বার্ধক্যে সুস্থ থাকতে ফিজিওথেরাপির ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী ১৯৯৬ সাল থেকে ৮ সেপ্টেম্বরকে ‘বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো : সুস্থ বার্ধক্যে ফিজিওথেরাপিÑপড়ে যাওয়া ও দুর্বলতা প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব। ফিজিওথেরাপি ইতোমধ্যে সারা পৃথিবীতে চিকিৎসা সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।

বেঁচে থাকলে আমাদেরকে বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বার্ধক্যে নানান রোগশোক মানুষকে চিন্তিত করে তোলে। আমাদের দুর্বল প্রস্তুতি বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্যে উপযুক্ত নয়। যৌবনে শরীর ও মনের যত্ন নিতে শুরু করলে বার্ধক্যে সুফল পাওয়া যায়। আমাদের উদাসীনতা, গুরুত্ব না দেয়া, অহেতুক বিলম্ব করার কারণে শারীরিক নানা রকমের সীমাবদ্ধতা দ্রুততম সময়ে সামনে এসে হাজির হয়। শুরুতেই ফিজিওথেরাপির সেবাগ্রহণ করতে পারলে রোগীর কষ্ট কমে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সহজ হয়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে পেশীশক্তির দুর্বলতা, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, জয়েন্টে ব্যথা, ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারা, কার্ডিও রেস্পিরেটরি, মানসিক সংকট রোগীকে প্রতিনিয়ত সক্রিয় বার্ধক্য যাপন এবং সামাজিক অংশগ্রহণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।

প্রবীণদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার সমস্যা একটি বড়ো স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের নানা পরিবর্তন আসে, যা তাদের চলাফেরাকে অনিরাপদ করে তোলে। প্রবীণরা সাধারণত শারীরিক ও মানসিক ও পরিবেশগত কারণে পড়ে যান।

শারীরিক কারণ হলো, পেশীর ক্ষয় বা ক্ষমতা কমে গেলে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। দৃষ্টি শক্তি হ্রাস, ছানি, গ্লুকোমা আশপাশের পরিবেশ স্পষ্টভাবে দেখতে পান না। যেসব প্রবীণের আলঝাইমার্স, পারকিনসন্স, স্ট্রোক হয়েছে, তাদের পক্ষে স্বাভাবিক চলাফেরা কঠিন। বাত ব্যথায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। দীর্ঘ দিন ধরে নানান রোগের ওষুধ সেবনের ফলে শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, ফলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারো কারো ভার্টিগো বা মাথা ঘোরানোর অসুখ থাকে, সেটা কোনো কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

মানসিক কারণ হলো : হাঁটার সময় অমনোযোগী হওয়া, দ্রুত উঠা-বসা, হঠাৎ সাড়া দিতে গিয়ে পড়ে যাওয়া, মোবাইল ফোন বেজে উঠলে ধরতে যাওয়া, দীর্ঘ সময় ধরে বসে থাকা, ব্যায়াম না করা, পুষ্টির অভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে যাওয়া। আগে যদি কখনো পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়ে থাকেন, পরবর্তীকালে আত্মবিশ্বাস কমে গিয়ে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন।

পরিবেশগত কারণ হলো : উঁচু-নিচু বা অসমতল রাস্তাঘাট, ফুটপাতে চলাচল, সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামার সময় পড়ে যাবার সম্ভাবনা। গোসলখানা, পায়খানায় যাওয়া আসার সময় পড়ে যাবার দুর্ঘটনা সব থেকে বেশি।

বার্ধক্যে দুর্বলতা হলো, বয়স বাড়লে পেশীর ভর ও শক্তি কমে যায়। প্রবীণরা সহজে ভারসাম্য হারান এবং ছোটখাট কাজকর্মে ক্লান্তি অনুভব করে। আথ্রাইটিস বা জয়েন্টের শক্তভাব দুর্বলতাকে আরো বাড়ায়। শরীরের ওজন বৃদ্ধি পেলে চলাফেরায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব

নিয়মিত ফিজিওথেরাপি পেশী ও জয়েন্টকে সক্রিয় রাখে। ফলে প্রবীণরা নিজের কাজ নিজেরাই করতে পারে। থেরাপিস্টরা ভারসাম্য ও সমন্বয়ের বিশেষ অনুশীলন করান, যাতে পড়ে যাবার ঝুঁকি কমে। ব্যথা প্রবীণ জীবনের এক চরম কষ্টের নাম। কাউকে ‘কেমন আছেন’ এই প্রশ্ন করলেই আহত কণ্ঠে উত্তর হবে, আছি কোনো রকম, তবে বিষ ব্যথায় চলাফেরায় কাবু হয়ে গেলাম। ব্যথা উপশমে ফিজিওথেরাপি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যাদের চলাফেরা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তাদেরকে ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়। সুস্থ শরীর মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে।

ফিজিওথেরাপি প্রবীণের শারীরিক সুস্থতা তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রবীণরা ফিজিওথেরাপি নিলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয় এবং ওষুধ নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমে।

আলঝাইমার্স রোগীরা শেষের দিকে হাঁটাচলা বন্ধ করে দেন, খাবার দাবার চিবোতে কিংবা গিলতে পারে না, কথা বলতে বা শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন না। এসব ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি ভালো কাজ দেয়।

বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৮ হলো একটি আইন, যা পুনর্বাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কার্যক্রম, সেবা প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবীদের নিবন্ধন এবং তাদের সেবার মান নিয়ন্ত্রণ এবং নিশ্চিত করার জন্যে প্রণীত হয়েছে।

কেউ যদি ভুয়া সনদ বা মিথ্যা ডিগ্রি ব্যবহার করে, তবে তাকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। সরকার অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ফিজিওথেরাপিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল টেকনোলজি এবং সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা হয়েছে। সবাইকে রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিলের শর্ত পূরণ করে নিবন্ধন নেওয়ার কথা রয়েছে। দ্রুত নিবন্ধন চালু করা গেলে রোগী সেবাগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সুবিধা বাড়বে। ফিজিওথেরাপি নিয়ে প্রতারণার দিকগুলো আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

ফিজিওথেরাপি মূলত ব্যথা উপশম, কার্যক্ষমতা বাড়ানো এবং পুনর্বাসনে কার্যকর। কিছু সংখ্যক ভুয়া ফিজিওথেরাপিস্ট মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, বিভ্রান্তমূলক কথা বলে, অতিরিক্ত সেশনে বাধ্য করে, অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রবীণদের ক্ষতি করে।

ফিজিওথেরাপি নিয়ে যেমন অনেক ইতিবাচক সংবাদ আছে, তেমনি কিছু বিতর্ক ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। ফিজিওথেরাপিস্টদের দ্রুত লাইসেন্সের আওতায় আনতে পারলে প্রবীণরা সঠিক চিকিৎসা পাবার সুযোগ তৈরি হবে এবং একই সাথে প্রতারণা অনেকখানি কমে যাবে।