প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
একজন মানুষের মুখের সৌন্দর্য ৫০ শতাংশ নির্ভর করে দাঁতের সৌন্দর্যের উপর। পরিপাটি ও সুন্দর দাঁতের কারণেই একজন মানুষের চেহারায় পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। যদিও দাঁতের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় আমরা কজনই বা চিন্তিত থাকি কিংবা চেষ্টা করি। ৯ ফেব্রুয়ারি ছিলো জাতীয় দাঁত ব্যথা দিবস।
কথায় আছে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝি না। কথাটি প্রবাদবাক্য হলেও আমরা কিন্তু সবাই বুঝি। সুন্দর হাসির জন্যেও দরকার সুন্দর ও সুস্থ-সবল দাঁত। শারীরিক সুস্থতার জন্যেও দরকার সুস্থ-সবল দাঁত। দাঁতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে দাঁতের ক্ষয়রোগ ও দাঁত ব্যথার উৎপত্তি হয়। অনেকে মনে করেন বয়স হয়েছে তাই দাঁত ব্যথা বা নড়াচড়া করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখবেন, বয়স বাড়ার সাথে দাঁতের নড়াচড়া বা পড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। দাঁতের এরকম ক্ষয়ক্ষতি একমাত্র কারণ সঠিক পরিচর্যার অভাব।
দাঁত ব্যথা বা ক্ষয়রোগ হওয়ার কারণসমূহ
সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মজ্জায় প্রদাহ, দাঁত ক্ষয়ে যাওয়া, ডেন্টাল ট্রমাসহ অন্যান্য কারণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ডেন্টিনের হাইপারসেনসিটিভিটি, অ্যাপিকাল পিরিয়ত্তোনটাইটিস (লিগামেন্ট ও অ্যালভিওলার হাড়ের প্রদাহ), দাঁতের ফোঁড়া, দাঁত তোলার সময় অসতর্কতা, মাড়ি সংক্রমণ, টেম্পোরোম্যান্ডিবুলার ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
* বেশির ভাগ সময় দাঁতের ব্যথা নিচে উল্লেখিত যে কোনো এক ধরনের হয়। তবে অন্যান্য বিরল কারণগুলোর মধ্যে গ্যালভ্যানিক ব্যথা এবং করোডোন্টালজিয়া অন্তর্ভুক্ত।
* পালপিটিস : পালপিটিস বা মজ্জার প্রদাহ বিভিন্ন উদ্দীপন দ্বারা উদ্দীপিত হয়। যান্ত্রিক, তাপীয়, রাসায়নিক এবং ব্যাকটেরিয়ার জ্বালা। সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দাঁতের ক্ষয়, ডেন্টাল ট্রমা (যেমন ফাটল বা ভাঙ্গা) বা একটি অসম্পূর্ণ সিল দিয়ে ফিলিং। যেহেতু মজ্জা কঠোর সেল দিয়ে আবদ্ধ থাকে, তাই প্রদাহজনিত ফোলা সংস্থান করার জায়গা নেই। প্রদাহটি তাই মজ্জা সিস্টেমে চাপ বাড়ায় এবং মজ্জা সরবরাহকারী রক্তনালীগুলো সংকুচিত করে। এতে অক্সিজেনের অভাব ও টিস্যুর মৃত্যু হতে পারে। পালপাই টিস্যুকে বিপরীতমুখী হিসেবে অভিহিত করা হয় যখন স্ফীত মজ্জা রক্ত সরবরাহে অক্ষম হয় এবং টিস্যুর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে থাকে।
* হাইপারসেনসিটিভিটি : দাঁতের হাইপারসেনসিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা হলো একটি তীব্র, স্বল্পস্থায়ী দাঁতের ব্যথা, যা জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের বেলায় ঘটে। যা ঠা-া, মিষ্টি বা মসলাদার খাবার এবং পানীয় দ্বারা উৎপন্ন হয়। দাঁতগুলোতে সাধারণত এই ট্রিগারগুলোর সাথে কিছুটা সংবেদনশীলতা থাকে, তবে যা নিয়মিত দাঁত সংবেদন থেকে হাইসারস্পেন্সিটি আলদা করে তাহলো ব্যথার তীব্রতা। মাড়ির ঘা দাঁতগুলোর শিকর উন্মোচন করার কারণে মুখের মধ্যে ট্রিগারগুলো থেকে নিরোধকের অভাবের কারণে ঘটে থাকে। যদিও এটি স্কেলিং এবং রূট প্ল্যানিং বা ডেন্টাল ব্লিচিংয়ের পরে বা ক্ষয়ের ফলে হয়।
