প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
রবীন্দ্রনাথের নদীপ্রেম
নদী যেন কবিগুরুর ভাবের বাহন। তাঁর কবিতায়-গানে নদী যেমন গুরুত্ব পেয়েছে তেমনি তাঁর ব্যক্তি জীবনেও নদী হয়ে উঠেছে মননসখা। নদীর প্রতি অপার প্রেমে তিনি নদীকে ‘ জলের রাণী’ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর গানেই প্রেমের সুরে তিনি বলেছেন,
|আরো খবর
ওগো জলের রাণী,
ঢেউ দিয়ো না, দিয়ো না ঢেউ দিয়ো না গো-
আমি যে ভয় মানি।
কখন্ তুমি শান্তগভীর, কখন্ টলোমলো-
কখন্ আঁখি অধীর হাস্যমদির,কখন্ ছলোছলো-
কিছুই নাহি জানি।
ঠাকুরবাড়ির ছেলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষ্যে আমরা জানতে পারি, জোড়াসাঁকোর নিচ দিয়ে বয়ে যেতো এক নদী। নদীর নাম তার জানা নেই। এই নদীর কলধ্বনিতে শৈশব কাটিয়েছে ঠাকুরবাড়ির রবি।
আঠারোশ একানব্বই থেকে ঊনিশশো একসাল পর্যন্ত মোট দশ বছর তথা রবীন্দ্রনাথের জীবনের ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর সময়টা কেটেছিল বর্তমান বাংলাদেশের নদীমাতৃক অঞ্চলে। পৈত্রিক জমিদারি তদারকির কাজে এসে তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর আর সিরাজগঞ্জের সাজাদপুরে (শাহজাদপুর) কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। এখানে এসেই তিনি প্রেমে পড়েছেন পদ্মার। ‘পদ্মা’ নামক হাউসবোটে চড়ে তিনি পদ্মা নদীর বুকে চষে বেড়িয়েছেন গ্রাম হতে গ্রামান্তরে। পদ্মা ছাড়াও তাঁর ‘চিত্রা’ নামে আরও একটি বোট ছিল। চিত্রা যেমন একটি নদীর নাম তেমনি ‘চিত্রা’ নামে কবির একটি কাব্যগ্রন্থও আছে। এতে ‘চিত্রা’ শিরোনামে একটি কবিতাও আছে, যা নক্ষত্র কি নদী তা রহস্যময় হয়ে রয়েছে। চিত্রা কাব্যগ্রন্থের একটি বিখ্যাত কবিতা হলো ‘দুই বিঘা জমি।’ কবি এতে বলেছেন,
নমো নমো নমঃ, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ‘দুই বিঘা জমি’র এই অংশটুকু বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তিনি প্রায়শই এ কবিতাংশটুকু আবৃত্তি করতেন। বঙ্গবন্ধুর আরেকটা প্রিয় কবিতা হলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এই কবিতার দশ লাইনকে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছেন। এই জাতীয় সঙ্গীতেই আমরা পাই,
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো-
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
অর্থাৎ এখানেও রবীন্দ্রনাথের নদীপ্রেম যথামাধুর্যে উদ্ভাসিত হয়েছে।
কবির ছিন্নপত্রে যেসব নদীর উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলো হলো গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, গড়াই, ইছামতী, বড়াল, নাগর, বলেশ্বর, আত্রাই, হুড়ো সাগর, যমুনা, গোহালা ইত্যাদি। আরও একটি নদীর কথা তিনি বলেছেন। নদীর নাম গুমানী। কী নিয়ে তার গুমান তা জানা যায়নি। গুমানী নদী চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সবচেয়ে গভীর ও বড় নদী। আত্রাই, গুড়নই (গুড় নদী), নন্দকূব্জা, বারণই, গদাই, নাগর, বানগঙ্গা প্রভৃতি নদ-নদীর সম্মিলিত একক প্রবাহ হলো গুমানী। এরা চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একক নদী গুমানীতে পরিণতি লাভ করেছে। ছিন্নপত্রে করতোয়ার অন্যতম প্রধান শাখা নাগর নদেরও কিঞ্চিৎ বর্ণনা দিয়েছেন কবি। ইছামতী নদী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চৈতালি কাব্যে লিখেছেন,
'অয়ি তন্বী ইছামতী, তব তীরে তীরে
শান্তি চিরকাল থাক কুটিরে কুটিরে
শস্যে পূর্ণ হোক তব তটদেশে।
বর্ষে বর্ষে বরষায় আনন্দিত বেশে...’
