প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
সমকালীন দেশ, সমাজ এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ঘিরেই শিল্প-সাহিত্যের পরিপুষ্টি। লেখক সমাজসত্তার অংশ হিসেবে সমাজপরিবর্তনের প্রতি দায়বদ্ধ। বাংলা সাহিত্যে দেশের রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক বাঁক পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক। দেশ-বিভাগ পূর্ববতী ও পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের (১৯২০-১৯৭৫) নাম। দেশ-বিভাগ পরবর্তী ঢাকায় আগমনের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শহিদ হওয়া পর্যন্ত তাঁর উত্তাল-বিক্ষুব্ধ-রাজনীতিক কর্মকাণ্ড এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তান আমল ও স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প- সাহিত্যে বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রভাব অবশ্যম্ভাবীভাবে লক্ষণীয়। তাঁর প্রতি বাঙালির ভালোবাসার অকৃত্রিম প্রকাশ ঘটেছে বাংলাদেশের কথাশিল্পীদের লেখনীতে। কবিতার মতো বিশাল পরিসরে না হলেও বাংলা ছোটগল্পে তাঁকে নিয়ে অসংখ্য গল্প লেখা হয়েছে। গল্পকারদের ভাবনায় তিনি চিত্রিত হয়েছেন নানা মাত্রায় ও আঙ্গিকে।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে সাহিত্য রচনা স্বল্প পরিসরে হলেও মূলত তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যার পর প্রচুর কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে; এখনো লেখা হচ্ছে। তাঁকে নিয়ে লেখা ছোটগল্পগুলোর অধিকাংশই সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। গল্পকার রাহাত খান, বুলবুল ওসমান, আহসান ওয়াহিদ, আবুল ফজল, আনিসুল হক প্রমুখ বঙ্গবন্ধুর জীবনের সত্যকার ঘটনা নিয়ে গল্প লিখেছেন। ব্যক্তি ও রাজনীতিক শেখ মুজিবের জীবনের নানা ঘটনা লেখকগণ তুলির আঁচড়ে মনোমুগ্ধকরভাবে বর্ণনা করেছেন। তবে প্রতীকী এবং রূপক অর্থেও কিছু-কিছু গল্প রচিত হয়েছে। গল্পগুলোতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় অর্জন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ; পরবর্তীতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, সর্বশেষ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে কতিপয় পথভ্রষ্ট দুষ্কৃতকারীদের ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড পরিচালনা এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা- এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বছর খানেক পরে লিখিত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিয়ে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী ছোটগল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’। গল্পের লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খ্যাতিমান কথাশিল্পী আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩)। তিনি তখন সামরিক সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা। কিন্তু পদ ও পদবি তাঁর বিবেককে লুপ্ত করতে পারেনি। ‘সমকাল’ (১৯৫৭) নামক মাসিক পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশের পরপরই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাজেয়াপ্ত হয় সকল কপি। বাক-স্বাধীনতা রুদ্ধ করা পরিবেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে গল্পটি রচিত হয়। এ গল্পে লেখক ঐ সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরেন। আবুল ফজল বিবেকের দায় ও ভাবনা হতেই গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সোহেলীকে নির্মাণ করেন। গল্পটি ইতিহাস বর্ণনা-নির্ভর কোনো কাহিনি নয়; তবে গল্পের সোহেলীর মধ্য দিয়ে ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির পরিণতিতে দগ্ধ, পীড়িত ও ক্ষুব্ধ এক নারীর করুণ আর্তনাদের চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে তাদের মধ্য থেকে বিদেশে পালিয়ে থাকা একজন খুনির স্ত্রী গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সোহেলীর মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতির দগ্ধ প্রাণের স্ফুরণ ঘটিয়েছেন তিনি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িত এক সামরিক কর্মকর্তা গভীর অনুশোচনা ও অপরাধবোধে ভুগে অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়- তার চিত্রও এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।
আবুল ফজলের ‘ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’ও বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী ঘটনা নিয়ে রচিত। গল্পে বঙ্গবন্ধুর ছোটো চাচা শেখ আহমেদ আলীর মাধ্যমে শেখ মুজিবের নির্ভীকচিত্ত ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু কখনো গোপন রাজনীতি বা আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করেননি। একাত্তরে ইয়াহিয়ার সশস্ত্র বাহিনী যখন হামলা চালিয়ে সমস্ত ঢাকা শহর তছনছ করে, তখনও তিনি নির্ভীক; গ্রেফতার হওয়ার ভয় করেননি। বরং বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন ‘রক্ত দিয়েছি। প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেবো’। নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও পলায়ন করেননি। গ্রেফতারের পর জল্লাদের মাঝখানে থাকলেও অকম্পিত হাতে লাইটার টিপে পাইপ জ্বালিয়ে টানতে লাগলেন। ১৫ আগস্ট ভোর রাতেও তেমনি শান্ত নির্বিকারভাবে পাইপটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এলেন আক্রমণকারীদের সাথে কথা বলতে। একাত্তরে হানাদাররা ভিনদেশি হলেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাহস পায়নি; কিন্তু পঁচাত্তরে স্বদেশি ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো তাঁর বুক কিন্তু পিঠ ছিল অক্ষত। সে পিঠ স্বাধীন বাংলার প্রাচীর।
বুলবুল ওসমানের (১৯৪০-) ‘মাঝি বায়া যা’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একটি অসামান্য ছোটগল্প। এখানে এক অসীম সাহসী ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়; যিনি কিনা বলেন, পথে ডাকাত ধরলে তাদের সাথে গল্প করে সময় কাটাবেন। চৈত্র মাসের এক সন্ধ্যায় দীর্ঘদেহী, কণ্ঠস্বর ভারী, পরনে ঢোলা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, চুল আর গোঁফে কিছুটা পাক ধরা, ভারিক্কি ভাবের এক ব্যক্তি সিরাজ মাঝির নৌকায় করে স্রোতের বিপরীতে নদী পাড়ি দিচ্ছিলেন। সিরাজের ভাতিজা দুইজনের মাধ্যমে জানা যায় পথে ডাকাতের ভয়। পথিমধ্যে ডাকাতদের তিনটি নৌকা তাদের পিছু নিলে মাঝিরা ভয় পায়। কিন্তু নৌকার ভিতর থাকা মানুষটি নিস্তরঙ্গ স্বরে কেবল বলেন, ‘মাঝি, বায়া যা...।’ ডাকাত দল ফাঁকা গুলির আওয়াজ করে নৌকা থামাতে বলে যখন জানতে পারল নৌকায় শেখ মুজিব রয়েছেন, তখন তাদের নৌকা থেমে যায় এবং একজন বলে ওঠে ‘আগে বলবি তো!’ উল্লেখ্য, ছাত্রাবস্থা হতে অন্যায়ের প্রতিবাদকারী রাজনীতিক শেখ মুজিব গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জীবদ্দশায় ‘মিথে’ পরিণত হন। তাই গভীর নদীতে রাতের অন্ধকারে ‘ডাকাতদল’ও সে সময় মুজিবকে সমীহ করতো।
