বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৩, ০০:০০

এ কালের রাম-লক্ষ্মণ!
অনলাইন ডেস্ক

বাল্মিকী রামায়ণ পড়ে সত্যব্রত পেয়েছিল পিতৃভক্তির অনন্য নিদর্শন। সে গল্পই হোক আর ইতিহাস হোক, সত্যব্রত জেনেছিল, কতোটা শ্রদ্ধা ভালোবাসার গুণ নিয়ে জন্মালে, পিতৃ আদেশে চৌদ্দ বছর বনবাসে কাটিয়ে দেয়া যায়। রাম-লক্ষ্মণ ভ্রাতৃদ্বয় তার স্বচ্ছন্দ উদাহরণ। অযোধ্যার সূর্যবংশীয় রাজা দশরথের পুত্রদ্বয় রাম- লক্ষ্মণ, পিতার পাপ মোচনে কতোটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলো সে ইতিহাস সকলেরই জানা। এই বনবাস যাত্রায় ভ্রাতৃদ্বয়ের আরেক সঙ্গী ছিলো রামের পতিব্রতা স্ত্রী সীতাদেবী। সতীত্বের প্রমাণ দিতে সীতার অগ্নিপরীক্ষা রামায়ণের বড় অংশ জুড়ে বিধৃত। এ যাত্রায় সে প্রসঙ্গটি থাক।

সত্যব্রতের অনেক পরিচয়ের মধ্যে পাঠক পরিচয়টি অন্যতম। সদাচারী, কর্মমুখী সত্যব্রত। বাল্মিকী রামায়ণ পড়েছিল সে যৌবনের প্রারম্ভে, তখন শিক্ষাজীবন তার, খানিকটা বোহেমিয়ানও। তখন কর্মব্যস্ততাহীন একটি লম্বা সময়ে পড়ে ফেলে সে অনেক কিছু। সে জন্মগত পাঠক, সর্বভুক পাঠক। ত্রিশ বছর আগেকার পড়া গল্প, ইতিহাসের বিষয়বস্তু মনে রাখতে পারে আজও। মিলিয়ে দিতে পারে সময়ের প্রেক্ষাপটে, মেলাতে পারে পূর্বেকার সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্য। আর এ কারণেই কোথাও শিল্পসাহিত্যের নকল, অনুকরণ, অনুসরণ হলে তার চোখ এড়িয়ে যাওয়া দুষ্কর। হাজার নির্গুণে বেঁচে থাকা সত্যব্রত কেবল এ গুণেই খুঁজে পেয়েছে এ যুগের এক রাম- লক্ষ্মণ ভ্রাতৃদ্বয়কে।

এ কালের রাম-লক্ষ্মণ পিতৃ আদেশে বনবাসে যায়নি, যেতে হয়নি, অবশ্য সেকালের বনবাস-টনবাসের প্রথা এখন আর নেই। এ গল্পের রাম-লক্ষ্মণ প্রবাসী, রেমিট্যান্স যোদ্ধা। দেশাত্মবোধের সুপ্ত অনুভূতি থেকে এই যোদ্ধাদের প্রতি ভীষণ অবনত সত্যব্রত। অবনত মস্তক তার কৃতজ্ঞতায়, চর্চায়, ভালোবাসায়।

একালের রাম-লক্ষ্মণের পিতার নামটিও থাকুক দশরথ নামেই। সূর্য বংশীয় রাজার মতো সে রাজা নয়, মধ্যবিত্ত গেরস্ত। অযোদ্ধার নয় বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের। সে আশির দশকের শেষদিকের কথা। প্রবাস থেকে ফিরে দশরথ। কিশোর সত্যব্রত প্রথমবার প্রবাস ফেরত কাউকে দেখে আপ্লুত হয়। দশরথ তার প্রতিবেশী, মিষ্টভাষী, বন্ধুবৎসল। বেয়াই বলে সম্বোধন করে তাকে। মাঝেমাঝে বন্ধু বলেও আদর করে। প্রবাসী দশরথ গ্রাামে ফিরে গেরস্তালি শুরু করে। গরু, হাঁসমুরগির খামার গড়ে তোলে। সত্যব্রত একদিন বাজারে দুধ কিনতে গেলে দশরথ আধাসের দুধের দাম নেয় না। এমনিতেই দিয়ে দেয়। কিশোর মন খুশিতে নেচে ওঠে। পৌনে দুই টাকার দুধ। সেকালে এ টাকায় অন্তত সেকেন্ড ক্লাসে একটা সিনেমা দেখা যেতো। পৌনে দুই টাকা মূল্যের আধাসের দুধের কৃতজ্ঞতা এখনও বয়ে বেড়ায় সে।