* অ্যাপিকাল পেরিওডন্টাইটিস : এটি হলো সংক্রামিত মজ্জার মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক্ষমতাজনিত কারণে দাঁতটির অগ্রভাগ গিরে তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ। ব্যাকটেরিয়াল সাইটোটক্সিনগুলো অ্যাপিকাল ফোরমিনা এবং পার্শ্বীয় ক্যানেলের মাধ্যমে দাঁতের গোড়াগুলোর আশপাশে অঞ্চলে পৌঁছায়, ভাসোত্তায়ালেশন, ¯œœায়ুর সংবেদনশীলতা এবং সম্ভাব্য ফোঁড়া বা সিস্টের গঠন সৃষ্টি করে। পিরিওডিয়েন্টাল লিগামেন্টটি স্ফীত হয়ে যায় এবং দাঁতের কামড় দেয়ার সময় বা টেপ দেয়ার সময় ব্যথা হতে পারে।
খাদ্য ইমপ্যাকসন : খাবার খাওয়ার সময় খাবারের ধ্বংসাবশেষ বিশেষত্ব মাংসের মতো অন্তর্ভুক্ত খাবার দুটি দাঁতের মধ্যে আটকে যায় এবং চিবানোর সময় মাাড়ির মধ্যে লেপ্টে যায়, খাদ্য আটকে যাওয়ার স্বাভাবিক কারণ হলো দাঁতগুলোর মাঝে ফাঁকা জায়গা। ক্ষয়ের কারণে দাঁতের কিছু অংশ খসে পড়তে পারে। জিঞ্জিভাল পেপিলা ফোলা, কোমল এবং স্পর্শকালে রক্তক্ষরণ হয় এবং খাওয়ার সময় ও পরে ব্যথা হয়।
পিরিয়ডোন্টাল ফোঁড়া বা পাশর্^ীয় ফোঁড়া : পিরিয়ডোন্টাল ফোঁড়া বা পাশর্^ীয় ফোঁড়া পুঁজের ভা-ার। যা চিকিৎসা না করালে এই ফোঁড়াটি যদি ক্ষতের মধ্য দিয়ে দাঁতের শীর্ষে পৌঁছে তবে মজ্জা মরার মতো কারণ হতে পারে। মৌখিক শ্লেষ্মা দ্বারা ঢাকা একটি প্রাথমিক পর্যায়ের এই ফোঁড়াটি দেখতে লাল, ফোলা, চকচকে এবং স্পর্শে বেদনাদায়ক হয়।
পেরিকোরোনাল ফোঁড়া : এটি সাধারণত লক্ষণ হলো টনটনে ব্যথা, লালচে হওয়া, দাঁতে ওঠা মাড়ির ফোলা ভাব, মুখ হা করতে অসুবিধা, মুখ ফুলে যেতে পারে, কিশোর-কিশোরীদের আক্কেল দাঁত ওঠার সময় ব্যথা ইত্যাদি।
অক্লুসাল ট্রমা : অত্যাধিক কামড়ানোর বল প্রয়োগ যা লিগামেন্টের ওপর চাপ পড়ে ও ব্যাথা সৃষ্টি করে। এছাড়াও ঘন ঘন দাঁত কামড়ানো, ঘুম বা জাগ্রত অবস্থায় অস্বাভাবিক দাঁত কটকটানি ইত্যাদি সময়ের সাথে সাথে দন্তক্ষর হতে পারে।
দাঁত তোলার অসর্তকতা : দাঁত তোলার সময় অসর্তকতার ফলে একটি জটিলতা দেখা দেয় রক্ত জমাট বাঁধে না বা জমাট রক্ত সরে যায় এবং খালি দাঁতের জায়গায় খালি হাড় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ব্যথা মাঝারি থেকে গুরুতর, নিরস, ধরা ব্যথা এবং টনটনে ব্যথা হতে পারে।
দাঁতের ট্রমা এবং দাঁত ফাটা সিনড্রোম : ফাটা দাঁতের ব্যাধি একটি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল ব্যথা। দাঁত ভাঙ্গার সাথে সাথে বিক্ষিপ্ত তীক্ষè ব্যথা, যা কামড়ানো সময় ঘটে বা কামড়ের চাপ ছেড়ে দিলে মুক্তি হয়। দাঁতের একটি ফ্র্যাকচার এনামেল ডেন্টিন এবং মজ্জা জড়িত থাকতে পারে। ভাঙ্গা বা ফাটা দাঁত ডেন্টিন হাইপারসেনসিটিভিটি, পালপাইটিস বা পেরিওডন্টাল ব্যথাসহ বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়াতে ব্যথা সৃষ্টি হয়।
