বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

(দ্বিতীয় খণ্ড) প্রায় পৌনে দু’শো বছর ধরে বাংলা ভূখণ্ড ছিলো ব্রিটেনের উপনিবেশ। সেই ঔপনিবেশিকতার কুফল আমাদেরকে আজও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার লক্ষণগুলোর একটি হলো লাল ভবন। কিছু কিছু সরকারি ভবনের রং আজও দ্রষ্টব্যপূর্ণভাবেই লাল। এই লাল বর্ণ কোন বিপদ সংকেতজ্ঞাপক লাল নয়। কিংবা সিঁদুরের শুভ চিহ্নেরও লাল নয়। এটা হলো মূলত বনেদীয়ানা বা প্রভুত্ববোধ সৃষ্টির লাল বর্ণের প্রজ্ঞাপন। ব্রিটিশদের তৈরি কালুরঘাট সেতু, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন, পরির পাহাড়ের উপর নির্মিত লাল আদালত ভবন, রংমহল পাহাড়ের উপর নির্মিত আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয় এগুলো সবই সেই প্রভুত্ববোধ সৃষ্টিকারী লাল বর্ণের ভবন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ভবনও ঠিক সেই লাল বর্ণের দ্বিতল ভবন যা ঊনিশশো পঁচিশ সালে ডবলমুরিং থানার আইস ফ্যাক্টরি রোডের দক্ষিণ পাশে নির্মিত হয়। এই ভবন দেখলেই ‘সোনালী কাবিন’-এর কবি আল মাহমুদের কবিতার সেই চরণটি মনে পড়ে যায়, ‘পাথরঘাটার গীর্জাটা কি লাল পাথরের ঢেউ?’ ঔপনিবেশিক অবয়বে ঋজুভাবে ‘ই’ আকৃতিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই অযত্নসম্ভূত দীর্ণ-জীর্ণ ভবনটিই পরবর্তী তিন বছরের জন্যে হয়ে যায় আমার জ্ঞান-গর্ভধারিণী। এই স্কুলটি আঠারোশ ছত্রিশ সালে চট্টগ্রাম জিলা স্কুল নামে বর্তমান চট্টগ্রাম কলেজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ঊনিশশো পঁচিশ সালে বর্তমান স্থানে দ্বিতল লাল ভবন হিসেবে রূপ লাভ করে এবং কলেজিয়েট স্কুল নাম ধারণ করে। স্কুলের মটো ছিলো ‘ট্রুথ শ্যাল প্রিভেইল’। ক্লাস এইটে উঠে ফেব্রুয়ারি মাসে আমার অভিষেক ঘটে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। মাসের মাঝামাঝি ক্লাসে অভিষিক্ত হলেও আমার নাম কাগজে-কলমে অন্তর্ভুক্ত হতে সময় লেগে যায় মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি। নিয়মণ্ডকানুনের মারপ্যাঁচে কালেকশান ডেট না আসা অবধি আমার কাছ থেকে কোনো ভর্তি ফিস আদায় করা হয়নি। ফলে ঊনিশশো সাতাশি সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থেই আমার কোনো স্কুল ছিলো না। অবশেষে মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমার নাম স্কুলের হাজিরা খাতায় বাষট্টি নাম্বার রোল নাম্বারের বিপরীতে ওঠানো হয়।

সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুল থেকে কলেজিয়েট স্কুলে আসার পার্থক্যটা মনে হোলো বিস্তর। সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলের পরিবেশ ছিলো পরিপাটি। ছাত্রদের ইউনিফর্ম থেকে শুরু করে শিক্ষকদের চলন-বলন-বসন-ভূষণ সবকিছুই টিপটপ এবং আধুনিক। কিন্তু কলেজিয়েট স্কুলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সাদা ইনিফর্মে মলিনতা ছিলো। শিক্ষকদের অনেকের পোশাকেও সেরকম পরিচ্ছন্নতা খুব একটা ছিলো না। পাঠদানে ইংরেজি-বাংলা উচ্চারণেও আকাশ-পাতাল ব্যবধান। প্রথম প্রথম নিজেকে একটু আফসোস করতে হলো। কেন স্কুল পাল্টালাম। এখানে কোন হল রুম নেই যা সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে ছিলো। সেখানে বেশ কয়েকটা টেবিল টেনিস বোর্ড ছিলো, কাঠের এবং সিমেন্টের। ছিলো বাস্কেটবল কোর্ট। কিন্তু কলেজিয়েট স্কুলে সেগুলোর কোনোটাই ছিলো না। ফলে মন টেকানো কষ্ট হতে লাগলো। টিফিন টাইমে যা টিফিন দিতো তাতে পেট ভরতো না। বরং