শিশু ভোলানাথেও তিনি ইছামতী নদীকে নিয়ে দীর্ঘ একটি শিশুতোষ কবিতা লিখেছেন। এই কবিতায় আমরা রবীন্দ্রনাথের মনের কথা জানতে পারি,
যখন যেমন মনে করি
তাই হতে পাই যদি
আমি তবে একখানি হই
ইচ্ছামতী নদী ।
রইবে আমার দখিন ধারে
সূর্য ওঠার পার,
বাঁয়ের ধারে সন্ধ্যেবেলায়
নামবে অন্ধকার ।
রবীন্দ্রনাথের প্রিয় নদী ছিল পদ্মা। তিনি ‘পদ্মা’ কবিতায় লিখেছেন,
‘হে পদ্মা আমার
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার
একদিন জনহীন তোমার পুলিনে
গোধূলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।’
রবীন্দ্রনাথ যে একবার রাতদুপুরে পদ্মা নদীর বুকে ভূতের কবলে পড়েছিলেন তা সুব্রত করের লেখা ‘শিশুদের আসরে রবীন্দ্রনাথ’ হতে জানা যায়। তবে এটা আদৌ সত্যি নাকি গল্প সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যার পরে শিশুদের আসরে এ কাহিনী বলেছিলেন।
একবার কোলকাতা থেকে শিলাইদহে ফেরার পথে কবির দেরি হয়ে যায়। ফলে তিনি সন্ধ্যার ট্রেন ধরতে না পেরে রাতের ট্রেনে কুষ্টিয়া পৌঁছেন। কিš’ শিলাইদহে যেতে হলে পদ্মা পাড়ি দিতে হবে। তাঁর হাউসবোট ‘পদ্মা’ সেদিন দেরির কারণে আর ঘাটে ছিল না। আঁধারময় জনমানবহীন পদ্মার তীরে রবীন্দ্রনাথ একা। হঠাৎ এক পুরনো প্রজা একটা নৌকো নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বললো, আসেন কর্তা, আপনাকে পার করে দিই। জমিদার কবি নৌকায় উঠলে মাঝি তাঁকে বিছানা করে দিলেন। ভোর হতে হতে নৌকো ওপারের তীরে পৌঁছালো। রবীন্দ্রনাথের ঘুম ভাঙলে পরে মাঝি বললো, কর্তা একটু বসুন, আমি এই আসছি। এই বলে মাঝি যে গেল আর তার আসার নাম নেই। এসময় একটু পরে অন্য মাঝিরা এসে জমিদার রবীন্দ্রনাথকে এভাবে দেখে বিস্মিত হলো। তাদের ভাষ্য হতে জানা গেল, গতকাল রাতে ঘাটে কোনো নৌকাই ছিল না আর যে প্রজার কথা বলা হলো সে মারা গিয়েছে দু-তিনমাস হলো। এ কথা শুনে তো রবির গা ছমছম করা শুরু করলো। যাই হোক, পরে রবীন্দ্রনাথকে অন্য একটি নৌকো দিয়ে বাকি পথ পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। কবি অতঃপর নৌকায় উঠে সভয়ে পেছন ফিরে দেখেন, তাঁকে গতরাতে বহনকারী নৌকাটি আর নেই, বেমালুম তা উধাও হয়ে গেছে।
নদী নিয়ে কবির একটি দীর্ঘ কবিতা আছে যা ‘নদী’ কাব্যগ্রšে’ অন্তর্ভুক্ত। তেরশ দুই বঙ্গাব্দের দোসরা মাঘ গ্রন্থাকারে নদী প্রকাশিত হয়। সম্ভবত এর অব্যবহিত পরেই গ্রন্থটির মুদ্রিত পৃষ্ঠার উপর অবনীন্দ্রনাথ প্রচ্ছদ অঙ্কন করেন। ‘নদী’ কবিতায় আমরা পাই-
ওরে তোরা কি জানিস কেউ
জলে কেন ওঠে এত ঢেউ।
ওরা দিবস-রজনী নাচে,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে।
শান্ চলচল্ ছলছল্
.........................................
