প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২১, ০০:০০
জন্মনিরোধক পদ্ধতি : কনডম
এইচএম জাকির
জন্মনিরোধক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত রাবার জাতীয় পাতলা আচ্ছাদনকৃত একপ্রকার বস্তুর নাম কনডম। কনডম শুধুমাত্র জন্মনিরোধক পদ্ধতি হিসেবেই নয়, যৌনবাহিত সংক্রমণের বিস্তার রোধেও এটি ব্যবহার করা হয়। কনডম জন্মনিয়ন্ত্রণেরর জন্যে একটি নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি। এর ব্যবহার অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ প্রতিরোধ করে এবং যৌনবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করে। কনডম পুরুষের জন্যে একটি নিরাপদ ও শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।
|আরো খবর
আধুনিক রাবার প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কনডম এখন ল্যাটেক্স বা পিচ্ছিল জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। গ্রহণযোগ্যতার জন্যে কনডম এখন খুবই পাতলাভাবে তৈরি হয়। এতে শুক্রনাশক ও পিচ্ছিলকারক পদার্থের পাশাপাশি সুগন্ধিও যোগ করা হচ্ছে। বর্তমানে কিছু কনডম ফোটাযুক্ত বা ডটেড হওয়াতে এর গ্রহণ যোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কনডম এখন আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যকর পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি খুবই সহজলভ্য ও সহজপ্রাপ্য পদ্ধতি। সরকারিভাবে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিতরণরকৃত কনডমটি ‘নিরাপদ’ নামে পরিচিত এবং তা মাঠ পর্যায়ে পরিবার কল্যাণ সহকারী, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ দেশের সকল সরকারি হাসপাতালে পাওয়া যায়। বেসরকারিভাবে বিভিন্ন কোম্পানির নানা নামের কনডম বাজারে রয়েছে, যা গ্রামের মুদি দোকান ও ওষুধের দোকানসহ সর্বত্র পাওয়া যায়।
কনডমের কার্যকারিতা
সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে কনডম খুবই কার্যকর একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হয়ে থাকে তবে জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনরোগ প্রতিরোধে কনডমের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। কনডম সঠিক নিয়মে ব্যবহারের মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস, গনোরিয়া, সিফিলিসসহ যৌনবাহিত মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
কনডম কীভাবে কাজ করে
যৌনকর্ম সম্পাদনে কনডম ব্যবহারে গর্ভপ্রতিরোধ ও যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধ এ দুই ধরনের সুফলতা পাওয়া যায়।
ক. গর্ভপ্রতিরোধ : গর্ভধারণের মূল শর্ত হচ্ছে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন। কনডম ব্যবহারে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন হয় না। গর্ভপ্রতিরোধে কনডম প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। যৌনকর্ম সম্পাদনকালে বীর্যপাতের পর শুক্রাণু কনডমের ভেতরে থেকে যায়। ফলে শুক্রাণু যোনিপথে প্রবেশ করতে পারে না বিধায় ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হতে পারে না। যার ফলে গর্ভসঞ্চার হয় না। কনডমের সঠিক ব্যবহার জন্মনিয়ন্ত্রণ রোধ করে। তবে কনডমের ভুল ব্যবহার ও ফেটে গেলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে।