ক্ষুধা আরও লেগে যেতো বেশি। কেননা, সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত স্কুল ছিলো। কিন্তু কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস হতো সকাল ১১টা হতে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। দুপুর দেড়টায় টিফিন ছুটি হলে সে সময় একটা সিঙ্গাড়া দিয়ে কি পেটের আগুন নেভানো যেত? কিংবা কখনো একটা প্যাটিস না হলে বাটারবান আর তা না হলে সন্দেশ। ক্লাস এইটের বাড়ন্ত দেহে তখন দরকার ছিল ভাতের। কিন্তু তার পরিবর্তে বড় ক্ষুধার ছোট সমাধান মোটেই পছন্দ হলো না। যেদিন সন্দেশ দিতো টিফিনে, সেদিন টিফিন বিলাতো শান্তনু। সন্দেশ তার খুব প্রিয় ছিলো। বাটারবান যেদিন দিতো সেদিন আরাফাত টিফিন বিলাতো। সবাই জানতো আরাফাতের বাটারবান খুব পছন্দের ছিলো। আর যখন সিঙ্গাড়া দিতো টিফিনে, তখন আমি টিফিন বিলাতাম। ক্লাস নাইনে উঠে ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পেয়ে আমি মাঝে মাঝে আজিজ স্যারের ভাগের টিফিন উপহার পেতাম। তিনি সিঙ্গাড়া দিলে খেতেন না, আমাকে দিয়ে দিতেন।

স্কুল পরিবর্তন করায় আমি কলেজিয়েট স্কুলে ডে শিফটে ‘এ’ সেকশানে তালিকাভুক্ত হই। আমার ক্লাস টিচার ছিলেন আহমদ হোসেন স্যার। তিনি অবশ্য পরে নাকি পীর টাইপের হয়ে যান। সে সময় তিনি আমাদের ইংরেজি প্রথম পত্রের ক্লাস নিতেন। আমি কলেজিয়েট স্কুলে যাওয়ার আগে অবশ্য আমার দুই বন্ধু সৌরিন এবং শান্তনু আমার জন্যে পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিলো। সৌরিন যায় সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুল ছেড়ে ক্লাস সিক্সে উঠার পর। সে দিবা শাখায় ক্লাস সিক্স ‘বি’ সেকশানে সুযোগ পায়। এরপর ক্লাস সেভেনে যায় শান্তনু। সে দিবা শাখায় সেভেন ‘এ’ সেকশানে ভর্তি হয়। আর আমি ক্লাস এইটে উঠার পর ‘এ’ সেকশনে ভর্তি হই। আগে থেকে অন্য ছাত্ররা আমার সম্পর্কে জানতে পারার কারণে আমার অভ্যর্থনাটা বেশ ভালোই হয়। প্রথমদিন প্রথম ক্লাসে ক্লাস টিচার ইংরেজি প্রথম পত্রে ইংলিশ ফর টু ডে পড়াতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, Parson আর Person -এর পার্থক্য কী। আগের ছাত্রদের কেউ উত্তর দিতে না পারায় নতুন আমি ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলাম, যেটা ‘এ’ দিয়ে বানান সেটার অর্থ হলো গীর্জার পাদ্রী। আর যেটা ‘ই’ দিয়ে বানান সেটার অর্থ ব্যক্তি বা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে পুরুষ। আমার উত্তর শুনে স্যারে বলেছিলেন, হ! তুইত পারবিই। তুই না পাদ্রীগো স্কুলেত্থন আইছস্। ওনার কথার ধরণে সারা ক্লাস হেসে উঠলো। আমি একটু বিড়ম্বিত হয়ে পড়লাম। তবে তার চেয়েও বড় বিড়ম্বনা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। যখন আমার রোল নম্বর নির্ধারিত হলো এবং নাম ডাকতো তখন প্রথম দিন আমি রোল নম্বর এক ডাকার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে প্রেজেন্ট স্যার বলে উঠি। অথচ ওই সময় রোল নম্বর এক ছিলো শান-এ-খুদার। তার সাথে আমি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সবাই শোরগোল করা শুরু করলো। পরে শান্তনু উঠে দাঁড়িয়ে বললো, স্যার এটা ওর দীর্ঘ আট বছরের অভ্যাস। ও সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে ক্লাস এইটের ফেব্রুয়ারির অর্ধ মাস পর্যন্ত ফার্স্ট বয় হিসেবে রোল কলে হাজিরা দিয়েছে। তখন ক্লাস টিচার আমাকে বললেন, তুই একটা বছর ধৈর্য ধর। তারপর তোর স্থান তুই আবার ফিরে পাবি।