নদী চিরদিন চিরনিশি
রবে অতল আদরে মিশি।
‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘হে বিরাট নদী’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এলাহাবাদে বসে তেরশ একুশ সালের পৌষে। কবির কাছে রাত্রিই যেন বিরাট এক নদী। তিনি বলেছেন অকপটে,
রাত্রি হে বিরাট নদী,
অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল
অবিচ্ছিন্ন অবিরল
চলে নিরবধি।
এ কবিতাতেই তিনি মন্দাকিনি নদীর উল্লেখ করে বলেছেন,
তব নৃত্যমন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি
তুলিতেছে শুচি করি
মৃত্যুস্নানে বিশ্বের জীবন।
নিঃশেষে নির্মল নীলে বিকাশিছে নিখিল গগন।
পুনশ্চ কাব্যের ‘বাসা’ কবিতায় কবি ময়ূরাক্ষী নদীর কথা বলেছেন এবং স্বীকারও করেছেন,
‘ময়ূরাক্ষী নদী দেখিওনি কোনো দিন।
ওর নামটা শুনি নে কান দিয়ে,
নামটা দেখি চোখের উপরে-
মনে হয় যেন ঘননীল মায়ার অঞ্জন
লাগে চোখের পাতায়।...
সব কিছু থেকে ছুটি নিয়ে
চলে যেতে চায় উদাস প্রাণ
ময়ূরাক্ষী নদীর ধারে।’
এর পাশাপাশি কবিগুরু তাঁর ‘কথা’ কাব্যের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় পদ্মার শাখা নদী চুর্ণীর কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বলাকা’ কাব্যের ‘বলাকা’ কবিতায় বাংলার বাইরের নদী ঝিলমের উল্লেখ পাই। ‘প্রান্তিক’ কাব্যে যেমন কালিন্দী নদীকে নিয়ে কবি লিখেছেন তেমনি ‘পুনশ্চ’ কাব্যের ‘বাঁশি’ কবিতায় কবি ধলেশ্বরী নদীর তীরে পিসিদের গ্রামের কথা উল্লেখ করেছেন। কবি শুধুই যে নামজানা নদীর প্রেমে মজেছিলেন তা নয়। তিনি অজানা নদীকেও যেন আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি ক্ষণিকা কাব্যের ‘কূলে’ কবিতায় এমনই এক অজানা নদীর কথা বলেছেন। তাঁর কবিতার এই নদীর কূলে স্নানের কোনো ঘাট নেই।
'বীর পুরুষ’ কবিতায় সাহসী খোকা মাকে সাহস যোগাতে মরা নদীর সোঁতা দেখতে পাওয়ার কথা বলেছিল। অর্থাৎ অজানা জায়গায় একটা চেনার চিহ্ন যখন পাওয়া যায় তখন বুকে বল পাওয়া যায়। খোকা যেন ভীতু মায়ের মনে মরা নদীর সোঁতার কথা বলে সেই মনোবল যোগাতে চেয়েছিল। কবিও খোকার মতো ‘মহুয়া’ কাব্যের ‘নির্ভয়’ কবিতায় তাঁর প্রিয়াকে সাহস দিতে গিয়ে বলেছেন,
'পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি,
ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব-
তুমি আছ, আমি আছি।'
মানুষ কেউই তার নিজের অবস্থানে সুখী নয়। অন্যের জীবনই যেন তার কাছে রোমাঞ্চকর ও কাঙ্ক্ষিত। কবিগুরু নদীর উপমায় খুব চমৎকারভাবে ‘কণিকা’ কাব্যের ‘মোহ’ কবিতায় মানুষের এই অতৃপ্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি নিজ অবস্থানে অসন্তুষ্টদের জন্যে যথার্থই বলেছেন,
‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।
‘জন্মদিনে’ কাব্যে কবিগুরু প্রকট করেছেন জীবন সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য। তাঁর মূল বক্তব্য হলো, ‘নদীর পালিত এ জীবন আমার’। তিনি আমাদের এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
‘যে নদী বিশ্বের দূতী
দূরকে নিকটে আনে,
অজানার অভ্যর্থনা নিয়ে আসে ঘরের দুয়ারে,
সে আমার রচেছিল জন্মদিন
চিরদিন তার স্রোতে
বাঁধন-বাহিরে মোর চলমান বাসা
ভেসে চলে তীর হতে তীরে।’
তাঁর জন্মদিনে কবি যেমন নদীকে স্মরণ করেছেন, তেমনি মৃত্যুর মাস দেড়েক আগেও তাঁর ‘শেষ লেখা’ কাব্যের ‘রূপনারাণের কূলে’ কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘রূপনারাণের কূলে
জেগে উঠিলাম
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।’
‘ক্ষণিকা’ কাব্যে কবি আমাদের কাছে কোনো একটি গ্রামকে পরিচয় করাতে গিয়ে ‘অঞ্জনা’ নদীর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,
