বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০১ মে ২০২৩, ০০:০০

বুদ্ধজ্যোতিতে রবির কিরণ
অনলাইন ডেস্ক

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এক কালজয়ী আলোকবর্তিকা। তাঁর গানে-কবিতায়-উপন্যাসে মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন তিনি জীবনব্যাপী। সেই আলোকবর্তিকা যখন অনন্ত মহা আলোকনের সন্ধান লাভ করে, তখন তিনি হয়ে যান মহাকালের অভিযাত্রী। তিনিই বিমুক্তির বিমুগ্ধতায় অকপটে বলে উঠেন, আলেকজান্ডার পৃথিবী জয় করেননি, পৃথিবী জয় করেছেন বুদ্ধ (ঘরে বাইরে, ১৯১৬)। শুধু যে এটুকু বলেই তিনি ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, তাঁর অজস্র কবিতায়, তিরিশের অধিক গানের বাণীতে, দশটির অধিক নাটক ও নৃত্যনাট্যে, বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে, বুদ্ধগয়ায় দেয়া অভিভাষণে, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসেও তিনি সুযোগ পেয়েই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্মরণ করেছেন বুদ্ধ ও তাঁর মানবতাবাদী দর্শনকে। তিনি যেভাবে জ্ঞানে ও ধ্যানে, কলমে ও মরমে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মকে লালন করেছেন, তাতে তিনি মুখে না বললেও বুঝা যায়, সম্রাট অশোকের পরে গৃহী হিসেবে তিনিই শ্রেষ্ঠ বুদ্ধশিষ্য। তিনিই বৌদ্ধ দর্শনকে জন্মণ্ডজনপদে প্রত্যাবর্তনের পর আপন প্রতিভার জ্যোতিতে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিস্মৃত মস্তিষ্কের নিউরন সম্ভারে। শোভনলালের বয়ানে বুদ্ধের দর্শন আফগানিস্তানের পুরোনো শহর কাপিশের ভেতর দিয়ে কদ্দুর পৌঁছেছিল তা জানার আগ্রহে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসকে তিনি তুলে এনেছেন পাঠকের দরবারে। রবীন্দ্রনাথ যে এক আপাদমস্তক বুদ্ধমগ্ন দার্শনিক তা তাঁর সাহিত্যের গতিপথ থেকে সহজেই বোধগম্য। বুদ্ধকে নিয়ে তাঁর সংকলিত স্বতন্ত্র গ্রন্থ ‘বুদ্ধদেব’ স্বয়ং এ দাবির বড়ো সাক্ষ্য।

বৈশাখ বাঙালি জীবনে কেবল নববর্ষকেই আনেনি, বরং বৈশাখ ভারতীয় উপমহাদেশকে তথা পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে দুজন অলোকসামান্য মানুষকে। তাঁরা হয়তো দৈহিক আবরণ ও আঙ্গিকে মানুষ বটে, কিন্তু মনুষ্যত্ববোধের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁরা আর কেবলমাত্র অস্থি-চর্মাবৃত মানুষে সীমাবদ্ধ নেই। তাঁদের অস্তিত্ব আজ আলোর মতোই মানুষের জীবনে জড়িয়ে আছে কল্যাণের কলকল্লোল হয়ে। এঁদের একজন হচ্ছেন পরম করুণাসঘন তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ আর অন্যজন হলেন মন ও মননের নান্দনিক ক্ষুধার উপশমকারী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একজন জন্মেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ তেতাল্লিশ অব্দে, রাজার গৃহে, কপিলাবস্তু নগরের উপকণ্ঠে দেবদহের অতি নিকটবর্তী লুম্বিনী কাননে। আর একজন জন্ম নেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে আঠারোশ একষট্টি খ্রিস্টাব্দে। একজন জন্ম নেন অতি আকাঙ্ক্ষিত সন্তান হয়ে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে, আর অন্যজন যেন চির নবীনকে ডাক দিয়ে যেতেই পিতার ঘরে জন্ম নেন চতুর্দশতম সন্তানরূপে পঁচিশে বৈশাখে। বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও সংরক্ষণে সম্রাট অশোকের আবির্ভাব যুগান্তকারী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্ম বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও সংরক্ষণে সম্রাট অশোকের মতো খুব বেশি আলোচিত না হলেও কালের পরিক্রমায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও সাহিত্য বৌদ্ধ ধর্মের মহিমা কীর্তনে যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