খ. যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধ : যৌনকর্ম সম্পাদনে বিপরীত লিঙ্গের দুজন মানুষের প্রয়োজন হয়। এর যে কোনো জনের যৌনবাহিত কোনো রোগ থাকলে যৌনকর্মের সময় তার ট্রান্সমিশন ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই যৌনকামনাকালে একজন থেকে অন্যজনে যৌনবাহিত রোগপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে কনডম কার্যকর ভূমিকা রাখে। বীর্যের সাথে নির্গত রোগ জীবাণুকে যৌনিপথের সংস্পর্শে আসতে বাধা দেয় কনডম। কনডম পুরুষাঙ্গের রোগ জীবাণুর সংক্রমণ থেকে যৌনিপথকে রক্ষা করে, একইভাবে যৌনিপথের রোগজীবাণুকে পুরুষাঙ্গের সংস্পর্শে আসতে বাধা দেয়।
কনডমের সুবিধা
* কনডম একটি নিরাপদ ও সহজলভ্য পদ্ধতি।
* কনডম হরমোনাল পদ্ধতি না হওয়ায় হরমোনজনিত কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়া নেই।
* কনডম কোনো ওষুধ নয়, তাই ওষুধনির্ভর পদ্ধতির মতো কোনো পাশর্^প্রতিক্রিয়াও নেই।
* কনডম শরীরের বাহিরে প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই অন্য পদ্ধতির মতো শরীরে প্রবেশের কোনো ঝামেলা নেই।
* সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে জন্মনিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এইচআইভি/এইডস ও অন্যান্য যৌনরোগ থেকে রক্ষা করে।
* যৌনবাহিত রোগের কারণে মহিলাদের তলপেটের প্রদাহ, তলপেটে ব্যথা এবং মহিলা ও পুরুষ উভয়কে বন্ধ্যাত্ব হতে রক্ষা করে।
* শুধুমাত্র যৌনমিলনের সময় ব্যবহার করতে হয়। অন্য পদ্ধতির মতো সবসময় ব্যবহার করতে হয় না।
* মাসিককাল বা ঋতু নিয়ম মেনে ব্যবহার করা যায়।
* সব বয়সী পুরুষের জন্যে উপযুক্ত।
* নববিবাহিতদের জন্যে উপযুক্ত পদ্ধতি।
* চিকিৎসক বা সেবাদানকারীর সাহায্য ছাড়াই ব্যবহার করা যায়।
* যে কোনো স্থানে বিক্রি হয়, তাই সহজপ্রাপ্য।
* দাম কম।
* গর্ভধারণের ভয় থাকে না বলে যৌনমিলনের আনন্দ ও স্থায়িত্ব বাড়ায়।
* দ্রুত বীর্যপাত রোধ করে।
* যৌনতৃপ্তকালে বীর্য বের হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ব্যবহার করা যায়।
* জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনরোগ প্রতিরোধে পুরুষের অংশগ্রহণ ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে।
* কনডম পিচ্ছিল হওয়ায় মিনলকালীন ঘর্ষণজনিত অস্বস্তি কমায়।
কনডমের অসুবিধা
* কারো কারো ল্যাটেক্স বা কনডমে ব্যবহৃত পিচ্ছিলকারী পদার্থ থেকে এলার্জি হতে পারে।
* কনডম ব্যবহারে পূর্ণতৃপ্তি কমে, এমন অনুভূতির কারণে যৌনমিলনে আনন্দ কম হতে পারে।
* যৌনকর্মকালে কখনো কখনো কনডম ছিঁড়ে যেতে পারে বা পুরুষাঙ্গ থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
* পূর্ব থেকে কনডমে ছিদ্র থাকলে বীর্য বের হয়ে যেতে পারে।
* যৌনক্রিয়ার পূর্ব মুহূর্তে কনডম পরার জন্যে যে সময় লাগে তাতে মনের আত্মতৃপ্তি কমে যায়। অনেক সময় কনডম পরার আগেই বীর্য বের হয়ে যেতে পারে।
* পুরোনো ও স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে রাখা কনডমের কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
* কনডম ক্রয়, পরিবহন, খোলা ও পরায় লজ্জাবোধ হয়।
* মজুদ না থাকলে ঝামেলায় পড়তে হয়।
* মজুদে লুকোচুরি খেলতে হয়।
* ব্যবহার-পরবর্তী কনডম ফেলে দেয়ার জন্যে সচেতনতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
কনডম যাদের জন্যে উপযুক্ত
* নবদম্পতির জন্যে উপযুক্ত পদ্ধতি।