‘আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে-
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।’
‘সহজ পাঠ’ দ্বিতীয় ভাগে ত্রয়োদশ পাঠে তিনি আমাদের আরেকটি ‘অঞ্জনা নদী’র সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে লিখেছেন,
‘অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে।’
বোলপুরের শান্তিনিকেতনের কাছ দিয়ে বয়ে গেছে ‘কোপাই’ নদী। নদীটি ময়ূরাক্ষী নদীর উপনদী। এই নদীর প্রেমে মশগুল হয়ে কবি লিখলেন ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতা, বৈশাখ মাসে যার হাঁটুজল থাকলেও আষাঢ়ে তার বুকভরা খরস্রোত বয়ে যায়।
ছোট নদীর পাশাপাশি কবিগুরু এমন একটা জীবনের নদীর কথা বলেছেন তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যে, যেখানে জীবনের সকল ফসল সোনার তরীতে তুলে দিয়ে তিনি রিক্ত বেশে নদীতীরে বসে আছেন।
কবিতার পাশাপাশি গানেও কবিগুরুর নদীপ্রেম উছলে উঠেছিলো। তিনি পিলু রাগে একতালে নদীকে নাচিয়ে যেন গেয়ে উঠেন,
‘ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধভরে তন্দ্রাহারা॥
আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা নবীন পাতায়, আমার চলা ফুলের ধারা॥’
আবার পূজা পর্যায়ের গানেও রবীন্দ্রনাথ নদীকে স্মরণ করে নিবেদন করেছেন সুর ও গীতির অঞ্জলি,
‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব॥
কত-যে গিরি কত-যে নদী-তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব॥’
রবীন্দ্রনাথ কথা সাহিত্যেও নদীর প্রেমে মজে উঠেছিলেন বারে বারে। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক যেন তারই মনের মধ্যে বাস করা দুরন্ত বালক যে খালাসীদের মতো ‘এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে-এ-এ না’ বলে নদীর গভীরতা মাপতে মাপতে যাত্রা করেছিল অনন্তে। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় মামাবাড়িতে মামীর জ্বালাতনে ফটিকের কেবলই মনে পড়তো, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না করিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বরচিত রাগিণী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইবার সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে নৌকা নদীতে না ডুবলে যে গল্প এগিয়ে নেওয়া যেত না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নদী এখানে রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর অনুঘটক। ‘রাজর্ষী’ উপন্যাসে রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য প্রতিদিন নদীর ঘাটে স্নান করতে যান। এই নদীর ঘাটেই তার সাথে দেখা হয় দুই ভাইবোন হাসি ও তাতার। এই নদীর ঘাটেই মহিষবলির রক্ত দেখে হাসি জ্বরগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পরিণামে রাজা প্রাণী বলিদান নিষিদ্ধ করেন। নদীর ঘাট এখানে রবীন্দ্রনাথের মনে বিরাজিত শুভ সংস্কারের পুণ্যক্ষেত্র হিসেবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। আবার ‘শেষের কবিতা’ শীর্ষক কাব্যধর্মী উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ নদীকে তো কাছে টানলেনই বরং নদীর চরের দিকে হাত বাড়িয়ে অমিত'র ভাষ্যে বলেছেন, ‘আমি রোম্যান্সের পরমহংস। ভালোবাসার সত্যকে আমি একই শক্তিতে জলে স্থলে উপলব্ধি করব, আবার আকাশেও। নদীর চরে রইল আমার পাকা দখল; আবার মানসের দিকে যখন যাত্রা করব, সেটা হবে আকাশের ফাঁকা রাস্তায়।'
ভ্রমণেও কবির নদীপ্রেম ছিলো বহাল তবিয়তে।