বুদ্ধের জন্ম রাজপ্রাসাদে আর রবীন্দ্রনাথের জন্ম জমিদারবাড়িতে। অর্থাৎ দুজনেরই জন্ম বিলাস ও প্রাচুর্যে। কিন্তু দুজনের মনেই বেড়ে উঠেছে ত্যাগ ও মানবতার চেতনা। রবীন্দ্রনাথের জন্মের পূর্বেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে বৌদ্ধ দর্শনের প্রচলন ছিল। আঠারোশ ঊনষাট খ্রিস্টাব্দে দেবেন ঠাকুর বৌদ্ধ প্রতিরূপ দেশ সিংহলে ভ্রমণ করেন। সাথে নিয়ে যান দ্বিতীয় পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রাহ্মনেতা কেশব চন্দ্র সেনকে। আঠারোশ নিরানব্বই সালে রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আর্যধম্ম ও বৌদ্ধধম্মের পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত ও সঙ্ঘাত’ শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন এবং ঊনিশশো এক সালে কবির মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বৌদ্ধধর্ম’ শিরোনামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। কবি নিজেই বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা তথাগত বুদ্ধকে নিয়ে যা যা লিখেছেন তার কিছু অংশ নিয়ে শ্রী পুলিন বিহারী সেন রবীন্দ্রনাথের নামে ‘বুদ্ধদেব’ শিরোনামে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ সংকলিত করেন, যা তেরশ তেষট্টি বঙ্গাব্দে জ্যৈষ্ঠ মাসের দশ তারিখ বিশ্বভারতী প্রকাশ করে। এ গ্রন্থের সূচি ছিল : প্রার্থনা (প্রবেশক কবিতা), বুদ্ধদেব (প্রবন্ধ), ব্রহ্মবিহার (প্রবন্ধ), বৌদ্ধধর্মে ভক্তিবাদ (প্রবন্ধ), বুদ্ধদেব-প্রসঙ্গ (গদ্য), বুদ্ধজন্মোৎসব (কবিতা), সকল কলুষতামসহর (কবিতা), বুদ্ধদেবের প্রতি (কবিতা), বোরোবুদুর (কবিতা), সিয়াম : প্রথম দর্শনে (কবিতা)। সিয়াম বলতে শ্যামদেশ বা বর্তমানের থাইল্যান্ড। সুতরাং উপরোক্ত উদাহরণ থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, বৌদ্ধ দর্শনে রবীন্দ্রনাথের ভক্তি, আগ্রহ ও ব্যুৎপত্তি শৈশব হতেই দানা বেঁধেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায়, গদ্যে, ভাষণে বুদ্ধকে বিভিন্ন বিশেষণে ডেকেছেন। তার মধ্যে করুণানিধি (বুদ্ধ ভক্তি), মহাপুরুষ ও মহামানব (জন্মদিনে), অমিতাভ ও অমিতায়ু (বুদ্ধদেবের প্রতি), নরপতি (বোরোবুদুর), দয়াময় (বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, বুদ্ধ ও যুদ্ধ), করুণাময় (সকল কলুষতামসহর), মহাভিক্ষু ও করুণাঘন (বুদ্ধজন্মোৎসব), ভগবান বুদ্ধ (বুদ্ধদেব প্রসঙ্গ), গুরু (করাচীতে কোন এক ছাত্রের উত্তরে) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক আবহে ব্রাহ্ম ধর্মের চর্চা ছিল যারা নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করতেন। বুদ্ধের দর্শনে যেহেতু কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিল না সেহেতু বুদ্ধও কোনো প্রতিমায় পূজোতে বিশ্বাসী ছিলেন না। বুদ্ধের পরিনির্বাণের দুশ বছর পরে বুদ্ধের অনুসারীরা বুদ্ধ প্রতিরূপের প্রচলন করেন, যাতে প্রজন্মের কাছে বুদ্ধকে সহজেই পরিচিত করা যায়।

