মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩২ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বিদেশি ভাষা বাঙালি জাতির জন্যে উদ্বেগজনক

অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার
বিদেশি ভাষা বাঙালি জাতির জন্যে উদ্বেগজনক

ফেব্রুয়ারিকে বলা হয় ভাষার মাস। স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ প্রতি বছর অমর একুশের শহীদ দিবসে মহান ভাষা আন্দোলনের সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে। কিন্তু আজ ঘরে ও বাইরে আমাদের মাতৃভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলা যে নিরাপদে আছে এমন দাবি করা যাবে কি? সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহারে তালগোল পাকিয়ে আছে। বাংলা ভাষা প্রশাসনিক কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে ভাষা-নৈরাজ্যের শিকারে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক বাঙালির কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা এখনো কৌতূহলের বিষয় হিসেবেই বিবেচিত। গোড়া থেকেই বাঙালি অভিজাত শ্রেণি বাংলা ভাষাকে তাদের শ্রেণিগত স্বার্থে অবজ্ঞা করে আসছে। এ অবজ্ঞা নতুন নয়, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আজও তা অব্যাহত রয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না।

বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে ইংরেজি ভাষা হলো দেশিয় বিদেশি ভাষা। এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অনেক ক্ষেত্রে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক। এ শিক্ষা সর্বাত্মক এবং দেশব্যাপী। আর এ শিক্ষা যে আদর্শের ছুতো ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার অন্যতম হলো ‘বিশ্বায়ন’। অথচ বিশ্বায়নকে যদি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে নিয়ে কোনো ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে সেখানে শুধু ইংরেজি কেন? ইংরেজিসহ অন্যান্য বিদেশি ভাষাও শিক্ষাব্যবস্থায় অঙ্গীভূত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেশে এখন একটি ইংরেজিনির্ভর একক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে এর কুফল দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব পড়ছে।

বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ফলে কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয় এবং ঐসব রাষ্ট্রগুলোতে সংবিধান গৃহীত হয় বটে কিন্তু ভারত প্রজাতন্ত্রের বাংলা ভাষাভাষীর রাজ্যগুলোয় বাংলা ভাষার মর্যাদা নিরূপণের কোন আইনগত অধিকার নেই। বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকার সময় বাংলাদেশের বাংলা ভাষার মর্যাদা নির্ধারণে কোনো আইনগত অধিকার ছিল না। কিন্তু পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের ফলে বাংলাদেশ বাংলা ভাষার মর্যাদা নির্ধারণের আইনগত অধিকার লাভ করে। বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে এ ভাষাকে ইংরেজিসহ অন্য সব ভাষার উপর মর্যাদা দেয়া হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হয়। এই মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ (৮ মার্চ, ১৯৮৭) আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে প্রণীত আইন। কিন্তু এ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ আদৌ বাস্তবায়ন করা হয়নি। আর হয়নি বলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা পাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশ এবং বাংলাভাষী রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিজাত শ্রেণি ইংরেজি ভাষাকে তাদের অভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাছাড়া পুঁজিবাদী-বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে মর্যাদার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছে।

এক গবেষণার সূত্রে দেখা গেছে, আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে দেশের প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোকের প্রথম ভাষা হবে ইংরেজি, যাদের কাছে বাংলা হবে দ্বিতীয় ভাষা। বরং এ শ্রেণিটি আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। আর যাদের প্রথম ভাষা বাংলা, তারা এদেশে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোনঠাসা হয়ে পড়বে। বাঙালি জাতির জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। কেননা ইংরেজি ভাষাভাষীরা দেশের জাতীয় মূলনীতিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এ দেশেরই অর্থে দেশে তাদের মতো করে একটি সংস্কৃতি ও জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে নেবে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এও বললে বলতে হয়, ২৫-৩০ বছর পর এ জনগোষ্ঠী দেশে একটি শাখা জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। স্মর্তব্য, এ পরিমাণ জনগোষ্ঠী অনেক দেশই নেই।

এই দেশে যে (প্রথম ভাষা ইংরেজিসম্পন্ন) শাখা জাতি গঠিত হতে যাচ্ছে, তার অন্তরালে পুঁজিবাদী-বিশ্বায়ন রয়েছে। পুঁজিবাদের ধারক-বাহক শ্রেণীগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ কয়েক দশক ধরে শিক্ষাবিদরা বিশ্বায়ন ধারণাটিকে অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও দাপ্তরিক-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ওকালতি করে যাচ্ছে। কিন্তু আদতে বিশ্বায়ন কোনোক্রমেই সর্বাত্মক ও একক ইংরেজি ভাষানীতিকে সমর্থন করে না। কেননা বিশ্বায়ন হলো বিশ্বব্যাপী একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া যার উপযোগিতায় অংশগ্রহণকৃত বিশ্বের দেশ কিংবা অঞ্চলগুলো তাদের নিজ নিজ জ্ঞান, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, দ্রব্য পণ্য ও পুঁজি প্রভৃতি বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর লাভবান হতে পারে এবং সার্বিকভাবে বিশ্বজগৎ লাভবান হতে পারে। কিন্তু এতে অংশগ্রহণকারী অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বা অঞ্চলগুলো লাভের পরিবর্তে অনেকটা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো একচেটিয়াভাবে এ প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বায়ন আদর্শটি বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এ জাতীয় নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সেজন্য বিশ্বায়ন আদর্শের ভিত্তিতে একটি বিদেশী ভাষা (ইংরেজি ভাষাসমেত) ভাষানীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন তা যেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা জাতীয় প্রধান চার মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।

প্রকৃতপক্ষে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে বিশ্বায়ন কোনোক্রমেই বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী কর্মকান্ড সমর্থন করে না। কিন্তু দেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও ইংরেজি মাধ্যমের দাপ্তরিক ব্যবস্থার যে তোড়জোড় চলছে, তা বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী চিন্তারাধাপ্রসূত কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে প্রধান্য দিয়ে বিশ্বায়নের নিরিখে দেশে কোনো বিদেশী ভাষা মাধ্যমের শিক্ষা-ব্যবস্থা ও দাপ্তরিক ব্যবস্থা চালু করা হলে সেখানে প্রথমে প্রধান্য পেতে হবে বাংলা ভাষা, আর সেখানে এককভাবে বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভষার গুরুত্ব থাকবে না। বরং সব বিদেশি ভাষা সমান গুরুত্ব পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ দেশের কোন ভাষানীতি নেই, সেজন্য বিদেশী ভাষা শিক্ষানীতিও নেই। সেই সুযোগে ইংরেজিবিদরা দেশ ও জাতিকে ভুলভাল বুঝিয়ে দেশে একটি শাখা জাতি সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের সূচনা করছে।

মোটকথা, আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক হতে পারব না, এগোতেও পারব না সামনের দিকে, যদি না বাংলার প্রচলন ঘটাতে পারি। পঁজিবাদী-বিশ্বায়নের সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রসানের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড়ানোর জায়গাটাও কিন্তু ওই মাতৃভাষার চর্চাই। ওইখানে দাঁড়িয়েই আমাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক হওয়া সম্ভব এবং হতে হবে।

অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার : সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়