে বেশি বেশি নফল রোজা পালন করতেন। শাবান মাসের সিয়ামই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এ মাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এ মাসে রাব্বুল আলামিনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালোবাসি যে, আমার রোজা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।’ (সুনান আন নাসাঈ) এজন্য প্রত্যেক মু’মিনের উচিত এ মাসে বেশি বেশি নফল রোজা রাখা, বিশেষ করে চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে আইয়্যামে বিদের নফল রোজা রাখা।
এ মাসে একটি বিশেষ রাত রয়েছে, যা অনেক কল্যাণ ও বরকতময়। আল্লাহ তা’আলা এ রাতে তাঁর সৃষ্টিরাজির প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ১৪ শাবান দিবাগত রাত; আমাদের দেশে যা ‘শবে বরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ হিসেবে পরিচিত। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, আর রবাত অর্থ ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাত শব্দের অর্থ ভাগ্য রজনি বা রাত। হাদিসে এবং সাহাবি-তাবিয়ীদের যুগে ‘লাইলাতুল বারাআত’ পরিভাষাটি ছিল না। হাদিসে এ রাতটিকে ‘নিসফি শাবান’ বা ‘মধ্য শাবানের রাত’ বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত (বিশেষ রহমতের) করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন। (সুনান ইবন মাজাহ)
প্রায় ৮ জন সাহাবির সূত্রে বিভিন্ন সনদে এ হাদিসটি বর্ণিত। শবে বরাত বিষয়ে এটিই একমাত্র সকল মুহাদ্দিসগণের বর্ণনায় সহিহ হাদিস। এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাতটি ফযিলতময় এবং এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। আর ক্ষমা লাভের শর্ত হলো শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হওয়া। এ দু’টি বিষয় থেকে যে ব্যক্তি মুক্ত হতে পারবেন তিনি কোনরূপ অতিরিক্ত আমল ছাড়াই এ রাতের বরকত ও ক্ষমা লাভ করবেন। আর যদি এ দু’টি বিষয় থেকে মুক্ত হতে না পারি, তবে কোন আমলেই কোন কাজ হবে না। কারণ ক্ষমার শর্ত পূরণ হলো না। দুঃখজনক হলো, আমরা শবে বরাত উপলক্ষ্যে অনেক কিছুই করি, তবে সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত এ দু’টি শর্ত পূরণের চেষ্টা খুব কম মানুষই করি।
শবে বরাতে ক্ষমা লাভের শর্ত বা শবে বরাতের ডাক :
১. শিরক মুক্ত জীবনযাপন
২. হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত জীবনযাপন
শবে বরাতে আল্লাহর সাধারণ ক্ষমা পেতে হলে আমাদেরকে শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত জীবনযাপন করতে হবে, অন্যথায় আল্লাহর দেওয়া সাধারণ ক্ষমার আওতায় আসবো না। নিম্নে এ দু’টি ভয়ংকর ও কঠিনতম পাপের পরিচয় তুলে ধরা হলো-
শবে বরাতের প্রথম ডাক : শিরক মুক্ত জীবনযাপন
র্শিক অর্থ অংশীদার হওয়া, অংশীদার করা বা সহযোগী বানানো। কোরআনের ভাষায় র্শিক হলো কাউকে আল্লাহর সমতূল্য, সমকক্ষ বা তুলনীয় মনে করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’ (আল বাকারা-২২)
আল্লাহর কোন ক্ষমতায়, গুণে বা ইবাদতে অন্য কাউকে অংশীদার করাই র্শিক। বিশ্ব সৃষ্টি, পরিচালনা, জীবনদান, মৃত্যুদান, বৃষ্টিদান, অলৌকিক সাহায্য, কল্যাণ, অকল্যাণ ইত্যাদি সকল ক্ষমতা আল্লাহর। অন্য কারো এরূপ কোন ক্ষমতা বা অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করা র্শিক। অনুরূপভাবে আল্লাহর মহান গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, অদৃশ্য জ্ঞানের মালিক। অন্য কারো এরূপ গুণ আছে বলে মনে করা র্শিক। অনুরূপভাবে সাজদা, দোয়া, মানত, জবাই, তাওয়াক্কুল, ভরসা, নির্ভরতা, অলৌকিক ভয়, আশা ইত্যাদি সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য। অন্য কারো জন্য এগুলো করা অর্থ এগুলোতে তাকে আল্লাহর অংশীদার বানানো।