কবিগুরু পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণকালে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় ভীষণ অসু¯’ হয়ে পড়েন। তিনি চিকিৎসার জন্যে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সে যাত্রা বিরতি করে উঠেন সান ইসিদ্রো নামক ছোট্ট শহরতলির এক হোটেলে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে আর্জেন্টিনার সাহিত্যমহলে। ছুটে যান ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। যাঁর গীত ওকাম্পোকে ঋদ্ধ করেছে, তাঁকে একনজর দেখতে তিনি অস্থির হয়ে উঠেন। কবির অসুস্থতায় তিনি উদ্বেলিত হন। কবিকে সু¯’ করার জন্য হোটেল থেকে ‘রিও ডি প্লাতা’ নামক নদীর ধারে একটি বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন। এভাবে বিদেশ-বিভূঁয়ে নদীও রবিকে সঙ্গ দিয়ে গেছে রুগ্নতায়।
ঊনিশশো ছাব্বিশ সালের আট ফেব্রুয়ারিতে নর্থ ব্রুক ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা পৌরসভার পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ সেবার যে কয়দিন ঢাকায় ছিলেন সে কয়দিন ভোরবেলায় সদরঘাটের বুড়িগঙ্গা নদীতে তুরাগ হাউসবোটে নৌ-ভ্রমণ করতেন । তিনি বুড়িগঙ্গাবক্ষে বসে লিখেছিলেন,
‘ভারী কাজের বোঝাই তরী কালের পারাবারে
পাড়ি দিতে গিয়ে কখন ডোবে আপন ভারে
তার চেয়ে মোর এই ক-খানা হালকা কথার গান
হয়তো ভেসে বইবে স্রোতে তাই করে যাই দান।’
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে কবিগুরু চারবার মংপুতে আসেন। তাঁর এই ভ্রমণে সঙ্গ দিয়েছিল দুরন্ত ঝরনারূপী পাহাড়ি নদী রিয়াং। অবশ্য রিয়াং-এর এই প্রেম তিনি কোনো সাহিত্যে ধরে রেখেছেন কি না তা জানা যায়নি॥
রবীন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে একজন বুদ্ধানুরাগী ছিলেন। তিনি বেশকিছু বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী হতে নিজের সাহিত্য চর্চা সমৃদ্ধ করেন। এরকম একটি জাতক হলো ‘শ্যামাবতীর কাহিনী'। বৌদ্ধ জাতকের ‘দিব্যাবদান মালা'র এই কাহিনী নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘সামান্য ক্ষতি’ নামের অসামান্য কাহিনী কাব্য। এই কাহিনীতে তিনি বরুণা নদীতে স্নান শেষে কাশীর মহিষী করুণার আগুন পোহানোর দুঃখজনক ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন। তাঁর কবিতায় আমরা পাই,
বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস
স্বচ্ছসলিলা বরুণা।
পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে
শিলাময় ঘাট চম্পকবনে;
স্নানে চলেছেন শত সখীসনে
কাশীর মহিষী করুণা।
এই বরুণা নদী বারানসীতে বহমান এবং ধারণা করা হয়, বরুণা নদীর নাম থেকেই বারানসীর উৎপত্তি।
নদী ও রবীন্দ্রনাথ যেন কান্তা ও কান্তের রসায়ন। অসংখ্য নদী-সংশ্লিষ্ট সাহিত্য রবীন্দ্র-রচনায় জ্যোতির্ময় হয়ে ফুটেছে। পদ্মার সাথে রবীন্দ্রনাথ যেমন নিত্য সম্বন্ধীয় অব্যয়ের মতো আটকে আছেন তেমনি ছোট নদী কোপাই কিংবা রূপনারায়ণও পাঠকের মনে গেঁথে আছে বছরের পর কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের কলমে ওঠার কারণে। ‘মেঘদূত’-এর কবি কালিদাসের রচনাকে পর্যালোচনা করতে গিয়ে কবিগুরু যেমন রেবা, বেত্রবতী এবং শিপ্রা নদীকে ভালোভাবে জানিয়েছেন তেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশের গুমানী বা নাগর নদীও তাঁর কল্যাণে পেয়েছে আন্তর্জাতিকতা। ‘জন্মদিনে’ কবিতায় কবিগুরু যেমন অকপটে তাঁর জীবনকে নদীর পালিত জীবন বলে ঘোষণা করেছেন, তেমনি তাঁর সাহিত্যের অধিকাংশই বাহিত সাহিত্য। পাঠ নিলেই মনে হয় নদীর মতো বেগবতী ও প্রাণবান। রবীন্দ্রনাথের নদীপ্রেম বাংলা সাহিত্যে বয়ে এনেছে মূল্যবান সৃজনশস্য। তাই এই অমর যুগল প্রেমে আমাদের অনন্ত অঞ্জলি।