কৈশোরে বুদ্ধ তীরবিদ্ধ রাজহাঁস দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। শৈশবে হলকর্ষণ উৎসবে গিয়ে লাঙলের ফলায় কেঁচো কাটা দেখে দুঃখিত হয়েছিলেন। বালক রবীন্দ্রনাথও এগার বছর বয়সে মালি হরিশের সাথে বৃটিশ চীফ সাহেবের কুঠিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত খরগোশ দেখে তীব্র শোক পেয়েছিলেন। শৈশব হতেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে বুদ্ধের দর্শনকে কবিগুরু নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। বুদ্ধ কর্তৃক দেশিত ‘পাণাতিপাতা বেরমণি সিক্খাপদং সমাদিযামি’ হতে রবীন্দ্রনাথ ভাষান্তর করে পাঠ নেন, ‘পাণং ন হানে’। অযথা প্রাণ না হরণের শিক্ষায় দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ বড় হয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করেন। এজন্যে তিনি তাঁর ‘স্যার’ উপাধিও বর্জন করেন। তাঁর এই কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ‘আত্মশক্তি’ নামের প্রবন্ধে। খাদ্যের জন্যে প্রাণিহত্যাকে তিনি প্রবৃত্তি বলে উল্লেখ করে তাকে নিবৃত্ত করাই শ্রেয় বলে উল্লেখ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ দু দুবার বুদ্ধগয়া ভ্রমণ করেন। ঊনিশশো চার সালে প্রথমবার আর দ্বিতীয়বার হলো ঊনিশশো চৌদ্দ সালে। বুদ্ধ প্রতিরূপ দর্শন করে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও প্রণতি জানানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয়বার বুদ্ধগয়া দর্শন শেষে তিনি তিনদিনে প্রায় দশটি গান রচনা করেন বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মকে নিয়ে। এই গানগুলো তাঁর ‘গীতালি’ কাব্যে স্থান পায়। কোলকাতা মহাবোধি সোসাইটির আমন্ত্রণে বুদ্ধের জন্মজয়ন্তীতে তিনি অভিভাষণ প্রদান করেন। এতে তিনি তাঁর অন্তরের মধ্যে বুদ্ধকেই জগতের শ্রেষ্ঠ মহামানব বলে স্বীকার করে নেন। তিনি তাঁর কবিতায় বুদ্ধের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে বলেছেন,

হে মহাজীবন হে মহামরণ

লইনু শরণ লইনু শরণ

আঁধার প্রদীপে জ্বালাও শিখা

পরাও পরাও জ্যোতির টীকা

করো হে আমার লজ্জাহরণ। ...

এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানের বাণীর অন্তর্ভুক্ত।

বুদ্ধ-জয়ন্তী উপলক্ষে ‘জন্মদিনে’ কিংবা বুদ্ধের স্মরণে ‘বোরোবুদুর’ কবিতা রচনা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ অন্যূন পাঁচটা কবিতা লিখেছেন যেগুলোর শিরোনামে ‘বুদ্ধ’ উল্লেখিত আছে। কবিতাগুলো হলো ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’, ‘বুদ্ধভক্তি’, ‘বুদ্ধ ও যুদ্ধ’ (ছড়া), ‘বুদ্ধ জন্মোৎসব’ এবং ‘বুদ্ধদেবের প্রতি'। প্রথম তিনটি কবিতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনে জাপানের আক্রমণের পূর্বে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে সেনাদল কর্তৃক শক্তি প্রার্থনাকে ব্যঙ্গ করে লেখা। যুদ্ধে জড়িয়ে জাপান যে বৌদ্ধ দর্শনের পরিপন্থী প্রাণহরণে লিপ্ত রয়েছে এবং এর জন্যে বুদ্ধের আশিস প্রার্থনা করেছে সে বিষয়কে কবিগুরু প্রাধান্য দিয়েছেন। এতে বৌদ্ধ দর্শনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অটুট ভক্তি প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী কবিতা দুটোতে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধের প্রশস্তি রচনা করেছেন। ‘কথা’ কাব্যের ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’ কবিতায় কবি বুদ্ধের একনিষ্ঠ শিষ্য অনাথপিন্ডিকের রত্নখচিত মহামূল্যবান দানকে দীনহীনা নারীর শতচ্ছিন্ন একমাত্র বস্ত্র দানের সাপেক্ষে তুচ্ছ করে দেখিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি বুদ্ধের দেশনাকে উচ্চে তুলে ধরেছেন। কেননা, বুদ্ধ বলেছেন, ‘দানং দদন্তি শ্রদ্ধায়।’ অর্থাৎ দান দিতে হয় মনের মাঝে দান-চেতনা তৈরি করে। বাণিজ্য চেতনা বা লৌকিকতার চেতনায় দান হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা’ কবিতায় এই দান-চেতনা জাগ্রত করার কথা বলেছেন। তাই এই কবিতাতেই তিনি বলেছেন,

‘ওগো পৌরজন, কর অবধান, ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ তিনি, বুদ্ধ ভগবান,

দেহ তাঁরে নিজ সর্বশ্রেষ্ঠ দান যতনে।’

রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘দি সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপাল’ গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে অনেক বৌদ্ধআখ্যানের সন্ধান দেয়। তারই আলোকে তিনি রচনা করেছেন নটীর পূজা, শাপমোচন, রাজর্ষি, শ্যামা, গুরু ইত্যাদি। বুদ্ধের মানবতার বাণীকে ধারণ করে রবীন্দ্রনাথের একটি অনন্য শ্রেষ্ঠ রচনা হলো ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যনাট্য, যেখানে বুদ্ধের প্রধান সেবক আনন্দ চণ্ডালকন্যা প্রকৃতির হাত থেকে পিপাসার জল পান করেন। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদহীন বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিগুরু। তথাগত বুদ্ধ নিজেই ক্ষৌরকার পুত্র বিনয়ধর উপালিকে রাজপুত্র নন্দের আগে প্রব্রজ্যা প্রদান করেন। কারণ ভিক্ষুসঙ্ঘে যিনি আগে প্রব্রজ্যিত হন তিনি জ্যেষ্ঠ হিসেবে উত্তরসূরির সম্মান লাভ করেন। এর মাধ্যমে জন্ম বা বংশ নয় কর্মই মানুষের সম্মান নির্ধারণ করে--এই সত্যকেই বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ চণ্ডালিকায় বুদ্ধের সেই শিক্ষাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে।

রবীন্দ্রনাথ যে কৃষি-সমবায় চালু করেন তাতেও বুদ্ধের দর্শন নিহিত আছে। বুদ্ধ বৃজিবাসীকে সাতটি অপরিহার্য বিষয়ে শিক্ষা দেন, যা রাজ্যশাসনে আবশ্যক। তাতে সমবায়ের মূলমন্ত্র ‘দশে মিলি করি কাজ’ প্রতিভাত হয়েছে। বুদ্ধ রাজ্য পরিচালনায় সকলে মিলে যেমন সিদ্ধান্ত নিতে বলেছেন, তেমনি সকলে মিলেই সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কৃষি সমবায় সেই দেশনার সার্থক প্রতিফলন।

