প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১১
আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটিভেশনাল বক্তব্য দিলেন ড. ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর ২০২৪) সন্ধ্যা ৭টায় আল আজহার কনফারেন্সে পৌঁছালে মিশরে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা তাঁকে দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন।
প্রধান উপদেষ্টা ইংরেজি ভাষায় ৪০ মিনিটের মোটিভেশনাল বক্তব্যে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণ টেলিফোনের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, জব তথা চাকরি কোনো সুন্দর সমাধান নয়, এটি কখনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না, বরং ব্যবসাই চমৎকার সিদ্ধান্ত।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সালামা দাউদ, উপ-উপাচার্য ড. মাহমুদ সিদ্দিক, দুদেশের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মিস সামিনা নাজ ও মিশরে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের এক বিশাল অংশ।
ড. ইউনূস আল আজহারের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা এবং ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে থাকার আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, আল আজহারের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আসা আমার জন্যে বিশাল সম্মানের। আমি এর আগে মিশরে এসে দূর থেকে আল আজহারকে দেখেছি। আজ এখানে এসে কথা বলার সুযোগ পাওয়া আমার জীবনের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ড. ইউনূস আল আজহারের বিশাল শিক্ষার্থী বহর এবং এর বিশ্বব্যাপী ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, "আপনারা যারা এখানে অধ্যয়ন করেছেন, তাদের জন্যে এটি একটি বিরল সুযোগ। এখানকার শিক্ষা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করবে এবং আপনাদের মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে অবদান রাখতে সাহায্য করবে।
তিনি তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার বাবা আমাদের বলতেন যে, আল আজহার শুধুমাত্র প্রাচ্যের একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি বিশ্বময় জ্ঞানচর্চার একটি বিশ্বস্ত কেন্দ্র। অতীতকাল থেকেই আমাদের অঞ্চল থেকে শত শত শিক্ষার্থী এই প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান অর্জনের জন্যে এসেছেন।
তিনি আরও বলেন, আল আজহার ইসলামের মূল শিক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি আলোকবর্তিকা, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি, সহনশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তির এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যে নয়, সমগ্র মানবতার জন্যে প্রাসঙ্গিক।
ড. ইউনূস আল আজহারকে একটি মেলবন্ধন হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এটি বিভিন্ন ইসলামী মতাদর্শের মিলনস্থল। এখানে হানাফি, মালিকি, শাফি এবং হাম্বলি মতবাদসহ ইসলামে স্বীকৃত বিভিন্ন ধারার চিন্তাধারা সমানভাবে সমাদৃত। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে মূল্যবোধ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল, আল আজহার এখনও তা ধারণ করে আছে।
তিনি আরও বলেন, আল আজহার শুধু ধর্মীয় জ্ঞানচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিজ্ঞান এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে অনুসন্ধিৎসার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে।
বাংলাদেশে আল আজহারের প্রভাব উল্লেখ করে ড. ইউনূস করে বলেন, আল আজহারের প্রভাব বাংলাদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী। এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাজুয়েট বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশে সুফিবাদের প্রসার ঘটিয়েছেন, যা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আজও আল আজহারের পণ্ডিতদের মতামত আমাদের দেশে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচিত হয় এবং এটি আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের আওতায় কীভাবে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আপন দেশে টেকসই মানবিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা যায় তা উল্লেখ করে বলেন, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুধুমাত্র বড়ো বিনিয়োগকারীদের জন্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং নতুন সমাধানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্যে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও মানুষকে সাহায্য করার এ মহান দায়িত্ব তরুণদেরই বহন করতে হবে।
ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ইসলামের মূল্যবোধ ও নীতির আলোকে এই পৃথিবীতে আমাদের একটি নতুন অবস্থান গ্রহণের সময় এসেছে। বিশ্ববাসীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে সম্প্রীতি বজায় রেখে আমাদের আবারও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমি আশা করি, আল আজহার আমাদের সমাজে সেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবে। এই প্রতিষ্ঠানের জ্ঞান বিজ্ঞান, নৈতিকতার এবং আধ্যাত্মিকতার সর্বজনীন বার্তা শুধু বিশ্বব্যাপী মুসলমানদেরই নয়, বরং সমগ্র মানবতাকেই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসংগঠিত সভ্যতা গ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি, যখন মানব প্রচেষ্টা অবশ্যই ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণমূলক একটি ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক ব্যবস্থার সন্ধানের দিকে নিবদ্ধ হতে হবে। এই ব্যবস্থা মানবিক সহানুভূতির চেতনা সর্বাগ্রে রাখবে, যেখানে প্রতিশোধ, অবিচার এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে কোনো স্থান থাকবে না।
ড. ইউনূস ইসলামী বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, আমাদের শিক্ষাবিদ এবং গবেষকদেরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা এবং বিশ্বজুড়ে জ্ঞানচর্চার সাথে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা অপরিহার্য। আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ এবং টেকসই বিশ্ব গড়তে একসাথে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানশেষে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মিশরে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের ছাত্র সংগঠন ইত্তেহাদ-এর পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রধান করা হয়।
এর আগে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি পৌঁছালে তাঁকে স্বাগত জানান আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. সালামা দাউদ।