প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৭:২৩
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে লক্ষ্মীপুরে ৩২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ

২০৩০-সালের মধ্যে সবার জন্যে পর্যাপ্ত ও সমতাভিত্তিক পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবন রীতিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং খোলা জায়গায় মলত্যাগের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি)-এর অর্থায়নে লক্ষ্মীপুরে টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থের এক তৃতীয়াংশ অর্থে এসব নির্মাণ কাজ চলছে। ফলে প্রশ্ন রয়েছে এসবের মান নিয়েও। অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত ৬দিন ধরে ১০নং রায়পুর ইউনিয়নের ১নং ও ২নং ওয়ার্ডে ল্যাট্রিন নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছেন মেম্বার ও সুবিধাভোগীরা।
সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে নিম্নমানের তৈরি করা ল্যাট্রিনের রিং ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ল্যাট্রিন নির্মাণে জেলার প্রায় ঠিকাদারদের সাথে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারাও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।জানা যায়, ‘মানবসম্পদ উন্নয়নে গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ৩০ জেলার ৯৮টি উপজেলায় দরিদ্র জনগণের জন্যে নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন কার্যক্রম চলছে। বিশ্বব্যাংক ও এআইআইবি থেকে ৯৭ শতাংশ ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাকি ২ শতাংশ টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে সরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। কাজ শেষ হবে চলতি ২০২৫ সালে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় নির্বাচিত এলাকায় অতিদরিদ্রদের জন্যে সারা দেশে ৩ লাখ ৫১ হাজার ২৭০টি হতদরিদ্র পরিবারে বিনামূল্যে টুইন পিট ল্যাট্রিনের কাজ চলছে। যার মধ্যে লক্ষ্মীপুরের তিন উপজেলার ৪১টি ইউপি চেয়ারম্যানদের সহায়তায় প্রতিটি ইউনিয়নে ২২৯টি পরিবারের তালিকা তৈরি করে প্রকল্পের সহযোগী এনজিও জেভি-৩ ড্রপ অ্যান্ড ওয়াটার এইডের স্থানীয় প্রতিনিধিরা।
লক্ষ্মীপুর সদরের ২১টি ইউনিয়নের জন্যে ৪ হাজার ৮০৯টি, রায়পুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের জন্যে ২ হাজার ২৯০টি ও রামগঞ্জ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের জন্যে ২ হাজার ২৯০টি করে ৯ হাজার ৩৮৯টি টয়লেট নির্মিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রতিটি টুইন পিট ল্যাট্রিন নির্মাণে ৩৫ হাজার ১০৮ টাকা করে বরাদ্দ রয়েছে। রায়পুরসহ তিন উপজেলার ল্যাট্রিন নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ৩২ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১২ টাকা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। কাজ চলছে নামকাওয়াস্তে । বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে এতো নিম্নমানের কাজ হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
প্রতিটি ল্যাট্রিন নির্মাণে কিছু ইট, ১০টি রিং, দুটি স্ল্যাব এবং ৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের সিমেন্টের তৈরি পিলার এবং কিছু টিন প্রয়োজন। কিন্তু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ উপকরণ নির্মাণে দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন। কাজগুলো নিম্নমানের হচ্ছে বলেও অভিযোগ আসছে। রিং ও স্লাব ভেঙ্গে গেলে সেগুলো জোড়াতালি দিয়ে পুনরায় ল্যাট্রিন নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে প্রকল্প কর্তৃক ব্যয় ৩৫ হাজার ১০৮ টাকা ধরা হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ২২/২৫ হাজার টাকা। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এগুলো নির্মাণে সর্বোচ্চ ১০/১২ হাজার টাকা ব্যয় করছে।
বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার (২৪-২৫ জুলাই) চরআবাবিল, চরবংশী ও দশ নং রায়পুর ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নিম্নমানের ইটের সুড়কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রিং ও স্ল্যাব। ভেঙ্গে যাওয়া রিং স্লাবও জোড়াতালি দিয়ে লাগানো হয়েছে। যার ফলে এগুলোর মান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
একটি টয়লেট পাওয়া রায়পুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের চরপলোয়ান গ্রামের চৌধুরী বাড়ির দিনমজুর সলেমান বলেন, বুধবার নিম্নমানের কংকর দিয়ে টয়লেট নির্মাণ করতে আসছে ঠিকাদার। এই বাড়ির ৫ পরিবারের টয়লেটের কাজের অবস্থা খুবই নিম্নমানের। এ টয়লেট এক বছরও টিকবে না, এটা থেকে ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
রায়পুরে চরবংশী ও চরআবাবিল ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৫ জন জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে জনপ্রতিনিধিরা তালিকায় নাম উঠাতে ২-৪ হাজার টাকা নিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে ভিডিওতে বক্তব্য দিতে রাজি হননি কেউ।
রামগঞ্জ উপজেলার নঁওগা, করপাড়া, দরবেশপুর গ্রাম ও সদর উপজেলার পার্বতিনগর, মান্দারি, হাজিরপাড়া, টুমচর ও লাহাকান্দি গ্রাম, উত্তর হামছাদি ইউনিয়নের ১,২, ৩ নং ওয়ার্ডে এবং দালালবাজার ইউনিয়নের ১, ২, ৩ নং ওয়ার্ডে ল্যাট্রিন নির্মাণের কাজ চলছে। এই গ্রামগুলোর গরীব পরিবারগুলোও জানান, টয়লেটের কাজের অবস্থা খুবই নিম্নমানের। এ টয়লেট এক বছরও টিকবে না, এটা থেকে ভেঙ্গে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
প্রকল্পের সহযোগী এনজিওর রায়পুর, রামগঞ্জ ও সদর উপজেলার ফ্যাসিলিটেটররা জানিয়েছেন, টয়লেটগুলোর নির্মাণ কাজ তদারকি করতে গিয়ে দেখেছেন ঠিকাদাররা নিম্নমানের ইট বালু দিয়ে রিং স্ল্যাব তৈরি করছেন। এ বিষয়ে তারা তাৎক্ষণিক ঢাকার প্রকল্প অফিসকে অবহিত করেন। নির্বাহী প্রকৌশলী এসব দেখেও না দেখার অবস্থায় রয়েছেন।
রায়পুর, সদর ও রামগঞ্জের কয়েকজন ঠিকাদার জানান, প্রতিটি টয়লেট নির্মাণে তারা সর্বোচ্চ ২৩-২৫ হাজার টাকা পাচ্ছেন। ভ্যাট. ট্যাক্স এবং অফিস খরচ এর মধ্যেই।
রায়পুর উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী রমিজ উদ্দিন বলেন, বিশ্ব ব্যাংক তদন্তের পর আপনাকে তথ্য দেয়া হবে। আপনি (সাংবাদিক) হয়ে কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে আসছেন ? রামগঞ্জ উপজেলার জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান কথা বলতে রাজি হননি। সদর উপজেলার জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী ফাতেমাতুজ্জহুরা মনিকা বলেন, কাজের মান খারাপ হওয়ায় একটি জায়গায় তৈরি করা কয়েকটি ল্যাট্রিন ভেঙ্গে দেয়া হয়। এই কাজগুলো চারটি সংস্থা তদারকি করছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী বিলকিস আকতার বলেন, নিম্নমানের কংকর দিয়ে ল্যাট্রিন করা হচ্ছে-- এ সংবাদ পেয়েছি। আরও খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।