প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২৬
প্রবীণের মানসিক স্বাস্থ্য ও কারণে-অকারণে রাগ
রাগ হলো ইচ্ছা পূরণ করার কিংবা ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার সহজাত প্রতিক্রিয়া। রাগ স্বার্থের সংঘাতে বিজয়ী হওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। সমাজে পরিবারে রাগের গুরুত্ব আছে বিধায় মানুষ রাগ দেখায়। রাগ উঠলে চোখে মুখের এমন পরিবর্তন হয় যাতে করে অন্যরা বুঝতে পারে রাগান্বিত ব্যক্তি শক্তিশালী। শক্তিশালী মানুষকে সাধারণত মানুষ ঘাটতে চায় না। কম রাগী অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রকৃতির মানুষকেই বেশি হেনস্তার শিকার হতে দেখা যায়। মানুষ মাত্রই রাগ, ক্ষোভ, জেদ, হিংসা, বিদ্বেষ, ভালোলাগা, মন্দ লাগা ইত্যাদি প্রকাশ করবে। এসব আবেগ শোভনভাবে প্রকাশ করা হলো বুদ্ধিমান মানুষের ধর্ম।
রেগে গেলে কি মানুষ হালকা হয়ে যায়? শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা কমে? সম্পর্ক কি সতেজ হয়? আঘাত করার সম্ভাবনা কি কমে? উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি না হয় তবে আমরা রেগে যাব? জীবন নষ্ট করার জন্য রাগই যথেষ্ট। রাগ আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। রাগের সাথে মাথা ব্যথা, নিদ্রাহীনতা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। শারীরিক সকল নির্যাতনের পিছনে রয়েছে রাগ। রাগ চরমে উঠলে মানুষ এমন সব কাণ্ড করে ফেলতে পারে, যা কল্পনা করা যায় না। প্রচণ্ড রাগে শরীর কাঁপতে থাকে, গা ঘামতে থাকে, রক্তে হরমোন নিঃসরণ বাড়তে থাকে, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে।
সম্পর্ক সচল রাখার প্রধান উপায় হলো যোগাযোগ রক্ষা করা। রাগের মাথায় খারাপ আচরণ করে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া দুঃখজনক সিদ্ধান্ত। বারবার খারাপ আচরণ করতে থাকলে সম্পর্কের ফাটল বড় হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, অফিস-আদালতে, হাটে বাজারে, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে,যানবাহনে, জ্যামে আটকে, নিজ কর্মক্ষেত্রে রাগ দেখিয়ে যে অর্জন হয় তা অতি সামান্য। অপ্রাপ্তি, খুঁতখুঁতে স্বভাব, হয়রানি করার অভ্যাস, কর্তৃত্বপরায়ণ, সবসময় জেতার মানসিকতা, পরাজয় মানতে না পারার কারণে মানুষ সাধারণত রেগে যায়।
রাগ হলো এমন একটা আবেগ, যা আমাদের এমন কিছু করতে বাধ্য করে যা আমরা প্রকৃত অর্থে করতে চাইনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে রাগ প্রকাশ বেশি হতে দেখা যায় বুদ্ধিমান মানুষ রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে।
আমাদের প্রবীণরা যে সমস্ত কারণে রেগে যান সেগুলো হলো ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর কাছ থেকে অনাকাক্সিক্ষত এবং অশোভন আচরণের শিকার হয়ে। ভরণ-পোষণ, সেবা-যত্ন, চিকিৎসায় গাফলতি হলে। সম্পর্ক রক্ষায় কিংবা সম্পর্ক ভাঙ্গায় অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করলে। নিজের সহায়-সম্পদ, টাকা-পয়সার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে। থাকা-খাওয়ার জায়গা কিংবা বাসা-বাড়ি পরিবর্তন হলে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেবাকর্মী পরিবর্তন করলে। পছন্দের মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখতে বাধা দিলে। পছন্দের খাবার গ্রহণে সহযোগিতা না করলে, বেড়াতে যেতে বারণ করলে।
প্রবীণরা অনেকেই বুঝতে চান না এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের চিন্তা-চেতনা, রুচি, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের পার্থক্য। তাঁরা নিজেরা কত ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন তার দীর্ঘ ফিরিস্তি দিতে থাকেন। কেউ কেউ বলেন, খাল-নদী-বিল পার হয়ে, মাইলের পর মাইল হেঁটে, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে স্কুল-কলেজে গিয়েছেন। অভাব-অনটনের জন্য ভালো কাপড়-চোপড়, খাবার-দাবার পাননি। লজিং থেকে, টিউশনি করে, শারীরিক পরিশ্রম করে শিক্ষাজীবন শেষ করার স্মৃতিচারণে পরবর্তী প্রজন্মের তেমন আগ্রহ থাকে বলে মনে হয়নি। আক্ষেপ করে বলেন, কুপি-বাত্তি, হারিকেনের আলোতে পড়তে হয়েছে আর এখন বৈদ্যুতিক বাতি, এসি, ফ্যানের মধ্যে থাকার পরও লেখাপড়ায় আগ্রহ কমে গেছে। নাতি-নাতনিদের চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, বন্ধু-বান্ধব পর্যন্ত কেউ কেউ পছন্দ করে না।