* কর্মসূত্রে স্বামী দূরে থাকেন, মাঝে মাঝে স্ত্রীর কাছে আসেন, তবে সন্তান নিতে বিরতি চান; এমন দম্পতিরাও কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* যাদের বীর্যপাত দ্রুত হয় তারাও কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* যারা যৌনমিলনের সময় অসস্তিবোধ করেন বা পিচ্ছিলতা চান তারা ডটেড বা পিচ্ছিল কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* যারা খাবার বড়ি খান তারা বেড়ানো বা অন্য কোনো কারণে বড়ি সঙ্গে নিতে ভুলে গেছেন কিংবা হঠাৎ বড়ির শূন্যতা দেখা দিয়েছে তারা এ সময়ে যৌনমিলনকালে কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* যে কোনো প্রজননসক্ষম পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ ও যৌনবাহিত রোগের সংক্রমণ রোধের জন্যে কনডম ব্যবহার করতে পারেন। এতে সঙ্গীনিও নিরাপদ।
* যে সকল দম্পতি অন্য পদ্ধতি নিলে শারীরিক সমসা হয় তারা কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* যারা দীর্ঘমেয়াদী কোনো পদ্ধতি নিতে চান না তারা কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে কোনো একজনের যৌনবাহিত রোগ থাকে তারা একজন থেকে অন্যজনে রোগ বিস্তার রোধে কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* সন্তান জন্মের পর প্রথম ৬ মাস স্তন্যদানকালে কার্যকর গর্ভরোধের জন্যে কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* যারা অন্য পদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণের জন্যে অপেক্ষা করছেন তারা অপেক্ষাকালে কনডম ব্যবহার করতে পারেন।
* ভ্যাসেকটমি বা এনএসভি বা পুরুষ স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করার পর স্ত্রী যদি কোনো পদ্ধতি গ্রহণ না করে তাহলে স্বামীকে ৩ মাস পর্যন্ত কনডম ব্যবহার করতে হবে।
কনডম যাদের জন্যে উপযুক্ত নয়
* যারা উত্তেজনা বজায় রাখতে বা চরম পুলক লাভে ব্যর্থ হন তাদের জন্যে কনডম উপযোগী নয়।
* যারা রাবার বা লেটেক্সের সংস্পর্শে এলার্জির সম্ভাবনা থাকে তাদের জন্যে কনডম নয়।
* যারা কনডমে আত্মতৃপ্তি নিয়ে সংকোচবোধ করেন তাদের জন্যে কনডম নয়।
* যৌনমিলনের সময় কনডম ফেটে যাওয়ার প্রবণতা যাদের রয়েছে তাদের জন্যে কনডম নয়।
কনডমের ব্যবহারবিধি
* যৌনমিলনের আগে কনডম প্যাকেট থেকে খুলে উন্থিত পুরুষাঙ্গে পরে নিতে হবে।
* সাবধানে প্যাকেট খুলুন যেনো প্যাকেট ছিঁড়ে না যায়। পরার আগে কনডমের ভাঁজ খুলবেন না।
* কনডমের সামনের অংশ টেনে ধরে উন্থিত পুরুষাঙ্গে পরুন (খতনা করা না থাকলে লিঙ্গের অগ্রভাগ পেছন টেনে নিন, তারপর পরুন)।
* মোড়ানো কনডমটি ধীরে ধীরে পরুন। যাতে পুরুষাঙ্গ সম্পূর্ণ ঢেকে যায়।
* সবসময় সহবাসের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কনডম পরবেন।
* বীর্যপাত হবার পরপরই লিঙ্গ উন্থিত থাকাবস্থায় কনডমের গোড়া চেপে ধরে যৌনিপথ থেকে পুরুষাঙ্গ বের করুন।
* সাবধানে কনডম পুরুষাঙ্গ থেকে খুলবেন, যেনো কোনো ক্রমেই কনডম থেকে বীর্য বের হতে না পারে।
সতর্কতা
* কনডমের মেয়াদ আছে কি না তা দেখে নিতে হবে।
* কনডম অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা স্থানে রাখা যাবে না, তাতে গলে বা ফেটে যেতে পারে।
* কনডম ছেঁড়া বা ফাটা কি না তা দেখে নিশ্চিত হতে হবে।
* পুরুষাঙ্গ থেকে বের করা কনডমের মুখ বেঁধে কাগজে বা প্যাকেটে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। অথবা অন্যান্য আবর্জনার সাথে আগুনে পোড়ানো বা মাটি চাপা দিতে হবে।
* কনডম কখনোই টয়লেটের কমোড বা প্যানে ফেলা যাবে না। কারণ তা পয়ঃনিস্কাশনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বা স্যুয়ারেজ লাইন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
* ব্যবহারের আগে এবং পরে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
* শিশুদের নাগালের বাহিরে রাখতে হবে যাতে অপব্যবহার না হয়।
তথ্যঋণ : কর্ম ও প্রশিক্ষণ সহায়িকা।
লেখক : পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখা পাঠানোর
ই-মেইল : [email protected]