প্রতিরোধ : যেহেতু বেশির ভাগ দাঁতে ক্ষয় এবং পেরিওডন্টাল রোগের মতো প্লাগজনিত রোগে, ক্যারিয়োজেনি ডায়েট এড়ানো এবং ভালো মৌখিক স্বাস্থ্যবিধি মানলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা যেতে পারে। দৈনিক চিনি খাওয়া কমিয়ে এবং দিনে দুবার ফ্লোরাইড যুক্ত মাজন দিয়ে দাঁত মাজলে এবং দুই দাঁতের মধ্যবর্তী স্থান পরিষ্কার রাখলে। এছাড়াও শিশুদের দাঁতের সুরক্ষায় নিয়মিত ব্রাশ করতে বাধ্য করতে হবে এবং বিভিন্ন চকলেট, আচার ইত্যাদি খাওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। বয়স্কদের দাঁতের সুরক্ষায় পান, সিগারেট, গুল ইত্যাদি তামাক-জাতীয় দ্রব্য পরিহার করতে হবে। অতিরিক্ত ঠা-া বা গরম জাতীয় কিছু খাওয়া যাবে না।
দাঁত ব্যথায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা : হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা হচ্ছে লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা। কোন্ লক্ষণে কি কি ওষুধ বা একেক রকম লক্ষণে একক রকম ওষুধ নির্বাচন করে চিকিৎসা দেয়া হয়। যা উপযুক্ত উপায়ে সেবনে রোগ থেকে চিরমুক্তি করা সম্ভব। কথায় আছে ‘দাঁত গেলে তো ভাত গেলো’। তার মানে দাঁত ব্যথায় দাঁত ফেলে দেয়া কখনোই উচিত নয়। সঠিক উপায়ে ওষুধ সেবনে অবশ্যই আরোগ্য হবেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দাঁত ব্যথার কয়েকটি ওষুধ উল্লেখযোগ্য। যেমন :-প্লান্টাগো, মার্কুরিয়াস সল্ব, ব্রাইওনিয়া, কফিয়া, ক্যামোমিলা, নেট্রাম সালফ, পালসেটিলা, লাইকোপোডিয়াম, রডোডেন্ড্রন, ফাইটোলক্কা, এন্টিমক্রুড, হেক্লালাভা, ক্রিয়োজোট, স্টাফিসেগ্রিয়া, টিউবারকুলিনাম ইত্যাদি। তবে এগুলো অবশ্যই লক্ষণভেদে সেবন করতে হবে। তাই একজন রেজিস্ট্রার্ডকৃত অভিজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেবন করা উচিত।
* দাঁত ক্ষয় এবং দাঁতের ব্যথার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সুমেরীয় মাটি ট্যাবলেটে। যা এখন ‘লিজেন্ড অব দা ওর্ম’ হিসেবে পরিচিত। এটি কিউনিফোর্মে রচিত হয়েছিলো, যা ইফ্রেটিস উপত্যকা থেকে উদ্ধার হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর পূর্বে। অনুমান অনুসারে প্রাচীন মিশরীয়রা অনেক দাঁত পরিধান করতো। কারণ তাদের রুটিতে মরুভূমির বাতাসে প্রচুর বালুকণা মিশে যেতো। প্রাচীন মিশরীয়রাও দাঁত ব্যথা রোধ করতে তাবিজ পরতেন। যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ১২ শতাংশ লোক দাঁত ব্যথায় আক্রান্ত। ১৮-৩৪ বছর বয়সী ব্যক্তিরা পঁচাত্তোর্ধ্ব বয়সের তুলনায় দাঁতে ব্যথার হারকে অনেক বেশ বলে প্রতিবেদনে বলেছে। দাঁতের ট্রমা অতিসাধারণ এবং বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের মধ্যে প্রায়শই ঘটে। দাঁত যে কোনো বয়সে, যে কোনো লিঙ্গ এবং যে কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলে হতে পারে। দাঁত আপনার শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটিকে অবহেলা করবেন না। কথায় আছে, ‘যার মাথা তার ব্যথা’ অর্থাৎ যার দাঁত ব্যথায় আক্রান্ত সে বুঝে এটি কত মারাত্মক। তাই নিয়মিত দাঁতের যতœ নিবেন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
ডাঃ মোঃ মাজহারুল হক : ডি.এইচ.এম.এস. (বি.এইচ.বি.) ঢাকা, ডি.ইউ.এম.এস. (কন্ট), এম.এইচ.জি. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
ইসলামিয়া হোমিও হল, চাঁদপুর সদর। মোবাইল ফোন : ০১৯২২৪৯২৬২৪
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখাসহ স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কোনো প্রশ্ন পাঠান।
ই-মেইল : রহঃড়.ধষধসরহ@মসধরষ.পড়স