প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
দু'বছর আগের কথা,পঞ্চম শ্রেনির ছাত্রী আনিকা (ছদ্মনাম)-এর দিন শুরু হয় ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে গিয়ে দুপুর অবধি পড়াশোনা করে। স্কুল ছুটি হলে বাসায় ফিরে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই বিকেল না হতেই লুকিয়ে লুকিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া। গোল্লাছুট,দাড়িয়াবান্ধা, বৌচি কিছুই যেনো বাদ যায় না। শুধু আনিকারই নয় তার সময়ের অধিকাংশ শিশুর শৈশবের শুরুটা গড়ে উঠত এলাকার ও আশেপাশের পাড়ার সঙ্গীদের সাথে। বিকেল হলেই যেন এলাকা মেতে উঠত হৈ-হুল্লোড়ে। আনিকা কখনো ভাবেনি তার দুরন্তপনার এই দিনগুলো বদলে যাবে কোভিড-১৯-এর কালো মেঘে।
বিষয়টি পরিষ্কার হয় যখন তারই ছোট ভাই যে কিনা বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে। এটা ঠিক তারও সকাল কাটে স্কুলে, তবে স্কুলের সময়টা ছাড়া বাকি সময়টা যেনো বদলে গেছে সম্পূর্ণ। দুপুরের খাওয়া শেষে মায়ের মোবাইলটা চুপি চুপি নিয়ে বসে পড়ে মোবাইল গেমস খেলতে। বড় বড় ইংরেজি নামের সেই গেমসগুলোর কথা ওর মাথায় ঢুকুক বা না ঢুকুক দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরোলেও, মোবাইল থেকে যেনো তার চোখ সরে না। পঞ্চম শ্রেণিতেই তার চোখে পরে গেছে ভারী ফ্রেমের চশমা। বড় বোন আনিকা যখন তার বন্ধুদের নিয়ে গল্প করে, তখন সে যেনো খুঁজে পায়না একজন কাছের বন্ধু বা খেলার সাথী। আনিকার ভাইয়ের মত আজকের অবস্থা বাংলাদেশের হাজারো শিশুর। বাসায় বসে অতিরিক্ত মোবাইল, ট্যাব, কম্পিউটারে গেমস খেলায় কোনো শারীরিক উন্নতি তো তাদের হচ্ছেই না বরং মানসিকসহ শরীরের নানান নেতিবাচক সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাদের।
বিষয়টি শুধু এখানেই থেমে নেই, বর্তমানে শিশুদের ওপর বেড়েছে পড়াশোনার চাপ। বিষয়টা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে সৃজনশীল করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করা হলেও মানুষের চিন্তাশক্তি ও মানসিকতা এখনো সেই মুখস্থবিদ্যাতেই আটকে আছে, যা শিক্ষার্থীদের কাছে একরকমের চাপ হিসেবে রূপ নিয়েছে। এই চাপের কারণে খেলার সুযোগ পায় না এখনকার শিশুরা। যতটুকু অবসর সময় পাওয়া হয়, তা সবাই আলস্যে মোবাইল ব্যবহারের মধ্যে কাটাতে পছন্দ করে। খেলাধুলার পাশাপাশি বই পড়তে বা অন্যান্য সৃজনশীল কাজ করতে পছন্দ করা শিশুর সংখ্যা হয়ে গেছে হাতে গোণার মত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের খেলাধুলা করা বাধ্যতামূলক। খেলাধুলার ভেতরে যে আনন্দ থাকে তা শিশু মনের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক। খেলার জন্য বড় মাঠের প্রয়োজন নেই। বাসার সামনে অল্প জায়গা হলেও খেলা যায় বা কিছু শারীরিক কার্যক্রম যেমন- হাঁটাহাঁটি, দৌড়াদৌড়ি, দড়িলাফ দেওয়া যায়। এ সকল শরীরের ক্লান্তি, একঘেঁয়েমি, বিষণœতা, মানসিক চাপ দূরে সরিয়ে মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে। খেলাধুলা শিশুর মধ্যে নেতৃত্ববোধ ও পরমতসহিষ্ণুতা তৈরি করে। বুঝতে শেখে হার-জিত বিষয়টাকে।
খেলাধুলা -
১. উপস্থিত বুদ্ধি বৃদ্ধি পায়। তাৎক্ষণিক ভাবে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যায় তা একটি শিশু এই খেলাধুলার মাধ্যমে শেখে। বড় হলে এই উপস্থিত বুদ্ধিই পারবে শিশুকে কঠিন থেকে কঠিনতর সমস্যা সমাধানে।
২. শিশুর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। একটি শিশুকে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝাতে সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টা কাজ করে তা হলো তার পর্যবেক্ষণ শক্তি। ছোট্ট এই জিনিসটিই পারে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ থেকে শিশুকে রক্ষা করতে।
৩. শারীরিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখতে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। খেলাধুলার কারণে শিশুর শরীরের মাংসপেশিগুলোর সঠিক ব্যায়াম হয়। এতে করে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অক্ষুণœ থাকে।
৪. সৃজনশীলতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা ও পড়াশোনার প্রতি শিশুর আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে কয়েকজন মিলে একসাথে খেলার পরিবেশ অনেকখানি সাহায্য করে। এতে শিশুর মাঝে সহোযোগিতার মনোভাব তৈরি করে।
৫. শিশু নানা ধরনের নৈপুণ্য, দক্ষতা শিখতে পারে। ক্রিকেট, ফুটবল কিংবা দাড়িয়াবান্ধা, বৌচি এরকম খেলাগুলোতে ছুটাছুটি করার সুযোগ থাকায় এসব খেলার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক কাঠামো মজবুত হয়।
৬. শিশুদের মস্তিষ্কের সঠিক বিকাশ সহজতর হয়,
যার ফলে তারা পড়াশুনা, আচার-আচরণ, বুদ্ধিমত্তাতে এগিয়ে থাকে।
৭. রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করায় শিশু সহজে কোনো রোগে আক্রান্ত হয় না। তাদের কল্পনাশক্তি ও চিন্তাশক্তি বাড়ে, যার কারণে তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার সঠিক বহিঃপ্রকাশের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
খেলাধুলা বা শারীরিক কার্যক্রম শুধু শিশুদের জন্য নয়, শিশু থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্ক মানুষ সকলের শারীরিক সুস্থতার নিশ্চিতকরণের চাবিকাঠি। পড়ালেখার পাশাপাশি অভিভাবকসহ সকলের উচিত বিকেলে কিছুটা সময় হাতে নিয়ে আশেপাশে ঘুরতে, খেলতে বা হালকা কিছু শারীরিক ব্যায়ামণ্ডহাঁটাহাঁটি, প্রতিবেশীদের সাথে গল্প করতে বেরিয়ে পরা। এতে স্বাস্থ্য ও মন উভয়ই প্রফুল্ল থাকবে। সৃজনশীলতার হাত ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ্য কারিগর হবে আজকের শিশু।