বুধবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:৩১

রতন টাটা : তরুণ প্রজন্মের প্রেরণা

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
রতন টাটা : তরুণ প্রজন্মের প্রেরণা

বিশ্বনন্দিত ভারতীয় শিল্পপতি রতন টাটার মৃত্যুতে ভারতসহ বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বুধবার (৯ অক্টোবর) গভীর রাতে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং এজন্য নিয়মিত চেকআপ থাকাকালে হাসপাতালে মারা যান। ১৯৩৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বম্বেতে জন্মগ্রহণ করেন রতন টাটা। নেভাল টাটা এবং সুনি টাটার সন্তান তিনি। জামসেটজি টাটার ছোট ছেলে রতনজি টাটা নেভাল টাটাকে তাঁর ছেলে হিসেবে দত্তক নেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই মা-বাবার বিচ্ছেদ নিজের চোখেই দেখেছিলেন রতন টাটা। তাঁর দাদি, নভজবাই টাটা তাঁকে এবং তাঁর সৎ ভাই নোয়েল টাটাকে বড় করে তোলেন। রতন টাটা বম্বের ক্যাম্পিয়ান স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এরপর বম্বের ক্যাথেড্রাল এবং জন কনন স্কুল এবং সিমলার বিশপ কটন স্কুলে পড়াশোনা করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর ১৯৫৫ সালে তিনি নিউইয়র্ক সিটির রিভারডেল কান্ট্রি স্কুল থেকে স্নাতক করেন। পরে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে তিনি স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলেও কিছুকাল তিনি লেখাপড়া করেন। ১৯৬২ সালে নিজেদের কোম্পানির খনি শ্রমিক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। ভীষণ কঠিন কাজ হলেও মা-বাবার ব্যবসা সম্পর্কে আরও বেশি করে জানতে এ কাজটাই তাঁকে সাহায্য করেছিল। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদ চেয়ারম্যান হতে সাহায্য করেছে। যদিও কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে ১৯৯১ সালে তিনি চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সেসব প্রতিরোধকে জয় করেই তিনি হয়েছিলেন রতন টাটা।

টাটা গ্রুপ তাঁর উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক সাফল্যের সুবাদে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত। রতন টাটার তত্ত্বাবধানে টাটা গ্রুপ ৪০% বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে এবং লভ্যাংশ পেয়েছে ৫০ শতাংশ। এ লভ্যাংশ থেকে ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে রতন টাটা ৬৫ শতাংশ সম্পদ জনহিতকর কাজে দান করেন। আলঝেইমার রোগের কারণ খুঁজে বের করার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের সেন্টার ফর নিউরোসায়েন্সকে ৭৫০ মিলিয়ন টাকা দিয়েছে টাটা ট্রাস্ট। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল যেখান থেকে রতন টাটা অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম করেছিলেন সেই স্কুলকে ২০১০ সালে টাটা গ্রুপ ৫০ মিলিয়ন টাকা দিয়েছে এক্সিকিউটিভ সেন্টার প্রতিষ্ঠার জন্য। ২০১৪ সালে টাটা গ্রুপ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিকে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য টেকনোলজি পণ্য উদ্ভাবন এবং গবেষণা করার জন্য ৯৫ কোটি রুপি প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় অনুদান। নিজের জনহিতৈষী কাজের জন্য বহু পুরস্কার পেয়েছেন রতন টাটা। ২০০০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ পান তিনি। ২০০৭ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স তাঁকে অনারারি ফেলোশিপ প্রদান করে। ২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ লাভ করেন রতন টাটা। ২০০৯ সালে ইতালি সরকার তাঁকে ইতালীয় প্রজাতন্ত্রের অর্ডার অব মেরিটের ‘গ্র্যান্ড অফিসার’ উপাধি প্রদান করে। ২০১০ সালে বিজনেস ফর পিস ফাউন্ডেশনের ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়। এসবের বাইরেও তিনি দুবার ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মভূষণ লাভ করেছেন। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রির পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪০টি পুরস্কার পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজনেস ফর পিস এবং এশিয়ান বিজনেস অ্যাওয়ার্ডও রয়েছে। স্থাপত্যশিল্পে বিশ্বের অন্যতম সম্মানজন পুরস্কার ‘প্রিজকার আর্কিটেকচারাল প্রাইজ’ এর একজন জুরিও তিনি। বিশ্বের ৮ নম্বর অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক কোম্পানি, আমেরিকার অ্যালোকা আইএনসি এবং আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ফুড কোম্পানি মনডিলেজ ইন্টারন্যাশনালের একজন বোর্ড অব ডিরেক্টর রতন টাটা। এ ছাড়া তিনি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার একজন ট্রাস্টি।

টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর তত্ত্বাবধানে জাগুয়ার, টেটলি, ল্যান্ড রোভার এবং কোরাসের মতো কোম্পানি কিনে বর্তমানে টাটা গ্রুপ একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে পরিণত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অন্য উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : ১. টাটা ইস্পাত : ৩৫ মিলিয়ন টন বার্ষিক অপরিশোধিত ইস্পাত পরিশোধন ক্ষমতাসহ বিশ্বের বৃহত্তম ইস্পাত প্রস্তুতকারকদের মধ্যে একটি। ২. টাটা মোটরস : টাটা মোটরস গাড়ি, ইউটিলিটি যানবাহন, পিকআপ, ট্রাক এবং বাস উৎপাদন করে। ৩. টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (ঞঈঝ) আইটি পরিষেবা, পরামর্শ এবং ব্যবসায়িক সমাধান অফার করে। ২০২৪ সালের হিসাবে, বাজার মূলধনের ভিত্তিতে ঞঈঝ হলো ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি। ৪. টাটা কেমিক্যালস : রাসায়নিক, শস্য সুরক্ষা এবং বিশেষ রসায়ন পণ্যে কাজ করে। ৫. টাটা কনজিউমার প্রোডাক্টস : বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর চা উৎপাদনকারী, পরিবেশক এবং কফি শিল্পের একটি প্রধান খেলোয়াড়। ৬. টাটা পাওয়ার : ২০২৪ সালের হিসাবে ভারতের বৃহত্তম পাওয়ার কোম্পানি। ৭. টাইটান : লাইফস্টাইল শিল্পের একটি প্রধান খেলোয়াড়, টাইটান অন্যান্য পণ্যগুলোর মধ্যে গয়না, ঘড়ি এবং চশমা সরবরাহ করে। ৮. টাটা ক্যাপিটাল : সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্যিক অর্থায়ন এবং অবকাঠামোগত অর্থায়নসহ ব্যাপক আর্থিক পরিষেবা অফার করে। ৯. ইন্ডিয়ান হোটেল কোম্পানি : ২০২৪ সাল পর্যন্ত, ভারতের বৃহত্তম আতিথেয়তা কোম্পানি, ১২টি দেশ এবং চারটি মহাদেশজুড়ে শত শত হোটেল পরিচালনা করছে। ১০. ইন্ডিয়ান অ্যাডভান্সড সিস্টেমস লিমিটেড : টাটার মহাকাশ এবং প্রতিরক্ষা সহায়ক, অস্ত্র এবং উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উৎপাদন করে। ১১. টাটা কমিউনিকেশনস : একটি প্রধান ভারতীয় টেলিযোগাযোগ প্রদানকারী।

তাঁর অবসরের সময় কোম্পানির বার্ষিক আয় ছিল ১০ হাজার কোটি ডলার। আর তাঁর নিজের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ১০০টিরও বেশি দেশে তাঁর প্রতিষ্ঠানের জমজমাট ব্যবসা চলছে। সাধারণত যে কোনো বড় কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতারাই লিজেন্ড হয়ে থাকেন। কিন্তু রতন টাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা না হয়েও ব্যবসার জগতে লিজেন্ড হয়ে গেছেন। শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশের ব্যবসায়ীরাই রতন টাটাকে গুরু মানেন। ছোট একটি পদ দিয়ে শুরু করে একটি কোম্পানির সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে তাঁকে এত বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডে পরিণত করার উদাহরণ আর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। ব্যবসার হাল কীভাবে ধরতে হয়, তা শিখতে হলে রতন টাটার জীবনী নিশ্চয়ই একটি ভালো শিক্ষার উৎস। সারা বিশ্বে শিল্প ক্ষেত্রের পটভূমিতে এক দুর্দমনীয় ছাপ রেখে রেখে গেলেন রতন টাটা। দূরদর্শী নেতৃত্ব, নৈতিক আচরণ এবং জনহিতকর কাজের জন্য তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়