আরেকদিনের ঘটনা, সত্যব্রতের পোষা ছাগলটি দশরথের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে। দশরথ ছাগলটি খোয়াড়ে নিয়ে যেতে উদ্ধত হয়। পথিমধ্যে জানতে পারে এটি তার কিশোর বন্ধুর ছাগল। বন্ধুকে ডেকে নিয়ে কান মলে দেয়। ছাগল আর খোয়াড়ে দেয় না। দুই টাকার জরিমানা থেকে বেঁচে যায় সত্যব্রত। অসম বয়সী বন্ধুত্বেরে সম্পর্কটি আরও প্রগাঢ় হয়। সত্যব্রতের পৌনে দুই টাকার কৃতজ্ঞতার সাথে যুক্ত হয় আরও দুই টাকা।

পেরিয়ে যায় অনেক বছর। পড়াশোনা, চাকুরি, তারপর দাম্পত্যজীবনে লম্বা সময় কেটে যায় সত্যব্রতের। দশরথের সাথে আর দেখা হয় না। সঙ্গত কারণেই সে গ্রামমুখী নয়। পেশাগত কারণে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। দশরথ এখন বৃদ্ধ, সেদিনের কিশোর সত্যব্র্রত মাঝবয়সী। এই অসম বন্ধুত্বের সমাপ্তি এভাবেই হতে পারতো, তাতে এ বিশ্বব্রহ্মা-ের একবিন্দু ধূলিকণাও স্থানচ্যুত হতো না। কিন্তু না, অতি অনুভূতিশীল এবং স্মৃতিকাতর সত্যব্রত ভুলতে পারে না তার শৈশব স্মৃতি। জীবনের পদে পদে ধারণ করে পল্লী জলের পদ্ম স্নান, আষাঢ়ের নতুন জোয়ার, আলোকিত ভোর, গোধূলির মায়া, চিরচেনা মাটির গন্ধ। স্মৃতির আলপনায় আঁকা রয়েছে আজও দশরথের পৌনে চার টাকার কৃতজ্ঞতা।

সত্যব্রত হারাতে চায় না স্নেহের দান। দশরথের সাথে দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলেও তার ছেলেদের সাথে তৈরি হয় নিবিড় সম্পর্ক। এরাই একালের রাম-লক্ষ্মণ। প্রবাসে তাদের আয়-রোজগার বেশ ভালো। সত্যব্রতকে তারা কাকা সম্বোধন করে। ভার্চুয়ালি প্রচুর আলাপ আলোচনা হয়। দেশ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম এসব তাদের আলোচ্য বিষয়। ভালো পাঠক এবং একটু আধটু লেখক হিসেবে সত্যব্রত খুব প্রিয় কাকা হয়ে উঠে তাদের কাছে। তবে রাম-লক্ষ্মণের সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে দুটি বিষয়, ধর্মের বাংলাদেশ নির্মাণ আর বাবা দশরথের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার নিদর্শন। পিতৃভক্তির কারণ হিসেবে ধর্মের বিধানটুকুই প্রাধান্য পায় তাদের কাছে। পিতৃভক্তিতে স্বর্গলাভ হবে এটাই মুখ্য বিষয়। এ যেনো এক ভালোবাসা বিনিময় প্রথা। আমি ভালোবাসলে পরমেশ্বর আমায় স্বর্গ দিবেন, চিরশান্তির আবাস হবে পরলোকে, এটাই প্রত্যাশা। অন্তরের ভক্তি নয়, মনোজাগতিক ভালোবাসা নয়, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তো নয়ই। বিনিময় প্রত্যাশায় এ এক লোকজ ভক্তির সমারোহ মাত্র। সত্যব্রত বুঝে, রাম-লক্ষ্মণের ধর্মীয় চর্চার আবেগ যতো না বেশি তারচে’ বেশি তত্ত্বীয় আবেগ। সাধারণের মাঝে চর্চার চেয়ে তত্ত্বীয় আবেগের ব্যারোমিটার যখন ঊর্ধ্বগামী তখন মানবিক মূল্যবোধ মরে যায়। মূলত ধর্মের সর্বনাশ এখানেই নিহিত।