পৃথিবীতে কয়েকটি সেরা গ্রন্থের অন্যতম হলো বৌদ্ধ ত্রিপিটকের ‘ধম্মপদ'। রবীন্দ্রনাথ সেই গ্রন্থের আংশিক অনুবাদ করেছেন নিজে আন্তরিক উৎসাহে। ধম্মপদের অমেয় বাণী ‘অক্কোধেন জিনে কোধং’ তথা ‘ক্রোধকে অক্রোধ দ্বারা জয় করা যায়'। এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ শুধু নিজেই গ্রহণ করেননি বরং তা সিল্কের কাপড়ের ওপর নিজের হাতে লিখে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জুনজিরো তাকাসুকুকে উপহার দেন। শুধু তাই-ই নয়, বিখ্যাত ‘ওসাকা আসাহি শিম্বুন ’ পত্রিকার মালিক র্যুয়েহি মুরাইয়ামাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে কাগজে ‘নমো বুদ্ধায়’ লিখে উপহার দিয়েছিলেন।

বুদ্ধ প্রবর্তিত ব্রহ্মবিহার ছিল রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক চর্চা ও বিশ্বাসের বিষয়। বুদ্ধ, যাঁকে বলা হয় জগৎ-শিক্ষক, তিনি অপ্রমাদে জীবন যাপনের জন্যে চার অপ্রমেয় বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এগুলো হলো মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা। একসাথে এগুলো অনুশীলন করাকেই বলা হয় ব্রহ্মবিহার। এই ব্রহ্মবিহার রবীন্দ্রনাথকে আকর্ষণ করেছে গভীরভাবে। তিনি ‘ব্রহ্মবিহার’ বিষয়ে আলাদা একটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যা তাঁর ‘বুদ্ধদেব’ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। বুদ্ধভাষিত ‘করণীয় মৈত্রীসূত্র’ হতে রবীন্দ্রনাথ প্রথম সূত্রটিকে নিজের জীবনে একাত্ম করে নেন। যেখানে বুদ্ধ বলেছেন, মা যেমন তাঁর একমাত্র পুত্রকে নিজের আয়ুর বিনিময়ে রক্ষা করেন, তেমনি জগতের সকলের প্রতি অপার মৈত্রী পোষণ করবে। রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষাকে অন্তরের গভীরে লালন করেছেন। জগতে মঙ্গল কী কী--এ বিষয়ে বুদ্ধ আটত্রিশ প্রকার মঙ্গলের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ এই মঙ্গলসমূহের মধ্যে ‘অসেবনা চ বালানং, পণ্ডিতানঞ্চ সেবনা / পূজা চে পূজা নীয়া নং এতং মঙ্গলং মুত্তমং’ সূত্রকে রপ্ত করেছেন নিজের কর্ম ও আচরণে। এই মঙ্গলে বলা হয়েছে, মূর্খ ব্যক্তির সেবা না করা এবং পণ্ডিত ব্যক্তির সেবা করাই জগতে উত্তম মঙ্গল। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ লালনের গানকে যেমন তুলে এনেছেন নাগরিক সমাজে, তেমনি শান্তিদেব ঘোষের ‘বোধিচর্যাবতার’ গ্রন্থটিকে তিনি শান্তিনিকেতনে পাঠ্য করে তুলেছেন শিক্ষার্থীদের জন্যে। রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষ্য হতে জানা যায়, তাঁর পিতৃদেবের নির্দেশেই তিনি ও তাঁর বন্ধু ঊনিশশো পাঁচ সালে শান্তিনিকেতনে পাঠদানের জন্যে আচার্য অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ গ্রন্থটি সংস্কৃত হতে বঙ্গানুবাদে ব্রতী হন। তাঁর বঙ্গানুবাদ শেষ হলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর প্রথম তিনটি সর্গ সংশোধন করে দিয়েছিলেন।

অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংকলিত ‘মহিলাদের স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ হতে হেমলতা ঠাকুরের বরাতে জানা যায়, যে ক'দিন রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধগয়ায় ছিলেন, সে ক'দিন প্রাতঃরাশের পর রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধের কক্ষে প্রবেশ করে দুঘন্টার মতো অবস্থান করতেন। এসময় অন্য কারও প্রবেশ বারণ ছিল। কৌতূহল বশে হেমলতা ঠাকুর একদিন ভেজানো দরজা আলতো ঠেলে দেখেন, বুদ্ধের প্রতিরূপের সামনে রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে ধ্যানরত হয়ে আছেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে দরদর করে প্রবাহিত হচ্ছে অশ্রুধারা। সেদিন হেমলতা ঠাকুর যে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলেন, তিনি কবি রবীন্দ্রনাথ নয়, বরং ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের এই ধ্যানমগ্নতা যেন তাঁর গানেই ফুটে উঠেছে। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘অন্তরতর বিকশিত কর অন্তরতর হে।’

বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের জানা ও আগ্রহ কত গভীর ছিলো তা তাঁর পঠিত বৌদ্ধধর্ম বিষয়ক গ্রন্থপঞ্জি হতেই অনুধাবনযোগ্য। তাঁর পঠিত ও ব্যবহৃত গ্রন্থ তালিকার নমুনা নিম্নরূপ :

১. হস্তসার বা বৌদ্ধ মহাপরিত্রাণ, পণ্ডিত ধর্মরাজ বড়ুয়া, ১ম খণ্ড ১৮৯৩ (১৪৩৬ বুদ্ধাব্দ), কলকাতা

২. রত্নমালা, গুণালংকার মহাস্থবির ও পুন্নানন্দ সামী সংকলিত, ১৯১২, বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর বিহার, কলকাতা

৩. মধ্যম নিকায়, অনুবাদ : বেণীমাধব বড়ুয়া, প্রকাশক : অধরলাল বড়ুয়া, কলকাতা

৪. বৌদ্ধ এদাহিল্লা, ডি. এইচ. এস. অ্যাবারেতুয়া, ১৯০৪, কলম্বো

৫. The Jataka, V. Fausboll

৬. The Creed of Buddha, Edmund Holmes,1906

৭. Light of Asia,Sir Edwin Arnold,1879

৮. The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal, Rajendralal Mitra, 1882, Calcutta

৯. Handbook of Pali, O. Frankfurter,1883, London

১০. A Compendious Pali Grammer, B. Clough,1824, Colombo

১১. Kaccayano Pali Grammer, Francies Mason, 1886, Colombo

১২. Dictionary of the Pali Language, Robert Caesar Childers, 1875, London

কেবল রবীন্দ্রনাথের পাঠ্য তালিকা নয়, রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধ বিষয়ে অন্যান্য লেখকদের মূল্যায়নগ্রন্থের তালিকার দিকে চোখ বুলালেই পরিষ্কার হয়ে যায়, বুদ্ধ বিষয়ে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কতটুকু নিবিড় সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ রকম কয়েকটি নির্বাচিত গ্রন্থের তালিকা নিম্নরূপ :

১. রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি : ড. সুধাংশু বিমল বড়ুয়া, ফাল্গুন ১৩৭৪, প্রকাশক : মহেন্দ্রনাথ দত্ত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

২. পালিভাষা-সাহিত্য বৌদ্ধদর্শন ও রবীন্দ্রনাথ, ড. রাধারমণ জানা, এপ্রিল ১৯৮৫, প্রকাশক : অনুপ কুমার মাহিন্দার, পুস্তক বিপণী, কলকাতা

৩. রবীন্দ্র সাহিত্যে বৌদ্ধ সংস্কৃতি, জ্যোতিপাল মহাথের, আশ্বিনী পূর্ণিমা ১৪০৪, প্রকাশক : সঞ্জয় বড়ুয়া, বিজয় বড়ুয়া, অজয় বড়ুয়া

৪. বৌদ্ধ ধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ, ডঃ আশা দাশ, ভাদ্র ১৩৭৪, প্রকাশক : কল্লোল প্রকাশনী, কলকাতা

৫. রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধ সংস্কৃতি, সম্পাদকম-লি : সুজিত কুমার বসু গং, অগ্রহায়ণ ১৪১০, প্রকাশক : বিশ্বভারতী, কলকাতা

৬. রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধচর্চা, সম্পাদনা : হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী, আগস্ট ২০১১, প্রকাশক : সুমিত্রা কুণ্ডু, একুশ শতক, কলকাতা