শিরকের ভয়াবহ পরিণতি :
শিরক মূলোৎপাটনের জন্য কোরআন ও সুন্নাহে বিশেষভাবে বারংবার এর ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআন ও হাদীস থেকে আমরা এ বিষয়ে যা জানতে পারি তার অন্যতম :
১. ভয়ঙ্করতম পাপ
শিরক সবচেয়ে কঠিন ও ভয়ঙ্করতম পাপ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘বল, এস, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ করেছেন তা তোমাদেরকে পড়ে শুনাই : তা এই যে, তোমরা তাঁর কোন শরীক করবে না.....। (সূরা আল আনআম-১৫১)
হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ হলো আল্লাহর সাথে র্শিক করা, মানুষ হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা এবং মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (সহীহ আল বুখারী)
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তাছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।’ (সূরা আন নিসা-৪৮)
মহান আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তাছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। এবং যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে সে ভীষণভাবে পথভ্র’হয়।’ (সূরা আন নিসা-১১৬)
২. শিরক সকল নেক কর্ম ধ্বংস করে অন্য সকল পাপের সাথে শিরক মৌলিক পার্থক্য এই যে, সাধারণভাবে পাপের কারণে পুণ্য বিন’হয় না। কিন্তু শিরকের কারণে অতীতের সকল নেক কর্ম বিন’হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী করা হয়েছে যে, তুমি আল্লাহর শরীক স্থির করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্থ।’ (সূরা যুমার-৬৫)
মহান আল্লাহ বলেন, ‘কেউ ঈমানের সাথে কুফরী করলে তার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে।’ (সূরা মায়িদা-৫)
মহান আল্লাহ ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব, নূহ, দাঊদ, সুলাইমান, আইঊব, ইউসুফ, মূসা, হারূন, যাকারিয়্যা, ইয়াহইয়া, ঈসা, ইলইয়াস, ইসমাঈল, ইলইয়াসা, ইউনুস, লূত (আলাইহিমুস সালাম) ও তাঁদের বংশের নেককার মানুষদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এ হলো আল্লাহর হেদায়াত, স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি এদ্বারা সৎপথে পরিচালিত করেন। তারা যদি শিরক করত তবে তারা যা কর্ম করত সবই বিন’ও নিষ্ফল হয়ে যেতো।” (সূরা আল আনআম-৮৮)
৩. শিরক জাহান্নামের অনন্ত শাস্তির কারণ
শিরকে লিপ্তদের জন্য মহান আল্লাহ জান্নাত হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কেউ আল্লাহর শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করবেন ও তার আবাস জাহান্নাম; জালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।’ (সূরা মায়িদা-৭২)
আবু যার (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক না করে পৃথিবী পরিমাণ পাপ-সহ আমার সাথে সাক্ষাত করবে আমি সমপরিমাণ ক্ষমা-সহ তার সাথে সাক্ষাত করবো।’ (সহীহ মুসলিম)
আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জাহান্নামে সবচেয়ে কম শাস্তি ভোগ করবে যে ব্যক্তি তাকে মহান আল্লাহ বলবেন, পৃথিবীর সবকিছুর মালিকানা তুমি যদি পেতে তবে কি জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য সবকিছু ফিদইয়া হিসাবে দান করে দিতে? লোকটি বলবে: হ্যাঁ। মহান আল্লাহ বলবেন, আমি তো তোমার কাছে এর চেয়ে সহজ একটি বিষয় চেয়েছিলাম; তুমি যখন আদমের পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করছিলে তখন আমি তোমার কাছে চেয়েছিলাম যে তুমি আমার সাথে শিরক করবে না। কিন্তু তুমি শিরক পরিত্যাগ করলে না।’ (সহীহ বুখারী)
শবে বরাতের দ্বিতীয় ডাক: হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত জীবনযাপন