জীবনের শেষ দিনগুলোতে প্রায় সব প্রবীণই কম-বেশি ধর্মকর্ম নিয়ে অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েন। তাঁরা চান পরিবারের সকল সদস্যই ধার্মিক হবে। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিকে সফল দেখতে চান।
প্রবীণরা সৎ জীবনযাপন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কাঠামো নির্মাণে নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করতে তেমন কোন সাফল্য লাভ করেননি। প্রবীণ দিনদিন পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে হারাতে থাকেন। পৃথিবীতে থাকার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো উঁকি ঝুঁকি মেরে কষ্ট বাড়িয়ে তোলে। যাঁদের কারণে অপ্রাপ্তিগুলো এসেছে তাঁদের প্রতি রাগ তীব্র হচ্ছে।
প্রবীণরা যখন অকারণে রেগে যান সেগুলো হলো, জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বাড়ছে, আমাদের সময় জিনিসপত্র ছিল সস্তা। কেউ খোঁজখবর রাখে না, এখনকার ছেলে-মেয়ে স্বার্থপর, আমরা কষ্ট করছি, পোলাপান কষ্টের কিছু দেখেনি, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত, সরকার প্রবীণদের জন্য কিছু করলো না, আগের মতো লেখাপড়ার মান নেই, মুরব্বিদের এখন আর কেউ আগের মতো সম্মান করে না, দেশটা ঘুষ-দুর্নীতিতে ডুবে গেল, একটু বৃষ্টি হলে শহর পানিতে ভাসে, যানজটে রাস্তা ঘাটে বের হওয়ার উপায় নেই, আমাদের দিন শেষ এখন যাবার সময় হয়েছে। দেশটা টাউট বাটপারে ভরে গেল, সাধারণ মানুষ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হয়ে গেল, যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। বিনা স্বার্থে কেউ এক পা এগোতে চায় না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, আমাদেরকে ফোন করার সময় কই!
উপরের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের প্রবীণরা প্রায়শই রাগ করে থাকেন। এসব রাগ দেখিয়ে প্রবীণরা তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারবেন বলে মনে হয় না।
সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, রাগী মানুষের মন ভালো। এ কথাটি মোটেও সত্যি নয়। রাগী মানুষের মন কখনোই ভালো হতে পারে না। রাগী মানুষ আশপাশের সবাইকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে বিষিয়ে তোলে। তবে রাগ প্রকাশে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিন্তু অতিরিক্ত রাগ প্রকাশ ক্ষতিকর। রাগ মানুষকে সংকেত দেয় তার প্রতি কী অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে সে বিষয়ে।
ভালো রাগ হলো কোন একটা অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে একক কিংবা সংঘবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো।
সাধারণ মানুষের সপ্তাহে তিন-চারবার রেগে যাওয়া স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেউ যদি দিনে তিন-চারবার রেগে যান তবে তা গুরুত্বসহ কারে বিবেচনা করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
বিশেষ ধরনের রাগওয়ালা মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, সমঝোতা করে মানবসভ্যতা এগিয়ে নিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন। রাগ সবসময়ই খারাপ ফল বয়ে আনে না। রাগ প্রকাশ করতে গিয়ে যতখানি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তার চাইতে রাগ চেপে রাখতে গেলে বেশি ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। রাগ প্রকাশ করলে সুখের সুখের অনুভূতি তৈরি হয় বলেই মানুষ রাগ প্রকাশে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠে। ক্ষমতাধর, সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে বেশি রাগ দেখিয়ে কাজ আদায় বা স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালান।
রাগ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির নিজের এবং পরিবেশ প্রতিবেশের কতখানি ক্ষতি হবে তা বিবেচনা করতে পারলে রাগ নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণে যেসব কাজ করা যেতে পারে তা হলো, প্রতিক্রিয়া দেখাতে সময় নিন, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন, স্থান পরিবর্তন করুন, বিরক্তি প্রকাশ না করে ঠাণ্ডা মাথায় সমাধানের পথ খুঁজুন, ব্যায়াম করুন অথবা হাঁটতে হাঁটতে বের হয়ে যান, ক্ষমা করে হালকা বোধ করুন, নিরুপায় হলে কাউন্সিলং সেবা অথবা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক ও সংগঠক।