৭. Studies in Tagore and Buddjist Culture, Dr. Sudhangshu Bimal Barua, Buddha Purnima 1991, Publisher : Debjyoti Dutta, Shishu Sahitya Samsad, Calcutta

৮. জগজ্জ্যোতি : রবীন্দ্র মননে বুদ্ধ, সম্পাদনা : হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী, জানুয়ারি ২০১২, বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা, কলকাতা।

রবীন্দ্রনাথ বারে বারে বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্বীকার করেছেন এবং লিখেছেন, ‘...আমি বুদ্ধভক্ত। ’ বরং বুদ্ধগয়ায় গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, যে সময় সেখানে বুদ্ধের পবিত্র চরণ স্পর্শ করেছিল, সেই সময়ে তিনি কেন জন্ম নেননি। এ আক্ষেপ তাঁর মনের গভীরে রেখাপাত করেছিল। করাচীতে অবস্থানকালে তাঁকে কোন এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার গুরু কে? রবীন্দ্রনাথ বিনা সঙ্কোচেই জবাব দিয়েছিলেন, বুদ্ধদেব। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, দশবলসম্পন্ন বুদ্ধ বোধিসম্পন্ন হওয়ার ধ্যানে সসৈন্য মারকে বিজয় করেছিলেন তাঁর নিবিড় ও গভীর ধ্যানে। তাই সংসারের কূট-পঙ্কিলতা পাড়ি দিতেই তিনি গানে গানে মানুষকে সচেতন করে বলেছেন,

‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো

এই বিষম ঝড়ের বায়ে

আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে

আমি মারের সাগর পাড়ি দেব গো’।

জগত-শাস্তা বুদ্ধের শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথ জানলেন, অত্তাহি অত্তনো নাথ, কোহি নাথ পরসিয়া। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের ত্রাতা। মানুষকে ত্রাণ করবে সেরকম আর কেউ নেই। রবীন্দ্রনাথ এই শিক্ষা নিয়েই ‘আত্মত্রাণ ’ কবিতায় বলেছেন,

‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা

বিপদে আমি না যেন করি ভয়

দুঃখ-তাপে ব্যথিত চিতে নাইবা দিলে সান্ত¡না

দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’

বুদ্ধ আরো বলেছেন, অত্তদীপ বিহারথ। অত্ত সরণা অঞঞ সরণা। অর্থাৎ নিজেই নিজের দীপ হয়ে জ্বলো। নিজের শরণই বড় শরণ। বুদ্ধের এই দেশনাকে অন্তরে ধারণ করেই রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন,

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে

তবে একলা চলো রে।

সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর মানুষকে অভিধর্ম দর্শনের আলো বিতরণ করে বুদ্ধ আশি বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণে দেহাতীত অর্হত্ত্বে লোকান্তরিত হয়েছেন। বুদ্ধভক্ত রবীন্দ্রনাথও কাব্যগীতের অঞ্জলিতে মানুষকে অন্তরালোকনে আলোকিত করে ‘সোনার তরী’ বেয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভবনদী। বুদ্ধ মানুষকে প্রজ্ঞার দর্শন দিয়ে গেছেন। সেই প্রজ্ঞার দ্বিবিধ গুণ। যথা : ভেদন ও অবভাসন। অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান মানুষ অন্যের হৃদয়কে প্রজ্ঞাবলে ভেদন করতে পারে। প্রজ্ঞাবান মানুষ প্রজ্ঞার ধারে মিথ্যাদৃষ্টিকে আলাদা করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ সেই প্রজ্ঞা লভেছিলেন বলেই অন্তর্লালিত সত্যে বলতে পেরেছিলেন,

‘শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য

করুণাঘন ধরণীতল করহ কলংক শূন্য

এস দানবীর দাও ত্যাগ কঠিন দীক্ষা

মহাভিক্ষু লও সবার অহংকার ভিক্ষা।’

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়