হিংসা বিদ্বেষ ভয়ঙ্কর ও মহাপাপ। মহাপাপ হওয়া ছাড়াও এ পাপের দু’টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, তা অন্যান্য নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, আগুন যেমন খড়কুটো ও খড়ি পুড়িয়ে ফেলে, হিংসাও তেমনি মানুষের নেক আমল পুড়িয়ে ফেলে। এ পাপের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহ তা’আলার সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হওয়া। অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষদের আমল প্রতি সপ্তাহে দু’বার পেশ করা হয়: প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার। তখন সকল মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করা হয়, কেবলমাত্র যে বান্দার সাথে তার ভাইয়ের বিদ্বেষ-শত্রুতা আছে সে ব্যক্তি বাদে। বলে দেওয়া হয়, এরা যতক্ষণ না ফিরে আসে ততক্ষণ এদেরকে বাদ দাও।’ (সহীহ মুসলিম)
সংঘাতময় জীবনে মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে রাগ, লোভ, ভয়, হিংসা ইত্যাদি আসবেই। এসে যাওয়াটা অপরাধ নয়, বরং পুষে রাখাটাই অপরাধ।
হিংসা বিদ্বেষের ভয়ঙ্করতম রূপ ধর্মীয় মতভেদগত বিদ্বেষ। খুটিনাটি মতভেদ নিয়ে শত্রুতা করা এবং মতভেদকে দলভেদ বানিয়ে দেওয়া ইহুদি-খৃস্টান ও অন্যান্য জাতির ধ্বংসের অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) অনেক হাদিসে এ বিষয়ে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির ব্যাধি তোমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে: হিংসা ও বিদ্বেষ; এই বিদ্বেষ মুন্ডন করে দেয়। আমি বলি না যে তা চুল মুন্ডন করে, বরং তা দ্বীন মুন্ডন ও ধ্বংস করে দেয়। আমার প্রাণ যাঁর হাতে তাঁর শপথ করে বলছি, মু’মিন না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর একে অপরকে ভালো না বাসলে তোমরা মু’মিন হতে পারবে না। এ ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম আমি শিখিয়ে দিচ্ছি, সর্বত্র ও সর্বদা পরস্পরের সালাম প্রদানের রেওয়াজ প্রচলিত রাখবে। (তিরমিযি)
অনেক ক্ষেত্রে হিংসা-বিদ্বেষ দীনদার মানুষদের প্রিয়তম ও মজাদার পাপ। যে দীনদার মানুষ কোনভাবেই গানবাজনা শুনতে বা সিনেমা দেখতে রাজি নন, সে মানুষটিই খুটিনাটি ধর্মীয় মতভেদ নিয়ে অন্য মুসলিমের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করেন। অথচ গান বাজনার চেয়েও ভয়ঙ্করতম পাপ বিদ্বেষ। কারণ গান বাজনার কারণে পাপ হলেও অন্য নেক আমল নাহওয়া বা আল্লাহর সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা বর্ণিত হয়নি। আর বিদ্বেষের বিষয়ে অতিরিক্ত এ দু’টি শাস্তিই রয়েছে।
শয়তান সকল আদম সন্তানকেই জাহান্নামে নিতে চায়। কুফরি, মদ, ব্যভিচার ইত্যাদি মহাপাপ তার অস্ত্র। তবে যে সকল দীনদার মানুষ পাপ থেকে আত্মরক্ষা করতে তাদেরকে জাহান্নামে নেয়ার জন্য শয়তানের অন্যতম অস্ত্র তিনটি: শিরক, বিদ’আত ও হিংসা-বিদ্বেষ। এ পাপগুলিকে শয়তান ‘ধর্মের’ লেবাস পরিয়ে দেয়, ফলে দীনদার মানুষ না বুঝেই তার খপ্পরে পড়েন।
তেমনিভাবে হিংসা- বিদ্বেষমুক্ত জীবনযাপন করা জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত। রাসূল (সা.) পরপর তিনদিন এক সাহাবাকে জান্নাতি বলে ঘোষণা দিলেন, যিনি কোন মুসলমানদের প্রতি অন্তরে কোন বিদ্বেষ পোষণ করতেন না এবং আল্লাহ তা’আলা কাউকে কোন নি’আমত দান করলে সেজন্য তিনি কোন হিংসা করতেন না।
এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বেটা, যদি সম্ভব হয় তাহলে এভাবে জীবন যাপন করবে যে, সকালে সন্ধ্যায় (কখনো) তোমার অন্তরে কারো জন্য কোনো ধোঁকা বা অমঙ্গল কামনা থাকবে না। অতঃপর তিনি বলেন, বেটা, এটা আমার সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর যে আমার সুন্নাতকে (পালন ও প্রচারের মাধ্যমে) জীবিত করবে সে আমাকেই ভালোবাসবে। আর যে আমাকে ভালোবাসবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’ (তিরমিযি)
