প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:৪৯
তরুণদের উপর আস্থা রাখুন
হাজারখানেক তরুণের তাজা রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারী সর্বগ্রাসী কবল থেকে মুক্ত হলো সমগ্র বাংলাদেশ। জনগণের মাঝে চেপে থাকা রাগ,ক্ষোভ ও অবৈধভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ স্বৈরাচারীর ভীত নড়বড়ে করে তুলেছিল। তরুণ শিক্ষার্থী নেতৃত্বে থাকা এই আন্দোলনে জনসাধারণ সর্বাত্মক সমর্থন জুগিয়েছেন। তরুণের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ সাধারণ জনমনে বিপুল সাড়া ফেলে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশব্যাপী। তরুণ যে নিঃস্বার্থ কাজ করতে পারে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কাউকে আঙ্গুলি প্রদর্শন করে দেখিয়ে দিতে হয় না। এই তরুণরা মানে না কোন বাঁধা, মৃত্যুশংঙ্কা উপেক্ষা করে পরিবর্তনের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে রাজি । এ যেন সুকান্তের “আঠারো বছর বয়স” কবিতার বাস্তব চিত্রায়ণ- ”এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য, বাষ্পের বেগে ষ্টীমারের মতো চলে, প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য, সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।”
|আরো খবর
তরুণ নেতৃত্বে দেশকে পুনর্গঠন করার সময় এসেছে। তরুণ দেখিয়ে দিয়েছে তারাও পারে সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটাতে। কোন সংকীর্ণ চিন্তা, হীন রাজনৈতিক স্বার্থ, ফ্যাসিস্টদের চোখ রাঙানো তরুণরা কর্ণপাত করে না। নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জাতীয় অখন্ডতা, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রশ্নে এরা দ্বিধাহীন।
বিগত দশকগুলোতে এই বিপুল তারুণ্যের অন্ত্যঃস্থ শক্তিকে অস্বীকার করা হয়েছে। সামাজিকভাবে বিভিন্ন বয়ান তৈরির মাধ্যমে তরুণদের অযোগ্য ও অসমর্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল । দেশে তরুণদের বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিতর্কিত ইস্যু তৈরি করে তাদের ব্যস্ত রাখা হতো। পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট হায়েনাদের লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। তরুণদের সম্পর্কে বলা হতো, এই তরুণরা বয়স্কদের সম্মান বা মান্য করে না, নিয়মকানুন মানে না। কিন্তু তারাই আজ সমাজে অপরকে কীভাবে সম্মান করতে হয় এবং কীভাবে নিয়ম কানুন মানতে হয় তা দেখাচ্ছে।
শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কোন সমাজের মাপকাঠি হতে পারে না। বিগত দশকে আমরা দেখেছি অর্থনৈতিক প্রকল্পের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোটপাট করা, শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে পরিণত করা, চাকুরি বাজারে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা সহ বিবিধ বিষয় যা বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে।
এখন যদি প্রশ্ন করা হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কোন অংশ? এক কথার উত্তর দেয়া যায় তরুণরা। যারা অপার সম্ভবনাময় থাকা সত্ত্বেও তাদের কাজে লাগাতে দেয়া হয়নি।অর্থনৈতিক মহাপরিকল্পনার নামে যে বৈদেশিক ঋণ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তার দায়ভার কে নিবে? চাকুরির নামে শত শত তরুণের সাথে উচ্চ মাত্রার ঠাট্টা-মশকরা করা হয়েছে। তার জবাব কে দিবে?
শত শত প্রবঞ্চনার মাঝে এই তরুণরা নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল। তারা হন্যে হয়ে একটি চাকুরি খুঁজে । অন্তত যেন পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। বছরের পর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাহাত্ম্য প্রকাশ করলেও চাকুরির নিশ্চয়তা বিধান করা হয়নি। ক্ষুণ্ণ করা হয়েছিল মৌলিক চাহিদা ও সাংবিধানিক অধিকার। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডান্ড এর অপার সম্ভবনা কাজে লাগানোয় ব্যস্ত ছিল। সেখানে আমাদের তরুণদের শ্রম শক্তির যথাযথ ব্যবহারের পথকে করে রাখা হয়েছিল রুদ্ধ। এটা অস্বীকার করার জো নেই যে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক স্বক্ষমতা অনুযায়ী এত চাকুরি সৃষ্টি সত্যিই অসাধ্য। যেখানে সমাধান হতে পারতো তাঁদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলা। সেখানেই বিশেষত সরকারি চাকুরিকে লোভনীয় করে তোলা হয়েছে। যারপরনায় তরুণ প্রজন্মের ভিশন সরকারি চাকুরির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা অর্জন করা। সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়?
বিগত দশক ধরে জমে থাকা তরুণের রাগ, ক্ষোভ ও বঞ্চনার প্রকাশ পায় কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যেখানে শত শত তরুণ নিজের বুকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। আর যুক্ত হন সাধারণ জনতা। আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী দেশ ছেড়ে পালায়। দেশে দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পা-চাটা আমলাতন্ত্র, ঘুনে ধরা সমাজব্যবস্থা ও সর্বব্যাপী বৈষম্য রেখে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশ ও জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে । যুক্ত করা হয় এই আন্দোলনের দুই সমন্বয়কদের, যা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রাপ্তি। তরুণরা আন্দোলন করে ফ্যাসীদের পতন ঘঁটানোর মধ্য দিয়ে এই আন্দোলন শেষ করে দেয় নি। তারা সারা দেশে বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-দেশের ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনা সহ আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা, সনাতন ধর্মালম্বীদের মন্দির পাহারা দেয়া, চাঁদাবাজি বন্ধে দেশের বিভিন্ন স্পটে তাদের অবস্থান সক্রিয় করে তুলা, চাঁদাবাজদের গণধোলাই দিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া।
তরুণরা বাংলাদেশের প্রাণ ভোমরা। দল মত নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেক শ্রেণি পেশার মানুষের আন্তঃসম্পর্ক মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। বিভিন্নভাবে দেশে বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই ব্যাপারে তরুণদের পাশাপাশি সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। জনগণের উচিত এই তরুণদের মনস্তত্ত্ব বোঝা। তাদের কাজের সুযোগ করে দেয়া। তরুণরা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানে যুগের বিবেচনায় প্রচলিত শাসন পদ্ধতি সেকেলে। ধ্রুপদী চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে তরুণদের নেতৃত্বে দেশ গঠন করতে পারলে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকবে। এই প্রত্যাশা করা অনুচিত হবে না, তরুণের হাতে দেশ নিরাপদ। তরুণের দেশ-মাতৃকার নিমিত্তে এই ভাবনা দেশের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে।
তরুণদের এই সম্ভাবনাময় শক্তি অগ্রাহ্য করার জো নেই। তাদের রাজনৈতিক উত্থানে সবার নিরঙ্কুশ সমর্থন দেয়া উচিত। এই শক্তি দেশের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, যারা এই দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে চায়। তারা এমন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যেখানে থাকবে না কোন অন্যায়-অসমতা, বৈষম্য। তরুণের এই উদ্দেশ্য সফল করতে দরকার ছাত্র-জনতার সেতুবন্ধন।
লেখক : মো. রবিউল হাসান, বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা [email protected]