সত্যব্রত একদিন জানতে পারে বৃদ্ধ দশরথ করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। দূর প্রবাসে রাম- লক্ষ্মণ উতলা হয়ে ওঠে। পিতৃভক্তির ঢেউ ওঠে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে। উতলা হয় সত্যব্রত। রাম-লক্ষ্মণের সাথে যোগাযোগ হয়, ব্যক্তিগত ব্যস্ততাকে গৌণ করে হাসপাতালে খবরাখবর নেয়। একদিন জরুরি ঔষধের প্রয়োজন হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করে। অন্যত্র ঔষধের সন্ধান করে সত্যব্রত। অনলাইনে, অফলাইনে ঘণ্টা দুয়েক চেষ্টায় খুঁজে পায় দু®প্রাপ্য সে ঔষধ। অনলাইন অর্ডারে কাঙ্ক্ষিত ঔষধ পৌঁছে যায় হাসপাতালে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রাম-লক্ষ্মণ।

সশরীরে হাসপাতালে যাওয়ার জন্যে ব্যকুল হয়ে ওঠে সত্যব্রত। সময় করে উঠতে পারে না। রাম-লক্ষ্মণের বড়ভাই আছে হাসপাতালে, সে গ্রামেই থাকে। সেই নিয়ে এসেছে বাবাকে, সেই এখন উপস্থিত অভিভাবক। দশরথের এই বড় ছেলেটিও যথেষ্ট পিতৃভক্ত, সামাজিক মানুষ, ধার্মিক তো বটেই। ছোট দুই ভাইয়ের মতো সেও ঈশ্বর বন্দনা ছাড়া কথা শুরু করে না। বাক্যের শেষে জুড়ে দেয় আরেক পশলা ধর্মস্তুতি। সত্যব্রতের প্রতি তার শ্রদ্ধা-ভক্তির অন্ত নেই। টেলিফোনে যোগাযোগ হয় প্রতিদিন। তার প্রবাসী ভাইদের সাথে যে সকল আলোচনা হয় তার হালনাগাদ তথ্য পায় সে। সেও জানায় নতুন নতুন তথ্য, জানায় অক্সিজেন লেভেল ওঠানামার দৈনন্দিন অবস্থা। এভাবে সাতদিন কিংবা তারও বেশি সময় পার হয়ে যায়, সত্যব্রতের ব্যাকুলতা বাড়ে। কৈশোরের অসমবয়সী বন্ধুকে দেখার, একটু কথা বলার খুব আগ্রহ হয় তার। এদিকে বিশ্বের সাথে সমানতালে প্রতিদিনই বেড়ে চলে করোনায় মৃতের সংখ্যা। সাথে সাথে উৎকণ্ঠা বাড়ে সত্যব্রতের। এ আগ্রহ, ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা কোনো কৃতজ্ঞতা বোধের বহিঃপ্রকাশ নয়, কৈশোরের পৌনে চার টাকা পরিশোধের অভিপ্রায় নয়, স্বর্গলাভের প্রত্যাশা তো নয়ই। ছিটেফোঁটা চর্চা করেই ধর্মের তত্ত্বজ্ঞান জাহির করা তার ধাতে সয় না। সে চর্চায় মানবিক এই তার ধর্ম। এ চর্চাটুকু স্বভাবজাত। স্নেহ-ভালোবাসার লেনদেন তার কাছে স্বর্গসম। একদিন ভালোবাসার সমবণ্টন হবে বিশ্বময়, এই তার ব্রত, এই তার ধর্ম।

একদিন সময় করে হাসপাতালে যায় সত্যব্রত। দশরথ তখন আর কথা বলতে পারে না। চিনতে পারে কিশোর বন্ধুকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। একবার ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির ঝিলিক ফুটে উঠে, পরক্ষণেই তা মিলিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে, বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করে, অসম্পূর্ণ সে বাক্য অবোধগম্যই থেকে যায়। অক্সিজেনের মাত্রা আজ নিম্নগামী। বুকে, গলায় ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যায়। বড় ছেলের সাথে কথা হয় সত্যব্রতের, কথা হয় আরও কিছু উপস্থিত আত্মীয়ের সাথে। মাথার কাছে সংরক্ষিত চিকিৎসাপত্রের ফাইলটা হাতে নেয়, কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে। ছুটে যায় ডিউটি ডাক্তারের রুমে। ফাইলের এ পিঠ ওপিঠ ভালো করে বুঝিয়ে দেন ডাক্তার। আজকের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা ঊর্ধ্বগামী না হলে ফেরার সম্ভাবনা নেই, জানিয়ে দেন ডাক্তার। বাইরে এসে এ কথা কাউকে বলে না সত্যব্রত। বলতে পারে না সে। বলা না বলায় কিছু আসে যায় না, জানে সে, তবু না বলাই ভালো মনে হয় তার কাছে। সব ঠিক হয়ে যাবে বলে সান্ত¡না দেয় আত্মীয় পরিজনদের। বন্ধুর গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে।

গেটে এসে বড় ছেলে জানায়, কাকা, হাসপাতালের কিছু বিল পত্র বাকি পড়েছে। কিছু টাকা ধার দিলে উপকার হতো।

কতো লাগবে? জিজ্ঞেস করে সত্যব্রত।

আপাতত দশ হাজার হলেই চলবে।

এই মুহূর্তে সাথে নেই, বিকাশ নম্বর দাও, কাল সকালে পাঠিয়ে দেবো, বলে চলে যায় সত্যব্রত।

রাতে রাম-লক্ষ্মণের সাথে টেলিফোনে দীর্ঘ আলোচনা হয়। ‘আজকের মধ্যে অক্সিজেনের মাত্রা ঊর্ধ্বগামী না হলে ফেরার সম্ভাবনা নেই’ সে কথা বলে না তাদেরকে। প্রবাসী সন্তানদ্বয়কে কষ্ট দিতে চায় না সে। কিংবা বাবার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মাত্রা এতোটাই বেশি যে, শঙ্কার কথা বলতেই সাহস পায় না। পরদিন সকালে দশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয় বড় ছেলের দেয়া বিকাশ নম্বরে।

এরপর প্রতিদিন রুটিন করে কথা হয় প্রবাসে রাম-লক্ষ্মণের সাথে, কথা হয় হাসপাতালে। শঙ্কা বেড়েই চলে প্রতিদিন। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে বড় ছেলে জানায়, বাবা মারা গেছেন। পারিবারিকভাবে বিদেশে জানানো হয়নি এ দুঃসংবাদ। রাতে সত্যব্রতই ফোন করে জানায় রাম-লক্ষ্মণকে। টেলিফোনের ওপারে ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দ, করুণ আর্তনাদে কণ্ঠ ধরে আসে সত্যব্রতের। কিছুক্ষণের জন্য সে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। পিতামাতা হারানোর একমুঠো অন্তর্দাহে ভেসে যায় তার চক্ষুযুগল। সুদূর প্রবাস থেকে সৎকারে যোগ দিতে পারে না রাম-লক্ষ্মণ। দুঃখ ভারাক্রান্ত অনেক অনেক স্ট্যাটাসে সয়লাব হয় ফেসবুকের পাতা। এতোটা পিতৃভক্ত সন্তানদ্বয় কেবল ভার্চুয়াল গ্যালারিতে সৎকার সম্পন্ন করে, কিভাবে সম্ভব! মেলাতে পারে না সত্যব্রত। এই প্রথমবার খানিকটা বিস্মিত হয় সে।

এরপর অনেকদিন পার হয়ে যায়। ঘটা করে দশরথের শ্রাদ্ধশান্তি হয়। এখানেও অনুপস্থিত রাম-লক্ষ্মণ। ফেসবুকের কল্যাণে খুঁটিনাটি সব দেখে সত্যব্রত। দেখে, পিতৃবিয়োগের অনবদ্য বিলাপ চলতেই থাকে ফেসবুক জুড়ে। আহা! ধর্মের আবহে প্রতি শব্দে শব্দে, ছত্রে ছন্দে সাজানো এমন শ্রদ্ধা, ভালোবাসার স্তুতি সত্যিই বিরল। তবে সৎকার, শ্রাদ্ধশান্তিতে অনুপস্থিতির এমন স্ববিরোধী পিতৃভক্তি সে দেখেনি কোনোকালে। যাহোক, কারো ব্যক্তিগত ছিদ্রান্বেষণ, বিশ্লেষণ এ যাত্রায় ক্ষান্ত দেয় সত্যব্রত।