ক্লাসের টিফিন ছুটি হলে সবাই আমাকে নিয়ে খেলার মাঠে যায়। আমি আমার সে সময়কার খেলোয়াড়ি উদ্যম দিয়ে বন্ধুদের মন জয় করি। সেদিনের সেই নৈপুণ্য আমাকে পরবর্তী সময়ে ক্রীড়া শিক্ষক ওয়াহিদ স্যারের নজরে নিয়ে আসে এবং তিনি আমাকে স্কুল টিমের জন্যে বেছে রাখেন। টিফিনের পরে আবার ক্লাস শুরু হয়। আমাদের সেই পিরিয়ড ছিলো পৌরনীতি। ক্লাস এইটের পৌরনীতি পড়াতেন যিনি তিনি বারান্দা দিয়ে আসতে শুরু করেছেন। এমন সময় পেছন থেকে কেউ একজন একটা বিশেষ প্রাণীর মত আওয়াজ দিতে শুরু করলো। সাথে সাথে মনে হয় সারা ক্লাস এ আওয়াজের কোরাস ধরলো। আমি কিছু বুঝার আগেই দেখলাম স্যার ক্লাসে ঢুকে পিছন থেকে মার শুরু করলেন বেত দিয়ে। মারের সাথে সাথে জেরাও চললো, বল, তোরা কে কে এই ডাক দিছস্। তখন কি আর কেউ বলে! ক্লাসে স্যার বেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি ক্রুদ্ধ অবস্থায় আগের দিনের পড়া ধরলেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের কাজ কী? সৌভাগ্যবশত এই অধ্যায় আমার আগের স্কুলে পড়া হয়ে গিয়েছিলো। আমি পটাপট বলা শুরু করলাম। বইতে একটা তথ্য ছিলো না, কিন্তু সেটা আমি আগের রাতে পেপার পড়তে গিয়ে পাই। সেই তথ্যটা ছিলো, ‘বর্তমানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্য সংখ্যা একশ বিরাশি জন।’ স্যারে আমার এই তথ্যটা গ্রহণ না করে ভর্ৎসনা করলেন। বুঝলাম, স্যারের ক্ষোভ তখনও প্রশমিত হয়নি। পৌরনীতির ক্লাসের শেষে বন্ধুরা সবাই আমাকে খোলাসা করলো।

ধীরে ধীরে টের পেলাম, লেজওয়ালা ছাত্র কাদেরকে বলে। প্রতিটা স্যারের একটা করে পেট নেম আছে। এবং এই নাম যে কারা প্রথম চালু করেছিলো তা বের করা বেশ গবেষণার বিষয়। বিচিত্র সেসব নাম। প্রাণীর নাম থেকে শুরু করে লাল বিস্কুট, চোঙ্গা, বোতল, কেরোসিন ইত্যাদি সব নাম। সব স্যারেরাও জানেন, তাঁকে ছাত্ররা আড়ালে কী নামে ডাকে। দেখতে দেখতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা বা ষান্মাসিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। তখনও পর্যন্ত একটা রেওয়াজ চালু ছিলো। যে বিষয়ে যিনি প্রশ্ন করবেন তিনিই খাতা মূল্যায়ন করবেন। এটাকে যে কেন খাতা কাটা বলে তা আজও আমার বোধগম্য নয়। ষান্মাসিক পরীক্ষা বেশ ভালোই হলো। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। সব বিষয়ে আমি সর্বোচ্চ নম্বর পেলাম। কিন্তু আমার ক্লাস যাঁরা পেতেন তাঁরা ছাড়া মর্নিং শিফটের সব টিচারের কাছে আমার ডাক পড়লো। প্রথম ডাকলেন বাংলা প্রথম পত্রের হামিদা বানু ম্যাডাম। আমার খাতায় দেখলাম প্রথমে পেন্সিলে লেখা ছিলো আটষট্টি। এরপর আবার সেটাকে কেটে চৌষট্টি করা হলো এবং তাতে ম্যাডামের স্বাক্ষর করা। তিনি আরাফাতের মাধ্যমে আমাকে ডাক পাঠালেন। আমি আরাফাতসহ তাঁর সাথে দেখা করলাম। তিনি আরাফাতের মুখে আমার পরিচয় পাওয়ার পর বললেন, দেখো বাবা, আমি তো বাষট্টি রোল নম্বর দেখে ভাবলাম, পেছনের বেঞ্চের ছেলে, বোধ হয় নকল করে লিখেছে। তাই নাম্বার আটষট্টি উঠে গেলো দেখে কমাতে শুরু করলাম। ক্লাসের তৎকালীন ফার্স্ট বয় শান-এ-খুদা পেয়েছে বাষট্টি। আর আমি আটষট্টি। চার কমিয়ে নেওয়ার পরও আমার নম্বর হয় চৌষট্টি। ম্যাডাম দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, এবার তো আমি তোমাকে না চেনার কারণে নম্বর কমিয়ে দিয়েছি। আশা করি পরেরবার আর তা হবে না। একই ঘটনা ঘটল ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের ‘বিদ্যুৎ-এর কাজ’ বিষয়ের ক্ষেত্রেও। আমাদের মোখলেছুর রহমান স্যার প্রথমে খাতা মূল্যায়ন করে আমাকে চুরাশি নম্বর দেন এবং তা পেন্সিলে খাতার উপর লিপিবদ্ধ করে রাখেন। পরে রোল নম্বর বাষট্টি হওয়ার কারণে তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। অতঃপর সেই নম্বর কাটতে কাটতে আশি নম্বরে এসে থিতু হয়। স্যার আমাকে বললেন, বড়ুয়া, বার্ষিক পরীক্ষায় তোমার নম্বর আর কাটবো না। এতো কিছু করার পরও সকল বিষয়ে আমার সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্তি ঠেকানো গেলো না। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাতেই আমি প্রথম হয়ে গেলাম।

একদিকে ক্লাসে প্রথম হয়ে শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র হয়ে গেলাম আর অন্যদিকে খেলার মাঠে আমি হলাম একদলের ক্যাপ্টেন আর বন্ধু নূরুল হুদা ছিলো অন্য দলের ক্যাপ্টেন। নূরুল হুদাকে সবাই সংক্ষেপে নূরানী নামে ডাকতো। ক্রমে ক্রমে সময় গত হলো। এরমধ্যে এইটের বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং শুরু হলো। এইটের বৃত্তি পরীক্ষার কোচিংয়ে বাংলা দ্বিতীয়পত্র পড়াতেন পণ্ডিত স্যার। পণ্ডিত স্যারের নাম ছিলো অমলেন্দু চক্রবর্তী। তিনি এমনিতে আমাদের কোন ক্লাস পেতেন না। তাঁর ব্যাকরণ ক্লাস আমার জীবনের এক অনন্য প্রাপ্তি। যদিও ধর্ম ক্লাস নেওয়ার কারণে তিনি সৌরিন-শান্তনুকে আগে থেকে চিনতেন এবং স্নেহ করতেন, তবুও আমি তাঁর স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলাম না। পণ্ডিত স্যার মন ভালো থাকলে মাঝে মাঝে নিজের কথা বলতেন। তিনি নাটক করতেন। তাঁর বাড়ি মনে হয় নোয়াখালীর সেনবাগে ছিলো। ক্লাসে তিনি প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয়, ধাতু চিনবার সহজ উপায় ইত্যাদি বিষয়গুলো এতো সহজে পড়াতেন যে, তা জলবৎ তরলং হয়ে উঠতো। পণ্ডিত স্যার একদিন দ্বিত্ব শব্দ সম্পর্কে পড়াতে গিয়ে মজার একটা চুটকি বলেছিলেন। কোন এক ছাত্র তার শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলে, স্যার পড়া-টরা, বই-টই এগুলো কারা বলে? স্যারে নাকি তখন উত্তর দিয়েছিলেন তাকে, এই ধর যারা ছোটলোক-টোটলোক তারাই এমন দ্বিত্ব শব্দ উচ্চারণ করে। পণ্ডিত স্যারের এই কথা যারা বুঝতে পেরেছিলো তারা হেসে দিয়েছিলো সশব্দে। কোচিং ক্লাসে জ্যামিতি পড়াতেন জহিরুল হক স্যার। আমাকে জ্যামিতি বিষয়ে প্রায় গবেষক বানিয়ে ছেড়েছিলেন তিনি। একটা জ্যামিতির এক্সট্রা কত কম স্টেপে করা যায় তা নিয়ে স্যারের সাথে আমার যেন দ্রোণাচার্য-অর্জুনের মতো সময় কাটতো। একসময় কোচিং ক্লাসের চূড়ান্ত বাছাই পরীক্ষা হয়ে গেল। মোট চারশ নাম্বারের পরীক্ষা। আমি দুশ ছিয়াশি নম্বর পেয়ে প্রথম হলাম। দুশ বাহাত্তর নম্বর পেয়ে শান্তনু হলো দ্বিতীয়। এই ফলাফল পুরো স্কুলকে নাড়িয়ে দিলো। একজন ছাত্র যে কিনা ক্লাস এইটে সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুল থেকে এসে ভর্তি হয়েছে, সে হয়ে গেল কলেজিয়েট স্কুলের মর্নিং-ডে মিলিয়ে দুই শিফটের চার শাখার দুশ আশি জন ছাত্রের মধ্যে ফার্স্ট! ডে শিফটের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার ছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার। তিনি আমাদের পৌরনীতি পড়াতেন। তিনি একদিন ক্লাসে এ বিষয়টি বলেই ফেললেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। তিনি জানতেন, কলেজিয়েট স্কুলের দুশ আশি জন ছাত্রের মধ্যে যে প্রথম হয় সে কেবল ছয়-সাত মাসের পড়া দিয়ে প্রথম হতে পারবে না। অর্থাৎ সে আগে থেকেই ভালো শিক্ষা পেয়েছে, যার জন্যে কলেজিয়েট স্কুলের বর্তমান চার সেকশনের ফার্স্ট বয়কে হারানো সম্ভব হয়েছে। সেই আলোড়ন বৃত্তি পরীক্ষার ফাইনালেও বলবৎ থাকলো। আমি হয়ে গেলাম গোটা চট্টগ্রাম বিভাগে ট্যালেন্টপুলে প্রথম। এবার আর আমি বহিরাগত নই। এবার আমি কলেজিয়েট স্কুলেরই একজন। আমার এই প্রথম হওয়ার কারণে আমার বড়দা মধ্যপ্রাচ্য থেকে একটা স্বর্ণের চেইন পাঠালেন। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার চূড়ান্ত বাছাইয়ের খাতায় পণ্ডিত স্যার আমার একটা কারক-বিভক্তি নির্ণয়ে লাল কালির দাগ দিয়ে অর্ধেক নম্বর কেটে নিয়েছিলেন। আমার বাবা তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফার্স্ট বয়ের খাতাতে লাল দাগ পড়বে কেন? বাবার এই অসন্তুষ্টি আমাকে আরো মনোযোগী করে তুলেছিলো। আমার বাসার স্যার সমরেশ চক্রবর্তী তিনিও একদিন আমার জিদ উঠিয়ে দিয়েছিলেন। একটা বাংলা রচনা ভালো হয়নি বলে তিনি আমাকে দিয়ে তিনবার লিখিয়েছিলেন। আমি তখনও নিজের রচনা নিজের ভাষাতেই লিখতাম। একটা রচনার ভূমিকা তিনবার তিনরকম করে লেখার পর তিনি তৃতীয় বারেরটা মনোনীত করেছিলেন। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, একজন ভালো শিক্ষক তাঁর প্রিয় শিক্ষার্থীর মধ্যে ভালো করার তাগিদ ও জিদ তৈরি করে দেন।

আমাদের বৃত্তি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিলো নাসিরাবাদ সরকারি বালক বিদ্যালয়। তখন স্কুলের উল্টোদিকে বাঁশ-বেতের আসবাবপত্রের দোকান ছিলো। পরে অবশ্য ঐ এলাকা আমার কাছে নিত্যকর্মের অংশ হয়ে যায়। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন আমি এখানে ক্ল্যাসিক কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতাম।ক্লাস নাইনে উঠে আমরা পেলাম কাদের স্যারকে আমাদের ক্লাস টিচার হিসেবে। তাঁর হাতে একটা চিকন বেত থাকতো। ইংরেজি ফার্স্ট পেপারের স্ট্রাকচার তিনি ভালো পড়াতেন। ক্লাস নাইনে এবার রোল নং এক-এর হাজিরায় আমি বৈধভাবে দাঁড়িয়ে প্রেজেন্ট স্যার বলতে পারি। এ সময় আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান পরিষদ গঠিত হয়। স্যাররা 'বি' সেকশনের ফার্স্ট বয় ইব্রাহিমকে সভাপতি আর আমাকে সাধারণ সম্পাদক বানিয়ে দেন। যদিও আমরা কোন প্রজেক্ট বানাইনি। তবে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে আমি ও সৌরিন উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি এবং দুজনেই পুরস্কৃত হই। আমি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। মৌসুমী শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় আমি, সৌরিন ও শান্তনু বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি। আমাদের দল কোন মেন্টর ছাড়াই তৃতীয় হয়। দেয়ালিকা প্রতিযোগিতায় স্কুলের দেয়ালিকার সম্পাদক বানানো হয় আমাকে। আমাদের অংকন শিক্ষক প্রদীপ স্যার একটা বড় বটগাছ এঁকে দেন একটা বড় আর্ট পেপারে। এরপর তাতে পাটি কেটে কেটে লাগিয়ে নকশা করে দেন। আমি নিজে লেখাগুলো লিপিবদ্ধ করি। সেই থেকেই আমার সম্পাদকীয় লেখা শুরু। তবে এর আগে সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে থাকতে ক্লাস সিক্সেও দেয়ালিকা সম্পাদনা করেছি। তখন সহযোগিতা করেছিলেন আমাদের ড্রইং টিচার বাণী ভট্টাচার্য।

