প্রকাশ : ২০ মে ২০২২, ০০:০০
পবিত্র মাহে রমজান আমাদের কাছে এসেছিল রহমত, বরকত,মাগফিরাত নিয়ে। রমজানের নেক আমল গুলো হচ্ছে রোজা, তারাবি, সাহরি, ইফতার, কোরআন তেলাওয়াত, দান-সদকা তাসবীহ-তাহলীল।
রমজানের প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব রমজান হিসেবে দেয়া হয়। দীর্ঘ একটি মাস সিয়াম সাধনা করে বান্দা আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দাতে পরিণত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা চান বান্দা সবসময় আল্লাহ তা’আলার ইবাদতে লেগে থাকুন। কোন বান্দা স্বেচ্ছায় নেক আমল করলে আল্লাহ তাআলা তার প্রতিদান দান করেন।
নেক আমলের মধ্যে রোজা অন্যতম একটি নেক আমল। রোজায় মানুষের বহুবিধ উপকার সাথিত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময়ে রোজার তাৎপর্য তুলে ধরেন। আইয়ামে বীজের রোজাসহ বিভিন্ন সময়ে রোজার গুরুত্ব প্রদান করেন।
পবিত্র রমজানের পরবর্তী মাস শাওয়াল। শাওয়াল ইসলামি মাসগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসের বহুবিধ তাৎপর্য রয়েছে। আরবি চন্দ্রবর্ষের দশম মাস শাওয়াল। এটি হজের তিন মাসের (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) অগ্রণী। এ মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদ। পয়লা শাওয়াল সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা এবং ঈদের নামাজ পড়া ওয়াজিব। এই মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হজের, এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে ঈদের, এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রোজা ও রমজানের এবং এর সঙ্গে যোগ রয়েছে সদকাহ ও জাকাতের। এ মাসের ৭ তারিখে তৃতীয় হিজরি সনে (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে) ওহুদ যুদ্ধে হয়েছিল। এই মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী।
শাওয়াল মাসে বিয়ে-শাদি সুন্নাত, যেরূপ শুক্রবারে ও জামে মসজিদে ও বড় মজলিশে আকদ অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্নাত। কারণ মা আয়িশার বিয়ে শাওয়াল মাসের শুক্রবারে মসজিদে নববিতেই হয়েছিল। (মুসলিম শরীফ)।
শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখা রমজানের রোজা কবুল হওয়ারও পরিচায়ক। আল্লাহ তাআলা কোনো বান্দার আমল কবুল করলে, তাকে অনুরূপ আরও আমল করার তৌফিক দান করেন। নেক আমলের প্রতিদানের একটি রূপ হলো আবার আরও নেক আমল করার সৌভাগ্য অর্জন করা। তাই নামাজ, রোজা, তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি বাকি ১১ মাসও বজায় রাখতে হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা শাওয়াল মাসের ছয় দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি এই মাসে ছয় দিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তাকে প্রত্যেক সৃষ্ট জীবের সংখ্যার সমান নেকি দেবেন, সমপরিমাণ গুনাহ মুছে দেবেন এবং পরকালে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন।’
শাওয়াল মাসের যেকোনো সময় শাওয়ালের রোজা রাখা যায়। ধারাবাহিকভাবে বা মাঝে মধ্যে বিরতি দিয়েও আদায় করা যায়।
শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার নিয়ম হচ্ছে একাধারে রাখা যায় বা একটি রেখে কয়েকদিন পর আরেকটি রাখা যায়।
এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আবু আইয়ুব (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল এরপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখল সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল।”[সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিজি, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ]