ছয়মাস পর। সত্যব্রত তার ধারের টাকা ফেরত চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এতোদিনে হয়তো রাম-লক্ষ্মণের পিতৃশোক কিছুটা হলেও কমেছে। বড় ছেলে টাকা নিলেও প্রবাসী রাম-লক্ষ্মণের সাথেই তার সখ্যতা বেশি। অনলাইনে তাদের সাথেই আলোচনা বেশি হয়, তাই হৃদ্যতাও সেখানেই বেশি, বিশ্বাস করে সত্যব্রত। বড় ছেলেকে না বলে রাম-লক্ষ্মণকেই বলে সে। মুখে বলতে খানিকটা লজ্জাবোধ করে, ম্যাসেঞ্জারে লিখে জানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে উত্তরটা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে সে চিন্তাও করতে পারে না। এতোটা পিতৃভক্ত সন্তানদ্বয় এভাবে সম্পর্কের দৃশ্যপট পালটে দিবে তা ছিলো কল্পনার অতীত। প্রবাস থেকে সাফ জানিয়ে দেয়, এ টাকা সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। টাকা যদি বড়ভাই নিয়ে থাকে সে নিজেই শোধ করবে। উপরন্তু তারা পিতার চিকিৎসায়, শ্রাদ্ধশান্তিতে কতো লক্ষ টাকা খরচ করেছে তার একটা লম্বা ফিরিস্তি শোনায় সত্যব্রতকে।

ধারের দশ হাজার টাকা সম্পর্কে রাম-লক্ষ্মণ কিছুই জানে না? সত্যিই জানে না? আগে নাইবা জানলো, ছয়মাস পরে যখন জেনেছে তখন তাদের ভুমিকা কেমন হওয়া উচিত ? তাদের বড়ভাই তাদেরই বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা ধার নিয়েছে, স্বাবলম্বী ছোট ভাইয়েরা তার দায়িত্ব নিবে না?

তাদের এমন আচরণ মানতে পারে না সত্যব্রত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। আহত বুকে একটা বাক্য বারবার দাগ কাটতে থাকে তার--

‘টাকা যদি বড়ভাই নিয়ে থাকে-------’ মানে এই যে, একটা সন্দেহের তীর ছুড়ে দিয়েছে তার বুকে। নিজেকে অমানুষ মনে হতে থাকে তার। লজ্জায়, ঘৃণায় তার বাকরুদ্ধ হবার অবস্থা। নিজেকে খানিকটা সামলে নেয়, কখন কোন্ পরিস্থিতিতে টাকা ধার দিয়েছিলো, কোন্ প্রক্রিয়ায় দিয়েছিলো তার সবিস্তারে ব্যাখ্যা দেয় সে। টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য যতো না বেশি, তারচে’ প্রতারণার অভিযোগ থেকে বাঁচতেই তার এ আকুতি, আত্মপক্ষ সমর্থনে মনোসন্তুষ্টির চেষ্টা। কিন্তু না, ধার্মিক, পিতৃভক্ত রাম-লক্ষ্মণ সমাধানে যেতে চায় না। চাইলেই তারা তাদের বড়ভাইয়ের সাথে কথা বলে সহজ সমাধানে যেতে পারতো। তাদের মায়ের সাথে কথা বলে পারিবারিকভাবে সমাধান করতে পারতো। ভাই ভাই-এর অন্তঃকলহ থাকলে নিজেদের মধ্যে সমাধান করতে পারতো। নিজেদের মধ্যে সমাধান হোক বা না হোক প্রতিবেশী কাকার কাছে দায়মুক্ত হতে পারতো। যে পারলৌকিক বিশ্বাসে ফেসবুকের পাতা ভারি করে, সেই বিশ্বাসে অন্ততঃ পিতার পরকালীন মুক্তির জন্য পিতাকে দায়মুক্ত করতে পারতো। কিন্তু না, তারা এক প্রকারের ধার্মিক, ফেসবুকীয় ধর্মজ্ঞানে তারা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে জানে না। বরং অবিশ্বাসের তীর ছুড়ে দেয় সরল বিশ্বাসী সত্যব্রতের দিকে। সে নিরূপায়, কারণ এরা পিতৃভক্ত রাম-লক্ষ্মণ, তারা এ কালের রাম-লক্ষ্মণ, অযোদ্ধার নয় বাংলাদেশের রাম-লক্ষ্মণ। পিতার শ্রাদ্ধশান্তিতে তারা বৃহদাকার আয়োজন করতে পারে, পিতার পরকালীন সুখলাভে মুহুর্মুহু ভার্চুয়াল বিলাপ করতে পারে কিন্তু পিতার চিকিৎসায় ব্যয়িত ধারের টাকা শোধ করতে পারে না। ধর্মের ভার্চুয়াল সংস্করণ এভাবেই কলুষিত করে সত্যকে, দিনের পর দিন।