ক্লাস নাইনে একটা মজার ঘটনা ঘটে। রহমতগঞ্জের কেবি আব্দুস সাত্তার রোডে অবস্থিত নবীন মেলা চালাতেন জামাল ভাই। শিশু-কিশোর-তরুণদের শরীর ও মনের গঠন ও বিকাশে তিনি এক নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। সেই সংগঠনের আয়োজনে আমি অনেকবার দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি। মাঝে মাঝে তাদের টেবিল টেনিস বোর্ডেও অনুশীলন করতাম। কাজীর দেউড়ি ফ্রেন্ডস ক্লাবেও আমরা অনেকদিন টেবিল টেনিস অনুশীলন করেছি। বিকেলে আমরা খেলতাম আর রাতে খেলতেন বড়রা। আমি, আমার ক্লাসের শামসুল আরেফিন রুমি এবং আমাদের স্কুলের আহসানসহ আরো অনেকেই একসাথে খেলতাম। নবীন মেলার আয়োজনে রাইফেলস্ ক্লাবে টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টের আয়োজন হলো। টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট সাধারণত সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একটানা হতো। স্কুল খোলার দিন ঐ প্রতিযোগিতা হওয়ার কারণে আমি সেদিন স্কুলে যেতে পারিনি। আমার মা জানতেন, আমি সেদিন রাইফেলস্ ক্লাবে টেবিল টেনিস খেলবো। ডাবলসে আমার জুটি ছিলো আহসান। তাকে জামাল ভাই ডাকতেন তিব্বতী বলে। তার চেহারায় পার্বত্য সুষমা বিরাজ করতো। নামটা তার মুখশ্রীর সাথে সুন্দর খাপ খেয়ে যায়। পরদিন স্কুলে গেলে কাদের স্যার রুমিকে রোল কল করার সময় জিজ্ঞেস করেন, তুই স্কুলে আসিসনি কেন? জবাবে রুমি বলেছিলো, স্যার, কালকে রাইফেলস্ ক্লাবে টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। কাদের স্যার তখন তাকে বললেন, তুই কালকে তোর গার্ডিয়ান আনবি। একথা শোনার সাথে সাথে রুমি বললো, স্যার, গতকাল পীযূষও গিয়েছিলো। রুমি ভেবেছিলো, আমার নাম বললে হয়তো সে মাফ পাবে। কিন্তু স্যার উল্টো আমাকেও গার্ডিয়ান নিয়ে যেতে বললেন। এতে রুমি ভয় পেয়ে গেলো, আমি না তার ওপর রেগে যাই। কিন্তু পরেরদিন আর গার্ডিয়ান নিতে হয়নি। আমি স্যারকে বলেছিলাম, স্যার, আমি আমার মায়ের অনুমতি নিয়েই খেলতে গিয়েছি। স্যার আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে সেই দফায় আর আগাননি। ক্লাস নাইনে আরো একটা ঘটনা ঘটে। স্কুলের আন্তঃশ্রেণি ফুটবল খেলা শুরু হয়। আমাদের খেলা পড়লো ক্লাস টেন 'এ' শাখার বিরুদ্ধে। তাদের দলে একটু পেশীশক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা বেশি ছিলো। আমাদের দল তাদেরকে অন্তিম মুহূর্তের ঠিক আগে একটা গোল দেয়। পাসটা পাপ্পুকে ওদের ডি-বক্সে আমি বাড়িয়ে দেই। পাপ্পু সেই পাসে বলকে ওদের জালে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের গোলকিপার ছিলো টর্নেডো। মানে আশরাফুল। ওর পেট নেম ছিলো টর্নেডো। ব্যাকেও শক্ত লোক ছিলো। তানভীর জহির এবং রোল ছেষট্টি, নাম সম্ভবত আবুল হাসান। আরো ছিলো বেলাল। এক গোলে হেরে গিয়ে ক্লাস টেনের ছেলেরা আমাদের মারার জন্যে ধাওয়া করা শুরু করলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলো সদরঘাট এলাকার বিশেষ মারকুটে মহল্লার ছেলে। তাদের দেখে বুঝাই যাচ্ছিল তারা মারামারির জন্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলো। আমরা যে যেদিকে পারি ছুট লাগালাম। আমি মাদারবাড়ি এলাকার দিকে দেওয়াল লাফিয়ে টপকে মাঠ পার হই। তারপর রিকশায় চড়ে নিমেষেই বাসায়।

ক্লাস নাইনে পড়াকালীন পাথরঘাটা পাঁচবাড়ি এলাকার পক্ষ থেকে আমাদের একটা ক্রিকেট দল গঠিত হয়, যাদের কোচিং করাতেন এ ডিভিশনের ইয়ং স্টার ক্রিকেট টিমের খেলোয়াড় সুলতান ভাই। আমরা সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলের মাঠে প্র্যাকটিস করতাম। এই মাঠটাকে গীর্জা স্কুলের মাঠ বলতো সবাই। আমাকে ঐ দলের ক্যাপ্টেন বানানো হলো। আমি ফিল্ডিং করতাম স্লিপে। আমাদের কিপার ছিলো সৌরিন। তাকে আমরা পল ডাউনটন বলেই ডাকতাম। আমাদের সিনিয়র ইফতেখার ভাই, যিনি নিজেও ভালো ক্রিকেট খেলতেন, তিনি আমাকে কাট করতে দেখে বলতেন, সাবাশ গাভাস্কার। আমাদের টিমে জয়জিৎ চৌধুরী ভালো পেস বোলিং করতো।