রমজানের ৩০টি রোজার সঙ্গে শাওয়ালের ছয়টি রোজা যুক্ত হলে মোট রোজার সংখ্যা হয় ৩৬। আর প্রতিটি পুণ্যের জন্য ১০ গুণ পুরস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে কোরআনুল কারিমে। তাহলে ৩৬টি রোজার ১০ গুণ হলে ৩৬০টি রোজার সমান (এটি পুরস্কারের দিক থেকে)। অর্থাৎ সারা বছর রোজার সমান সওয়াব হবে।
হজরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান। সুতরাং এই হলো এক বছরের রোজা।’ (নাসায়ি : ২/১৬২)
সুরা আনআমের ১৬০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি একটি সৎকাজ করল, সে ১০ গুণ সওয়াব পাবে। এ হিসাবে যে ব্যক্তি রমজানের এক মাস রোজা রাখল, সে ১০ মাস রোজা রাখার সওয়াব পাবে। আর ছয়টি রোজার ১০ গুণ ৬০ দিন। অর্থাৎ দুই মাস। আর এই দুই মাস মিলে ১২ মাস রোজার সওয়াব।
হজরত উবাইদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি সারা বছর রোজা রাখতে পারব?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমার ওপর তোমার পরিবারের হক রয়েছে। কাজেই তুমি সারা বছর রোজা না রেখে রমজানের রোজা রাখো এবং রমজান-পরবর্তী শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখো, তাতেই সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাবে। ’ (তিরমিজি : ১/১৫৭)
এ হাদিসকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য বাণী দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের পরে ছয়দিন রোজা রাখবে সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল : যে ব্যক্তি একটি নেকি করবে সে দশগুণ সওয়াব পাবে।”
অন্য বর্ণনাতে আছে- “আল্লাহ এক নেকিকে দশগুণ করেন। সুতরাং এক মাসের রোজা দশ মাসের রোজার সমান। বাকী ছয়দিন রোজা রাখলে এক বছর হয়ে গেল।” [সুনানে নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ]হাদিসটি সহিহ আত-তারগীব ও তারহীব (১/৪২১) গ্রন্থেও রয়েছে।
সহিহ ইবনে খুজাইমাতে হাদিসটিএসেছে এ ভাষায়- “রমজান মাসের রোজা হচ্ছে দশ মাসের সমান। আর ছয়দিনের রোজা হচ্ছে- দুই মাসের সমান। এভাবে এক বছরের রোজা হয়ে গেল।”
এ ছাড়া শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার আরও ফায়দা হচ্ছে- অবহেলার কারণে অথবা গুনাহর কারণে রমজানের রোজার উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে থাকে সেটা পুষিয়ে নেয়া।কেয়ামতের দিন ফরজ আমলের কমতি নফল আমল দিয়ে পূরণ করা হবে।
যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কেয়ামতের দিন মানুষের আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাযের হিসাব নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের রব ফেরেশতাদেরকে বলেন –অথচ তিনি সবকিছু জানেন- তোমরা আমার বান্দার নামায দেখ; সে কি নামায পূর্ণভাবে আদায় করেছে নাকি নামাযে ঘাটতি করেছে। যদি পূর্ণভাবে আদায় করে থাকে তাহলে পূর্ণ নামায লেখা হয়। আর যদি কিছু ঘাটতি থাকে তখন বলেন: দেখ আমার বান্দার কোন নফল নামায আছে কিনা? যদি নফল নামায থাকে তখন বলেন: নফল নামায দিয়ে বান্দার ফরজের ঘাটতি পূর্ণ কর। এরপর অন্য আমলের হিসাব নেয়া হবে।[সুনানে আবু দাউদ]
পরিশেষে বলা যায়, রোজা একটি উৎকৃষ্ট নেক আমল। রমজানের রোজার পর শাওয়ালের ছয় রোজা মাহে রমজানের রোজা কে পরিপূর্ণ করে দেয়। রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখার দ্বারা এক বছর রোজা রাখার সওয়াব আল্লাহ তায়ালা দান করেন।
তাই আমরা অবহেলা না করে এই মাসের ছয়টি রোজা রাখি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখার তৌফিক দান করুক আমিন।
লেখক : ইমাম ও খতিব: বিষ্ণুপুর, মনোহরখাদী, মদিনা বাজার বাইতুল আমিন জামে মসজিদ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।