প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
মানুষ হলো অমৃতস্য পুত্রাঃ। প্রকৃতির সর্বস্তরে এর নির্যাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মেই যোদ্ধা। সেই প্রস্তর যুগ থেকে এই ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত মানুষের বিরামহীন যুদ্ধ চলছেই। প্রস্তর যুগের কোনো এক পর্বে আগুনের আবিষ্কার এবং মানব সভ্যতার অঙ্কুরোদ্গম হয়ে গেল। আর সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছে ধরিত্রীর মসৃণ-বন্ধুর, অনুকূল-প্রতিকূল, মানবিক-নিষ্ঠুর, সৃষ্টি-অনাসৃষ্টি ইত্যাদি নিয়ে মানুষের ব্যস্ততাণ্ডস্থবিরতায় পথ পরিক্রমা। প্রস্তর যুগের পরেই আসলো ‘নবপোলিয়’ যুগ। এ সময়েই ধাতুর বিভিন্ন ব্যবহার এবং কৃষি কাজের সূচনা হয়েছিল। তা আনুমানিক চার হাজার খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় দশ হাজার অব্দে তাম্র যুগেরও সূচনা হয়েছিল। যুগের প্রয়োজনের তাগিদে যুগান্তর ঘটে থাকে। মানুষের সক্রিয় ভূমিকাই যুগান্তরকে অধিকতর অনিবার্য করে দেয়। তাই ব্রোঞ্জ থেকে জ্ঞান যুগের সন্ধিক্ষণের অতি প্রত্যুষে বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্যে সূচিত হলো দর্শন যুগের। এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন দার্শনিক সক্রেটিস খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তাঁর উত্তরসূরিরা হলেন প্লেটো-এরিস্টটল-বাট্রান্ড রাসেল-জেনোফোন-শঙ্করাচার্য-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব প্রমুখ। এই যুগে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রত্যেকটি শাস্ত্রের প্রেক্ষাপট এক আদর্শ সাবেকী অতীত মাত্র। বাট্রান্ড রাসেলের মতে, দর্শন চর্চার জন্যে একটি জাতিকে ন্যূনতম সভ্যতা অর্জন করতে হয়। আমরা কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষে পীড়িত।
দর্শন যুগের পর ক্রমান্বয়ে আমরা পেয়েছি জ্ঞান যুগ-বিজ্ঞানের যুগ-শিল্পের যুগ-স্থাপত্যের যুগ-সাহিত্যের যুগ। বর্তমানে আমরা আছি অর্থবিত্ত-বৈভবের লড়াইয়ের যুগে। এখানে অনন্ত লালসায় মনুষ্যত্ব উধাও, প্রেম বিলুপ্ত, অধার্মিকের ধার্মিক সাজার প্রতিযোগিতা এবং অর্থের দাম্ভিকতার কাছে নৈতিকতা দ্রবীভূত। চলমান পাঠ্য-পুস্তকের আকালে আমরা হতদরিদ্র নিস্পন্দ-লয়হীন এবং পতনোন্মুখ সমাজে আছি। অর্থের দাপটে অবৈধ সিন্ডিকেট ভোগ্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রক, ভোক্তারা এর নির্মম শিকার। বাঙালি অবস্থার বশীভূত কিন্তু অবস্থা বাঙালির বশীভূত হয় না। জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে বাঙালি কিন্তু চিরকালই আপোষহীন যোদ্ধা।
অত্যাধুনিক, অলৌকিক এবং রোমাঞ্চকর ডিজিটাল যুগের আবির্ভাব, বিত্ত-বৈভবের যুগের সমত্বরণে চলাই স্বাভাবিক। যুগোপযোগী প্রাপ্তিই বটে। এখন শিশুদেরকে ঘুম পাড়ানো বা খাওয়াতে আর বকবকাতে হয় না। ডিজিটাল মোবাইলখানা ঘুম পাড়ানো এবং খাওয়ানোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র হিসেবে কাজ করে থাকে। এখন আর ‘ছেলে ঘুমালো-পাড়া জুড়ালো’ বা ‘কে খাবে-কে খাবে’ বলে ছবক দিতে হয় না। এমনকি আধুনিক যুবক-যুবতীরা চলমান বাঙালি সামাজিকতাকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে নিজেরাই জীবন-জুটি স্থির করে ফেলে অথবা তারুণ্যসুলভ অপরাধে জড়িয়ে যায়। অথচ যুগোপযোগী ডিজিটালাইজেশন কতোটা অপরিহার্য তা বেমালুম ভুলে যায় অপরাধ প্রবণতার আবেশে। এখানে দুর্বল অভিভাবকত্ব অসহায়, কিন্তু সময়োপযোগী সঠিক অভিভাবকত্বই একমাত্র প্রতিষেধক। এই যুগে সফলতার অযাচিত সাফল্য অনেক বেশি, কিন্তু সার্থকতা অতিশয় নগণ্য। যেমন পকেটমারেরাও তো সাফল্য পায় কিন্তু সার্থকতা নাই। মির্জাপুরের আরপি সাহা এবং হুগলীর হাজী মোহাম্মদ মহসীন জনকল্যাণমূলক কাজের চরম সার্থকতায় আজ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি হয়ে আছেন এবং থাকবেন। কাজেই যুগের সার্থকতাতেই সকলের ব্রতী হওয়া উচিত।
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।