স্বাধীনতার মাস- মার্চ। এই মাসে সংঘটিত হয়েছে রাজনীতির নানা উদ্দীপনামূলক ঘটনা। ‘মার্চ মাসের গল্প’তে রাহাত খান (১৯৪০-২০২০) অত্যন্ত চমৎকারভাবে ৭০-এর নির্বাচন, গোল টেবিল বৈঠক, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা, ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর) স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠন, নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মদান ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় লাভ এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন- দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণতা লাভের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। গল্পকারের ভাষ্যে, ‘মার্চ থেকেই স্বাধীনতার গল্পটি শুরু হয়েছিল। বাঙালির জীবনে মার্চ তাই অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর একটি মাস। ১৬ ডিসেম্বর, মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ, চারদিকে বেজে ওঠে জনতার কলস্বর : জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
একজন নেতা হঠাৎ বা রাতারাতি নেতা হন না। বরং ধীরে ধীরে রাজনীতির পরিচর্যার মাধ্যমে তিনি পরিশীলিত, অনুপ্রাণিত ব্যক্তিতে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধু গণমানুষের নেতা। অতি সাধারণ মানুষের হৃদয়েও তিনি জায়গা করে নিয়েছেন আপন কর্মগুণে। তাইতো দূর-দূরান্ত থেকে সাধারণ জনগণ তাঁকে এক নজর দেখার জন্য বহু টাকা ব্যয় করে ছুটে আসত। ইমদাদুল হক মিলনের (১৯৫৫- ) ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পে তেমনি একজন ব্যক্তি ভাগচাষি রতন মাঝি পদ্মার ওপারে উদয়পুর গ্রাম থেকে এসেছিল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য এই মহান নেতার সাক্ষাৎ সে পায়নি; কারণ যেদিন সে ধানমন্ডি এসেছিল তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল এবং ঐ রাতেই নেতার আদর্শে বিশ্বাসী (!) একই রাজনীতি করা কতিপয় দু®ৃ‹তকারী দ্বারা নেতা নিহত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, একজন সাধারণ রতন মাঝিকে ঐ রাতে পুলিশ গ্রেফতার করেছিলো যদি সে নেতার কোনো ক্ষতি করে, অথচ তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি নেতার আশেপাশেই ঘাপটি মেরে বসেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা, যার ফলে নেতার মৃত্যু ঘটে-যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বায়ান্ন’র ভাষা-আন্দোলনের ঘটনা অবলম্বনে রচিত আনিসুল হকের (১৯৬৫-) ‘আমি মাথা নিচু করি না’ বাঙালি জাতির জন্য এক চমৎকার উদ্দীপনামূলক গল্প। হৃদরোগ এবং চোখের রোগে আক্রান্ত মুজিব ফরিদপুরের কারাগারে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন তৎকালীন সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য- যদিও তা তাঁকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর মুক্তির আদেশ আসলে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় বড় গেইট বন্ধ থাকলে কারাগার-কর্তা তাঁকে ছোট গেইট দিয়ে মাথা নিচু করে বের হতে বললে তিনি বলেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান কোনোদিনও মাথা নিচু করে কারাগার থেকে বার হয় নাই। আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আমি মাথা নিচু করি না।’ এই ঘটনায় মুজিবের নির্ভীকচিত্ত ও অবিচল মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭-২০০৪) ‘জাদুকরের মৃত্যু’ এক অসামান্য ছোটগল্প। গল্পে তিনি প্রতীক, রূপক এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে দুর্গত বাংলাদেশের চিত্র উপস্থাপন করেছেন। বর্বর দ্বারা শোষিত এই দেশে হঠাৎ জাদুকরের আগমন ঘটে এবং সেই জাদুকর তাঁর অলৌকিক শক্তি ও ইন্দ্রজালের দ্বারা সকলকে মুগ্ধ করে তাদের হারিয়ে যাওয়া শক্তিকে ফিরিয়ে দেয়। গতানুগতিক জাদুকরের মতো এই জাদুকর কোনো তাঁবু কিংবা প্রেক্ষাগৃহে জাদু দেখাতেন না, তিনি জাদু দেখাতেন চৌরাস্তায়, গ্রামের মেঠোপথে। আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভিভূত হয়ে সকলে সেই জাদু উপভোগ করতো এবং তারা স্বপ্ন দেখতো- না দেখা ভবিষ্যতের সোনালি রং (চাষি স্বপ্ন দেখে রোগা গাভির স্বাস্থ্যবান এঁড়ে বাছুর প্রসব, মধ্যবিত্ত যুবকের রুই মাছ, বুড়োর বনোমধ্যে ক্রন্দনরত একটি হরিণ, কিশোরীর আকাশে নীল চাঁদ ও যুবতীর সোনারঙের একটি ঘোড়া দেখার স্বপ্ন)। একসময় এ স্বপ্নগুলোই রূপকার্থে বাস্তবরূপ লাভ করতে থাকে। যেখানে আগে কোনো স্বপ্ন ছিলো না, সেখানে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে; যেখানে কোনো গান ছিলো না, সেখানে গান গাওয়া শুরু হয়েছে; যেখানে কোনো স্মৃতি ছিলো না, সেখানে স্মৃতি জেগে উঠেেছ। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে জাদুকরের সম্মোহনী জাদুর মাধ্যমে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানা বাধা-বিঘœ পেরিয়ে সেই জাদুকরের জাদুর ছোঁয়ায় আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হলো। কিন্তু একদিন বর্বরদের ছুরিকাঘাতে সেই জাদুকরের লাশ শহরের চৌরাস্তায় দেখা গেলো। আবার সব কিছু মলিন হয়ে গেলো। জনগণ আবার স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেল, তারা জীবিত থেকেও মরার মতো পড়ে রইলো। সেই জাদুকর কি আর ফিরে আসবে এই ছোট দেশটিতে? লেখকের ভাষায়, ‘জাদুকরের কথা, খুবই গোপনে, বলত কেউ কেউ; তাঁর কথা মনে হলে তাঁর বুকে গেঁথে থাকা ছুরিকাটিকে মনে পড়ত আমাদের। কোথা থেকে এসেছিল সেই জাদুকর, যে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল? স্বপ্নের মতো সত্য আর সত্যের মতো স্বপ্ন দেখানোর জন্যে সে আবার কবে আসবে?’ সেই জাদুকর হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সাহিদা বেগমের (১৯৫৫- ) ‘সোনালি ভোর’ গল্পে দেখা যায়, ছয় দফা আন্দোলনের ফলে শেখ মুজিবসহ অন্যদের ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় (১৯৬৮) অভিযুক্ত করা হয়। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে তিনি বন্দি। এ সময়ে নিজের ঘর সামলানোর পাশাপাশি দলের রাজনীতি ও জনগণের আন্দোলনকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন মুজিব পত্নী রেণু (১৯৩০-১৯৭৫)। শেখ মুজিব তাঁর সহধর্মিণীকে প্রীতিলতার (১৯১১-১৯৩২) মতো গড়তে চেয়েছিলেন এবং তিনি সফলও হয়েছেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন শাহ মোয়াজ্জেম (১৯৩৯- ) ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম (১৯৩৬-) প্যারোলে মুক্তি নিয়ে শেখ মুজিবকে গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন; কিন্তু সহধর্মিণী রেণুর কঠোর আপত্তিতে তিনি সে পরামর্শ গ্রহণ করেননি। কারণ রেণু বুঝতে পেরেছিলেন পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে আইয়ুব সরকার কেবল মুজিবকে নয়, সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে। এছাড়া রেণু এটাও চাননি মুজিব কেবল একাই প্যারোলে মুক্তি গ্রহণ করুক; কারণ মুজিব সকলের নেতা। তাই সকলকে সাথে করে তিনি যেন মুক্তি নেন। গল্পের শেষে স্বপ্নের মধ্যে পুব আকাশে একটি বড় সূর্যের উদয় দেখা যায়। এই সূর্যোদয়টাকেই রেণুর মনে হয়েছিল সোনালি ভোর- ‘আমাদের দুঃখের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। সুদিন আসছে সামনে। তারই ইঙ্গিত যেন এই স্বপ্ন।’
শেখর দত্তের (১৯৪৫- ) ‘ওরা চারজন’ গল্পে চারজন সুদূর অতীত থেকে মানুষের অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত হতে হতে জন্মলাভ করে এবং লোকালয়ে বিকশিত হতে থাকে। তবে চারজনের জন্ম একসাথে নয় এবং কে, কোথায়, কখন, কীভাবে জন্মগ্রহণ করছে তাও অজানা। ওদের উপলব্ধিতে এলো ওরা মানুষকে কাছে টানছে ঠিকই কিন্তু একটি অপূর্ণতা রয়ে যাচ্ছে, আর তা হলো একজন যোগ্য নেতার নেতৃত্ব। তাই তারা তিল তিল করে গড়ে তুলেছে এঁকেবেঁকে ছুটে চলা বাইগার নদী পাড়ের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের লিকলিকে লম্বা ছেলেটাকে। উদার, জনদরদি, সাহসী, সহিষ্ণু, যুক্তিবাদী, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, বাকপটু