ক্লাস নাইন পার হয়ে ক্লাস টেন-এ এসে আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি অর্জিত হয়। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় আমি উপস্থিত রচনা লেখা বিষয়ে থানা পর্যায়ে প্রথম, জেলা পর্যায়ে প্রথম, বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করি। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে। আমার নাম প্রথম স্থান অর্জনকারী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে আমার সাথে উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রভাত ও তার মাসী উল্লসিত হয়ে উঠে। পরেরদিন আমাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। পুরস্কার দিবেন তৎকালীন ফার্স্ট লেডি বেগম রওশন এরশাদ। পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানের একটা মহড়া হয়ে গেল সকালে। বিকেলে আমরা বেগম রওশন এরশাদের কাছ থেকে মেডেল ও সনদ গ্রহণ করি। তখন আজকের মতো ছবি তোলা সহজ ছিল না। তাই সেই ছবি আমার সংগ্রহে নেই। মনে আছে, বড়দের বিভাগে বরিশাল বিএল কলেজের দিব্যেন্দু নামে একজন বিজয়ী হয়েছিলেন। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আমার অভিভাবক হিসেবে আমার মেঝ মামী উপস্থিত ছিলেন। আমি ঢাকায় এই দুদিন তাঁর কাছেই ছিলাম। আসার পথে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আমার পিসির জামাইয়ের কাছে ছিলাম একদিন। তিনি আমাকে রেল স্টেশনের রেস্তোরাঁয় বাঁধাকপির পাকৌরা খাইয়েছিলেন। তখন হেমন্তের মৃদু শীতে সেই পাকৌরাকে মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সেরা মচমচে আর সুস্বাদু খাবার। ক্লাস টেনের এক সদ্য কৈশোরসিক্ত ছেলের কাছে সেই কয়েকটা দিন ছিল হিলারী-তেনজিংয়ের এভারেস্ট বিজয়ের মতোই রোমাঞ্চকর। কারণ সেই প্রথম কোন অভিভাবক ছাড়াই আমি একা একা ঢাকায় চলে যাই স্টেশনে পিসির জামাই আছেন সেই বলে বলীয়ান হয়ে। সাথে অবশ্য চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রতিযোগী ও তাদের অভিভাবকেরা ছিলেন।

ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষার ফলাফলে একটা বিপর্যয় দেখা দেয়। প্রভাতী ও দিবা শাখার চার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমাকে দেখান হলো চতুর্থ। এ ফলাফল আমি মেনে নেওয়ার আগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আমার গৃহশিক্ষক সমরেশ স্যার। আমার বাবা-মাকে বলে তিনিই আমার সাথে চললেন স্কুলে হেড স্যারের কাছে। সমরেশ স্যার গিয়ে হেড স্যারকে বললেন, পীযূষের এই ফলাফল আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। দয়া করে ওর নাম্বারের টেবুলেশন শীট আবার চেক করা হোক। যেহেতু হেড স্যার নিজেও সন্তুষ্ট নন এই ফলাফলে, তিনি টেবুলেশন শীটসহ আমার ক্লাস টিচার এবং অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ডাকালেন। টেবুলেশন শীট মেলে ধরতেই বের হয়ে আসলো থলের বেড়াল। আমার বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র মিলে টেবুলেশন শীটে লিপিবদ্ধ আছে একশ তেত্রিশ। কিন্তু আমার নম্বর ফর্দে তা তোলা হলো একশ তের। কুড়ি নম্বরের ব্যবধান! এই ঘটনা দেখে সব স্যারের মুখ কালো হয়ে গেলো। হেসে উঠলেন আমার গৃহশিক্ষক সমরেশ স্যার আর আমার হেড স্যার আব্দুল খালেক। আমি হয়ে গেলাম স্কুলের ফার্স্ট বয়, যা আমার প্রকৃতই প্রাপ্য। আমার ক্লাস টিচার বললেন, এই ফলাফল কিছুই নয়, আসল পরীক্ষায় এই ফলাফল ধরে রাখতে হবে। আর যেহেতু টেস্ট পরীক্ষার পর ছাত্ররা ক্লাসে আসার সুযোগ নাই, তাই নম্বর ফর্দ সংশোধন করে তা কার্যকর করা সম্ভব নয়। তবে টেবুলেশন শীটে আমাকে প্রথম বলে লেখা হলো।