উপরের সহিহ হাদিস থেকে আমরা জেনেছি যে, হৃদয়কে শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত করাই শবে বরাতের মূল কাজ। এ রাত্রিতে অন্য কোন আমল করতে হবে কিনা সে বিষয়ে কোনো সহিহ হাদিস পাওয়া যায় না। তবে আমল করার মতো কয়েকটি যয়িফ হাদিস থেকে তিনটি আমল জানা যায় :
১. কবর যিয়ারত করা
২. দু’আ করা এবং
৩. নফল সালাত আদায় করা।
ইমাম তিরমিযী ও ইবনু মাজাহ আয়েশা (রা.) এর সূত্রে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যাতে বলা হয়েছে যে, রাসুলূল্লাহ (সা.) রাতের গভীরে কাউকে না বলে একাকী বাকী গোরস্তানে যেয়ে মুর্দাদের জন্য দু’আ করেছেন। তিরমিযী উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর উস্তাদ ইমাম বুখারী হাদিসটিকে যয়িফ বলেছেন। (তিরমিযি)
ইমাম ইবনু মাজাহ আলী (রা.) এর সূত্রে একটি হাদিস সংকলন করেছেন, যাতে বলা হয়েছে, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাতে (সালাত-দোয়ায়) দন্ডায়মান থাকো এবং দিবসে সিয়াম পালন করো। কারণ ঐদিন সূর্যাস্তের পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। কোন রিয্ক অনুসন্ধানকারী আছে কি? আমি তাকে রিয্ক প্রদান করবো। কোন দুর্দশাগ্রস্থ ব্যক্তি আছে কি? আমি তাকে মুক্ত করবো। এভাবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। (ইবনু মাজাহ)
তবে কবর যিয়ারত, দু’আ করা এবং নফল সালাত আদায় সহ সকল নফল ইবাদত একান্ত ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তি আল্লাহর সন্তু’িলাভের জন্য একান্ত নিরবে একাকি তা আদায় করবেন।
শবে বরাত উপলক্ষে নিষিদ্ধ ও হারাম ও বর্জনীয় কাজ :
আমাদের সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে অনেক হারাম ও নিষিদ্ধ কর্ম রয়েছে, যার কোন নজির বা দৃষ্টান্ত শরিয়তে পাওয়া যায় না। এগুলো পালনকরা বা এ ধরনের কাজে একজন মু’মিন সন্তুষ্ট থাকা ইমান হারানোর শামিল। যেমন- এ রাত উপলক্ষে :
১. আতশবাজি ফুটানো
২. বাড়ি-ঘর মসজিদ আলোকসজ্জা করা
৩. হালুয়া-রুটি বিতরণ করা ইত্যাদি।
এ সব কিছুই আমাদের ধর্ম বিশ্বাস ও কৃষ্টি-কালচার বিরোধী। পৌত্তলিক ও অগ্নিপূজারীদের ‘বারাকোমা’ এবং হিন্দুদের ‘দিলওয়ালি পূজার’ অবিকল অনুকরণ। যা একেবারেই না জায়েজ ও হারাম। তাই একজন মুসলিম সর্বান্তকরণে এ ধরণের নিষিদ্ধ ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবেন।
আসুন আমরা সবাই আল্লাহর দরবারে এভাবে বারবার প্রার্থনা করে নিজেদের অন্তরগুলোকে সকল হিংসা, বিদ্বেষ ও অহংবোধ থেকে পবিত্র করি। আসুন আমরা শবে বরাত উপলক্ষ্যে সকল প্রকার শিরক, হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে তাওবা করি ও হৃদয়গুলিকে মুক্ত করি। জাগতিক কারণে বা ধর্মীয় মতভেদের কারণে যাদের প্রতি শত্রুভাব বা বিদ্বেষ ছিল তাদের জন্য দু’আ করি। তাহলে আমাদের কয়েকটি লাভ হবে। প্রথমত, কঠিন পাপ থেকে তাওবা হলো। দ্বিতীয়ত, শবে বরাতের সাধারণ ক্ষমা লাভের সুযোগ হলো। তৃতীয়ত, বিভিন্ন সহিহ হাদিস থেকে আমরা জানি যে, হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হৃদয় লালন করা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অন্যতম সুন্নাত। যার মনে হিংসা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল কামনা নেই তিনি অল্প আমলেই জান্নাত লাভ করবেন এবং জান্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাহচার্য লাভ করবেন।
লেখক : নূর মোহাম্মদ, সহকারী অধ্যাপক, বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।