মানুষটিকে ওরা চারজন সামনে নিয়ে আসে। তাঁরই নেতৃত্বে মানুষের চেতনায় ওরা চারজন অনবরত আঘাত করতে থাকে এবং স্লেøাগানের ভাষা তৈরি করে দেয়। প্রথমজন ছাত্র-জনতার মুখে তুলে দেয়, ‘আইয়ুব শাহি ধ্বংস হোক, গণতন্ত্র কায়েম করো’। দ্বিতীয়জন আরো সোচ্চার হয়ে স্লোগান দেয়- ‘জয় বাংলা’; ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা’। তৃতীয়জন সবার হৃদয়ে গেঁথে দেয় এই মর্মবাণী- ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। চতুর্থজন গণমানুষকে অনুপ্রাণিত করে স্লোগান দিতে থাকে- ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’; ‘জয় সর্বহারা’। তাদের স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্র-জনতা নেতাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। নেতাও তাদেরকে নিরাশ করেননি। রেসকোর্সের ময়দানে তিনি লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ চারদিকে যুদ্ধের ডামাডোল বেজে ওঠে। ওরা চারজন শত্রুর বিরুদ্ধে আরো সক্রিয় হয়ে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে তোলে এবং সর্বস্তরের জনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিনিয়ে আনে লাল-সবুজের পতাকাবেষ্টিত একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। নেতা ওদের চারজনকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে দেশের সংবিধানে স্থান করে দিলেন। তারা হলেন- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধি।
রশীদ হায়দারের (১৯৪১-২০২০) ‘শেষটাই সত্য’ গল্পে সপরিবারে মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর টুঙ্গিপাড়ায় তাঁদের লাশ আনা এবং দাফন-সংক্রান্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মিলিটারিরা মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় একটি গর্ত করে তাঁকে পুঁতে ফেলতে চেয়েছিলো। কিন্তু সত্তর বছর বয়সী টুঙ্গিপাড়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম শেখ আবদুল হালিম বাধা প্রদান করে। পরবর্তীতে মুজিবের লাশকে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে, কাফনের কাপড় পরিয়ে , জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। গল্পের শেষ দিকে মুজিবের লাশের নড়াচড়া, উঠে বসা এবং স্বাভাবিকভাবে কথা বলার মধ্যদিয়ে অতিপ্রাকৃতের আবহ তৈরি হয়েছে। মুজিবের মৃতদেহ অজপাড়াগাঁয়ে দাফনের মাধ্যমে সামরিক জান্তারা তাঁকে সাধারণ জনগণ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিলো, কিন্তু লাশের নড়াচড়া ও কথা বলার মধ্য দিয়ে লেখক মুজিবের অমরত্বকেই তুলে ধরেছেন, যা সাধারণ পাঠকেরও বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না।
শিরীন বকুলের (?) ‘রাজা ও রাখালের গল্প’-এ একজন সংগ্রামী, বীর, সাহসী, প্রজাবৎসল, জনদরদি, নির্ভীক, অসাম্প্রদায়িক রাজার স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ঐ রাজার বীরত্বের কারণে রাজ্য শত্রুমুক্ত হয়। রাজা রাজ্যের নাম রাখেন আনন্দনগর; ভবনের নাম আনন্দভবন এবং পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর নাম আনন্দিতা। রাজ্যে শত বিপর্যয়ের মধ্যে রাজার দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে দরিদ্র প্রজারা আশ্রয় খুঁজে পায়। বাঁশির সুরে বিমোহিত জন্মণ্ডধর্মণ্ডবর্ণ পরিচয়হীন এক রাখালকে রাজার নির্দেশে আনন্দভবনে আনা হয় এবং নাম দেওয়া হয় আনন্দ। আনন্দকে আনন্দভবনে এনে রাখার মধ্য দিয়ে এক জনদরদি ও অসাম্প্রদায়িক রাজার পরিচয় ফুটে উঠে। কিন্তু আনন্দ রাজাকে দেখে বিস্মিত হয়। কারণ রাজার নেই হীরা-মুক্তা খচিত রাজমুকট ও রাজপোশাাক; নেই কোনো রাজদণ্ড কিংবা তরবারি। তাই তার জিজ্ঞাসু মনের উপলব্ধি- ‘এ কেমন রাজা? সাদা আদ্দির পাঞ্জাবি আর পাঞ্জাবির ওপর কালো কোট, চোখে কালো চশমা, হাতে মোটা এক বই, মুখে কী একটা কাঠি, তা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মনে হয় ছোট হুঁকো জাতীয় কিছু হবে।’ বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে রাজা তাকে সাথে নিয়ে বের হন ন্যূনতম নিরাপত্তা ছাড়া। এক বসন্ত-পূর্ণিমায় কতিপয় সৈন্যের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে আনন্দ সে খবর রাজাকে জানালে রাজা হাসিতে ফেটে পড়েন। ঐ রাজ্যে রাজার বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করবে তা অবিশ্বাস্য। কারণ রাজা প্রজাদের ভালোবাসেন এবং তাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রবল। এক অমাবস্যা রাত্রিতে কতিপয় মানুষরূপী দৈত্য আনন্দভবন আক্রমণ করে রাজা ও তাঁর পরিবারের সকলকে হত্যা করে। এক বিশ্বস্ত অনুচরের সহযোগিতায় আনন্দ (রাখাল) বেঁচে যায়। ঐদিন থেকে স্তব্ধ হয়ে যায় সবকিছু; বাঁশির সুর থেমে যায়, নদীর স্রােত নিশ্চল হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু এক চেতনার নাম, এক বিশ্বাসের নাম। তাঁকে অন্তরে ধারণ করতে হয়, অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি হয়। তিনি অর্থমূল্যে বিক্রিত হওয়া জিনিস নন। শরীফ খানের (১৯৫৩- ) ‘গাছের ভাস্কর্য’ গল্পে সে চিত্রই ফুটে উঠেছে। নির্মিতব্য মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত জিনিস সংরক্ষণের জন্য কর্তারা হীরালাল পাল নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান পায়; যার কাছে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর রুমাল, যে রুমাল দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী সময়ে আহত হীরালালের কপাল ও কনুইয়ের রক্ত মুছে দিয়েছিলেন। সাথে রয়েছে আরো তিনজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার রক্তমাখা গামছা-গেঞ্জি। কিন্তু চমকপ্রদ যে ঘটনাটি তারা দেখতে পায়, তা হলো-হীরালাল পালের বাড়ির পেছনে শতবর্ষ পুরানো দুটি সেগুন গাছে বঙ্গবন্ধুর দুটি ভাস্কর্য। একটি হলো ৭ মার্চের ভাষণের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো উদ্ধত আঙুল। অন্যটি সেই শোকাবহ রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়- ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে পাইপ ধরা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর লাশ। বঙ্গবন্ধুর রুমাল, মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তভেজা গেঞ্জি ও গামছা এবং ভাস্কর্য দুটির বিনিময়ে ওরা দুই লক্ষ টাকা সম্মানী দেওয়ার প্রস্তাব করলে রতনের জিজ্ঞাসু মনের প্রশ্ন- ‘ও ঠাকুরদা! বঙ্গবন্ধু কি বিক্রি হবার জিনিস। তারে ভালোবাইসে গড়িছি। রঙ করতি সাহায্য করিছে আমার মা, বছর বছর রঙ করিছি। ভালোবাসা কি বেচা যায়? ...শিকড় তো মাটির অনেক তলায়।’
দিলারা মেসবাহর (১৯৫০- ) ‘বঙ্গের বন্ধু’ গল্পে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চে কালরাত্রির ভয়াবহতা, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে লাল-সবুজের পতাকা অর্জন, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলা পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আহসান ওয়াহিদের (১৯৬২- ) ‘দ্য পাওয়ার’ গল্পটি বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী ঘটনা নিয়ে রচিত। ইতিহাস বিকৃতির এক জঘন্যতম দৃষ্টান্ত এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। গল্পের শেষে সঠিক ইতিহাস বর্ণনাকারী ব্যক্তিকেই গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় যেতে হয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত মহিমাকে ম্লান ও বিকৃত করার যে অশুভ চেষ্টা চালিয়েছিলো সে চিত্রই এখানে উপস্থাপিত হয়েছে।
কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো (১৯২৬-২০১৬) বলেছিলেন,‘আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।’ রশীদ হায়দারের ‘পর্বত’ গল্পে যে মুজিবের কথা বলা হয়েছে, সেই মুজিব উদারতায়, উচ্চতায় হিমালয়কেও ছাড়িয়ে গেছেন। তীব্র শীতের প্রকোপ থেকে মুক্তি পেতে সুদূর রাশিয়া থেকে পাখিদের একটি দল বাংলাদেশে আসতে চায় এ দেশের রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং মহানায়কের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া দেখতে। কিন্তু পাখির দল হিমালয় অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে গেলে একটি পাখি মানুষের ছায়ার কারণে বাধার সম্মুখীন হয়। কারণ পাখিটি যত উপরে ওঠে, ছায়াটা আরো ওপরে ওঠে। তখনই-
‘ছায়ার আকাশভরা গমগমে কণ্ঠস্বর শোনা যায়,
ধাক্কা লাগলেও ব্যথা পাবে না।
পাবো না?
না আমি তো হাত বাড়িয়েই আছি।’
এই ছায়াই রূপকার্থে মুজিব, যার ভালোবাসা ও উদারতা সকলকে আপন করে নিতো, কাউকে ব্যথিত করতো না।
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, সোনার মানুষ। শিশুরা যদি সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে তাহলে সে দেশ উন্নতির দ্বারপ্রান্তে সহজেই পৌঁছতে পারে। বঙ্গবন্ধু সেটি জানতেন, অন্তরে উপলব্ধি করতেন; আর তাই শিশুদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর অসীম ভালোবাসার কারণেই ১৯৯৭ সালে সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে শিশুদের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। বঙ্গবন্ধু ও শিশুদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম (১৯৬৪- ) অনেক গল্প লিখেছেন। তার ‘বঙ্গবন্ধু ও একটি শিশু’ গল্পে শিশু রমযানের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। সুবিধাবঞ্চিত শিশু রমযানকে বঙ্গবন্ধুর কল্যাণে স্কুলে ভর্তি, নতুন জামা-কাপড় দেওয়া এবং বাবাকে দারোয়ানের চাকরি দেওয়া হয়। কেবল রমযানই নয়, এসকল সুবিধাবঞ্চিত শিশুর জন্য বঙ্গবন্ধু কাজ করে গেছেন আজীবন। শিশুদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনাই লেখকের ভাষ্যে ফুটে উঠে এভাবে- ‘শিশুরা যদি বড় হয়, সত্যিকারভাবে তাদের যদি মানুষ করা যায়- তবে বাংলাদেশ একদিন সোনার বাংলাদেশ হয়ে উঠবে।’ ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে চাই’ গল্পে ক্লাস সেভেনে পড়া এক শিশু বঙ্গবন্ধুর আঁকা একটি ছবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিতে এলে তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে কাছে আসার অনুমতি দেন এবং তার আঁকা ছবিটি দেখে খুব প্রশংসা করেন। এখানেও দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শিশুদের কখনো নিরাশ করতেন না, বরং উৎসাহ দিতেন। ‘বঙ্গবন্ধু এবং সোনালি শিশুদের গল্প’-এ দেখা যায় বিলবোর্ডে দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু মুজিব কোট এবং সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা তাঁকে দেখছে এবং কথা বলছে। বঙ্গবন্ধুও তাদের সাথে কথা বলতে বলতে চোখ ছলছল করে ওঠে এবং বলেন, ‘আমি তো তোমাদের জন্যই সংগ্রাম করেছিলাম। তোমাদের জীবন হবে সুখী ও সুন্দর। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে। ... আমি তোমাদের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। আবার যদি জীবন পাই, আবারও উৎসর্গ করব সেই জীবন। শুধু তোমাদের জন্য।’ জীবিত বঙ্গবন্ধু ফিরে না আসলেও তিনি চিরভাস্বর হয়ে আছেন আমাদের চেতনায়। শিশুদের জন্য তাঁর এই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব তাঁরই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (১৯৪৭- ) হাতে নিয়েছেন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই শিশুরা একদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলবে। জীবিত অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর শেষ জন্মদিনেও শিশুদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। ১৭ মার্চের সেইদিনে বঙ্গবন্ধু গণভবনে গাড়ি থেকে নামলে ‘কচি-কাঁচার মেলা’র একদল মেয়ে গান গেয়ে ওঠে- ‘সে যে মোদের সবার প্রিয়/ সকলের আদরণীয়/ সকল কাজে বরণীয়/ বিভু, তোমায় এই মিনতি/ দীর্ঘ জীবন তারে দিও/ সফল জীবন তারে দিও।’ কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ হয়নি ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফলে।
ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে (১৮৬৯-১৯৪৮) নিয়ে রিচার্ড অ্যাটেনব্রো (১৯২৩-২০১৪) নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘গান্ধী’ (১৯৮২)। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে (১৮০৯-১৮৬৫) নিয়ে স্টিভেন স্পিলবার্গ (১৯৪৬- ) তৈরি করেছেন ‘লিংকন’ (২০১২) নামে সিনেমা। ‘ও ক্যাপটেন, মাই ক্যাপটেন’ (১৮৬৫) এই শিরোনামে বিখ্যাত কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) লিখেছেন অসামান্য কবিতা (আমেরিকার জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আততায়ীর হাতে নিহত হলে তাঁর মৃত্যু নিয়ে রচিত কবিতা)। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির পিতা বর্ণবাদ বৈষম্য আন্দোলনের মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩) মারা গেলে তাঁর স্মরণে থাবিসো মোহারে (?) লেখেন ‘অ্যান অর্ডিনারি ম্যান’ (২০১৩)। জর্জ ওয়াশিংটনকে (১৭৩২-১৭৯৯) নিয়ে জেমস রাসেল লাউয়েল (১৮১৯-১৮৯১) লিখেছেন ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ (১৮৭৫) নামে বিখ্যাত কবিতা। আফ্রো- আমেরিকার মানবাধিকার কর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে (১৯২৯-১৯৬৮) নিয়ে রচিত হয়েছে মিজ জ্যাকি ওয়েজম্যানের (১৯৩৪-২০২২) ‘সিং অ্যাবাউট মার্টিন’ (২০০৫)। যুগে যুগে এভাবে মহান ও বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে রচিত হয়েছে প্রচুর কবিতাণ্ডগান-গল্প-নাটক-উপন্যাস-চলচ্চিত্র প্রভৃতি। তেমনি বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে দেশে-বিদেশে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। তাঁকে নিয়ে যত লেখা ও গবেষণা হয়েছে বিশ্বের আর কোনো নেতা বা রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে তা হয়নি। বিশেষ করে, ৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো, সেই বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের হৃদয়ে, চেতনায় জ্বলজ্বল করতে লাগল। গান্ধীকে নিয়ে কবি অরুণমিত্র (১৯০৯-২০০০) বলেছিলেন, ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশো গান্ধী যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য।’ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর গান্ধীর স্থলে মুজিব বসিয়ে শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১) বলেছেন ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশো মুজিব যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য।’
শেখ মুজিব একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি অধ্যায়। বর্ণিত গল্পগুলোতে আমরা তাঁকে জাতির ক্রান্তিকালে দৃঢ়, সক্রিয়, আপসহীন ও সাহসী ভূমিকায় দেখি। ঘাতকরা তাঁকে যতই দীপ্তিহীন করার চেষ্টা করেছিলো, তিনি ততটাই দীপ্তিমান হয়েছেন। ইতিহাসের মহানায়ক কতিপয় দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করলেও সাহিত্যে তিনি শাশ্বত, চিরন্তন।
লেখক পরিচিতি : মোঃ সাইদুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ, চাঁদপুর।
মোবাইল: ০১৮১৫৫৬৮২১৭। ই-মেইল: [email protected] ।