আশাহত সত্যব্রত। এবার টাকা ফেরত পেতে নয়, অপমানের হাত থেকে বাঁচতে দশরথের বড়-ছেলেকে ফোন দেয়, রাম-লক্ষ্মণের কাছে সে অন্তত একবার প্রমাণ করতে চায়, হ্যাঁ সত্যিই সে তাদের বড় ভাইকে টাকা ধার দিয়েছিলো, কিন্তু বড় ছেলে ফোন রিসিভ করে না। নিয়মিত ফোন দেয়, কোনো কাজ হয় না। মাসের পর মাস পার হয়ে যায়, সাড়া মিলে না। এদিকে রাম-লক্ষ্মণ তার ম্যাসেজের উত্তর দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এভাবেই অপমানের গ্লানি বয়ে বেড়ায় সে আরও ছয়মাস।

এক বছরের অধিক সময় পর একদিন ভিন্ন নম্বর থেকে ফোন দেয় সত্যব্রত। অচেনা নম্বর পেয়ে এবার রিসিভ করে বড় ছেলে। কথা হয়। টাকা ধার নেয়ার কথা ইনিয়ে বিনিয়ে স্বীকার করে সে। এতোদিন কেনো ফোন রিসভি করেনি তার একটা খোঁড়া যুক্তিও দেয়ার চেষ্টা করে। কথোপকথন রেকর্ড করে সত্যব্রত। রাম-লক্ষ্মণকে পাঠায় সে ক্লিপিংস। এবার বুকের ভার হালকা হয় খানিকটা। কিন্তু দুর্ভাগ্য! বড় ছেলে ততোদিনে বিদেশে যাবার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। সত্যব্রতকে কোনো সদুত্তর না দিয়েই কয়েক দিনের মধ্যে সে বিদেশে চলে যায়। আবার রাম-লক্ষ্মণের কাছে টাকার জন্য ধর্ণা দেয় সত্যব্রত। এবার অনেকটা ক্ষোভ নিয়েই সে টাকা ফেরত চায়। এবারও তারা সাফ জানিয়ে দেয় টাকা বড় ভাই দিবে। কিন্তু বড় ভাই’র বিদেশের নম্বরটি চাইলে তা দিতে গড়িমসি করে তারা। একাধিকবার নম্বর চায়, দেয় না। বড় ভাই’র সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানায়। গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিতে অনুরোধ করে সত্যব্রত। দিবে বলে একদিন প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু আর যোগাযোগ করে না। পার হয় আরও কয়েকমাস। এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটে নিরূপায় সত্যব্রত’র। এবার ক্ষান্ত হয় সে।

সত্যব্রতরা এভাবেই ক্ষান্ত হয় যুগে যুগে। রণে ভঙ্গ দেয় সমাজ সংসারের কাছে। এভাবেই পরাজিত হয় তারা ধর্মাশ্রয়ী মানুষ অথবা অমানুষের কাছে। একই গ্রামে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটা, একই ধর্মের অনুসারী তারা, একই উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে সামাজিক বন্ধন তাদের চিরদিনের। উপাসনালয়ে ধর্মাশ্রয়ী রাম-লক্ষ্মণের অনুদানের পরিমাণ বরাবরই বেশি, সঙ্গত কারণেই বেশি। প্রবাসী হলেও তারা গ্রামমুখী আর সত্যব্রত দীর্ঘদিন গ্রাম বিমুখ। সে জানে, রাম-লক্ষ্মণ ধার্মিক হোক বা না হোক, ধর্মের মজ্জাগত সমারোহ তাদের চিরন্তন। এই পরিচিতি তাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেয় শতভাগ। আর সত্যব্রত যে সরল সংস্কৃতবান, মানবিক সেটা তার সমাজে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বিষয়। সে জানে, সামাজিক সহানুভূতি, সমর্থন রাম-লক্ষ্মণের জন্য চিরস্থায়ী। পক্ষান্তরে সত্যব্রত তার সমাজের কাছে এমন অন্ধ সমর্থন আশাই করে না। তাই কষ্টার্জিত দশ হাজার টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো উদ্যোগ সে নিতে চায় না। বরং এ কালের রাম-লক্ষ্মণরা একদিন আরোপিত এক ধর্মীয় সমাজ নির্মাণে জীবনবাজি রাখবে, সেই পরাজিত দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে থাকে সত্যাশ্রয়ী সত্যব্রত।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়