প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
সমাজভর্তি বিচিত্র মানুষ। কারও সঙ্গে কারও শতভাগ মিল নেই। রঙে মিল নেই, কথায় মিল নেই, আচরণে মিল নেই, চলাফেরায় মিল নেই, চিন্তা-চেতনায় মিল নেই। প্রতিভাও সবার সমান নয়। উচ্চতায়ও পার্থক্য ঢের। অমিল রয়েছে আয়ে, পারিবারিক অবস্থায় এবং বয়সে। কেউ উদার, কেউ অনুদার; কেউ কোমল, কেউ রাগী; কেউ অন্তর্মুখী, কেউ বহির্মুখী। কারও দুটি হাত থাকার বদলে একটি থাকা কিংবা পা না থাকা বা চোখে দেখতে না পাওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ যাদের আমরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ কিংবা প্রতিবন্ধী বলি, তারাও এই বৈচিত্র্যের বাইরে নয়। অটিজম এমনি এক বৈচিত্র্যের নাম। যাদের মানসিক কিংবা শারীরিক বিকাশ সঠিকভাবে হয় না তারা সাধারণত অটিজমের শিকার। মানুষের বৈচিত্র্যের মধ্যেও শেষ দুই শ্রেণির জন্য আলাদা পরিভাষা সমাজে প্রচলিত; কারণ তাদের ধরন ও প্রয়োজন ভিন্ন। সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতির জন্য আমরা যেমন ভিন্ন চিন্তার মানুষকে সম্মান করি, ঠিক একই কারণে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের চাহিদা পূরণে আমরা এগিয়ে যাই এবং অটিজম রয়েছে এমন কারও প্রতি সহানুভূতিশীল হই। সে চিন্তা থেকেই নিশ্চয় অটিজম সচেতনতা দিবসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল জাতিসংঘ। ২ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়।
অটিজম সচেতনতা দিবসে এ বছর জাতিসংঘ জোর দিয়েছে ইনক্লুসিভ এডুকেশন বা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষায়। আমরা জানি, প্রতিটি শিশুর চাহিদা ও সম্ভাবনা অনুযায়ী শিখন সম্পন্ন করা এবং সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে সবার শিক্ষা নিশ্চিত করাই অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা। এর মাধ্যমে ধর্মণ্ডবর্ণ, ধনী-গরিব, ছেলে-মেয়ে, প্রতিবন্ধী-অটিস্টিকসহ সব শিশুকে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা হয়। বস্তুত আমরা যখন অটিস্টিক শিশুর চাহিদা নিশ্চিত করার কথা বলছি, তাদের ব্যাপারে সচেতনতার কথা বলছি, সেখানে প্রথমেই আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে শিক্ষায়। কারও শিক্ষা নিশ্চিত না করলে যে ব্যক্তিটি পিছিয়ে যায়, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যক্তির পিছিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রও পিছিয়ে যায়। তাছাড়া সংবিধান অনুযায়ী, শিক্ষা সবার অধিকার। সে জন্যই অটিজম রয়েছে-এমন শিশুদের শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অটিজম নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের হিসাবে, প্রতি ১৫০ জনের মধ্যে একটি শিশু অটিজমে আক্রান্ত এবং বাংলাদেশে প্রতি হাজারে আটটি শিশুর মধ্যে অটিজম রয়েছে। তার মানে সংখ্যাটি একেবারে কম নয়। অটিজমস্পিকস নামে আন্তর্জাতিক একটি সংগঠন ‘স্কুল কমিউনিটি টুলকিট’ নামে একটি মডিউল প্রকাশ করেছে। সেখানে অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষার বিস্তারিত রয়েছে। এটা স্বাভাবিক, অটিজম রয়েছে এমন শিশুদের শিক্ষার সঙ্গে চিকিৎসাসহ বিশেষ প্রশিক্ষণের বিষয় থাকবে। এর জন্য বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। কারণ তাদের শিক্ষাদান কার্যক্রম খুবই নিবিড় ও বিশদভাবে হওয়া প্রয়োজন। সে জন্য পেশাদার শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে। যারা শিক্ষার্থীর আচরণ, বিকাশ, সামাজিক ও একাডেমিক প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
অটিস্টিক শিশুর শিক্ষা ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশে নিম্নবিত্ত কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তের ঘরের অটিজমের শিকার সন্তানরা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক সময় প্রয়োজনীয় তথ্য না থাকার কারণেও অনেক পরিবার এমন সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়। দেশে এ ধরনের বিশেষায়িত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘাটতি রয়েছে। কয়েক বছর আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অটিস্টিকসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে বিশেষায়িত প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তা নিঃসন্দেহে এসব শিশুর শিক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে।
আমরা দেখছি, দিবসটি কেবল অটিজম নয়, এর সঙ্গে সচেতনতাও যুক্ত। অটিজম সচেতনতার কাজটি সামাজিক কাজ। এর মধ্যে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতেই যে বিষয়টি বলেছি, আমরা সামাজিক বৈচিত্র্যে নিয়ে বাস করি। এখানে কেউ শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ কিংবা নিখুঁত নয় বলেই অন্যের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে আমাদের আন্তরিক হতে হয়। এই আন্তরিকতা ও সম্মানবোধ সব ধরনের মানুষের জন্য থাকলে সবার প্রয়োজনে সবাই এগিয়ে আসবে। এ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলে সেখানে অটিজমের শিকার শিশুর অধিকার যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি সব পর্যায়ে সামাজিক বৈষম্য দূর হবে এবং সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা আসবে।
মাহফুজুর রহমান মানিক : সাংবাদিক ও শিক্ষা-গবেষক।