আমার এই কপাল আমাকে পদে পদে ভুগিয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার রোল নম্বর ছিলো নয়শ উনিশ। আমাদের কেন্দ্র ছিলো সিটি মহিলা স্কুল, আইস ফ্যাক্টরি রোডে। প্রথম দুদিন দুই পেপার করে পরীক্ষা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে পরীক্ষা হয় মে মাসে। স্ট্যান্ডার্ড কালির দোয়াত আর দুটো হিরো কলম নিয়ে পরীক্ষার হলে যাই। মা টিফিন নিয়ে যেতেন। আমাদের হলে সবাই ছিলো কলেজিয়েট স্কুলের পরীক্ষার্থী। আমার আগের বেঞ্চে ছিলো বন্ধু আসিফ। সে টয়লেট সেরে আসার পর তাকে কড়া তল্লাশি লাগালেন ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু কিছুই পাননি। পাওয়ারও কথা নয়। কারণ ঐ রুমে সবাই স্টার মার্কস পাবে তা অবধারিত। তাদের টেস্টের রেজাল্ট এমনই ছিলো। কিন্তু আসিফকে এভাবে তল্লাশি করতে দেখে আমার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলো। কিন্তু আমার হাতের লেখার গতি দ্রুত বিধায় আমাকে কোন বেকায়দায় পড়তে হয়নি। এসএসসি পরীক্ষা শেষে আমার গৃহশিক্ষক সমরেশ স্যার ভূগোলের এক্সামিনার হিসেবে খাতা আনতে গেলেন কুমিল্লা বোর্ডে। যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, যাবি নাকি কুমিল্লা শহর দেখতে? আমি তো খুশিতে ডগমগ। ভোরবেলায় সুবর্ণ এক্সপ্রেসে কুমিল্লা পৌঁছে গেলাম। স্যার খাতা সংগ্রহ করে আমাকে কুমিল্লা বার্ডে বেড়াতে নিয়ে গেলেন। দুপুরে বার্ডে উৎপাদিত সবজি এবং লাল চালের ভাত দিয়ে আমাদের উদরপূর্তি হলো। আসার সময় সেই প্রথম কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইয়ের দেখা পেলাম।

ফলাফলের দিন যতই ঘনিয়ে আসলো ততই আমাদের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে লাগলো। আমাদের বন্ধু শফিক এক এক দিন এক এক কথা বলে। তার নাকি কোন আত্মীয় খবর এনেছে, আমাদের স্কুলের পাঁচজন বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছে। তবে তাদের নাম জানা যায়নি। সৌরিনের কাছে জানা গেলো, আমাদের কোন এক শিক্ষক খবর পেয়েছেন, আমি উচ্চতর গণিতে কুমিল্লা বোর্ডে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছি এবং তার সংখ্যামানে আটানব্বই। কিন্তু ফলাফল পাওয়ার পরে এসব কোন কিছুরই মিল পাওয়া গেল না। আমি উচ্চতর গণিতে পেলাম আটাশি কিন্তু হিসাব মতে আমার আরও দশ বেশি পাওয়ার কথা। ভূগোলে আমাদের কেউই তো লেটার পেলই না বরং আমিই পেলাম সর্বোচ্চ আটষট্টি নম্বর। স্কুলের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড হলো আমাদের ব্যাচে, আমরা সম্মিলিত মেধা তালিকায় সাতজন স্থান পেয়েছি। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, দ্বাদশ, পঞ্চদশ, অষ্টাদশ ও বিংশতিতম। আমি অষ্টম। ঘরে সাংবাদিকরা আসলেন, বাবা-মার সাথে ছবি তুললেন। দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করলেন। কী হতে চাই ভবিষ্যতে, কার অবদান বেশি এই ফলাফলে ইত্যাদি। মাকে দেখলাম, চোখে অশ্রু, বাবাকে দেখলাম, স্মিতহাস্যে মুখর। আমার তবু আফসোস, কেন তিন গণিত আর বিজ্ঞানের পাশাপাশি ভূগোলেও লেটার হলো না। যদি আমাদের স্কুলের এই সাতজন ভূগোলে লেটার পেতো তবে আমরাই হয়ে যেতাম দ্বিতীয়-তৃতীয়। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়