শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩

ধারাবাহিক উপন্যাস-১৬

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এতক্ষণ পর আমি বুঝতে পারছি নরেনদা কেন আমায় আটকালেন। আমি না বলতে চাইলেও তিনি ঠিকই ধরতে পারছেন আমার অবস্থা। রাত তখন আটটা প্রায় অনিমেষ সারোয়ারকে ইশারা দিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। আমি আর নরেনদা বাসায় একা এখন। পাশের বাড়ির বিশাখা মেয়েটা এসে কী যেন একটা দিয়ে গেল। আমরা তিনজন বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছি। মেয়েটা বেশ মিশুক ক্ষণিকেই আপনজনের মতো মিশে যায়। তার কথাবার্তায় মনে হয় না যে সে কোনো অপরিচিতজন। বিশাখার চলে যাওয়ার পর দাদা আমার কাছে এসে বসলেন।

‘সকালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাগটা গুছিয়ে সোজা চলে আসবে এখানে। বাসায় শুধু বলে এসো তুমি কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছ।’

‘কাকে বলব দাদা। কে শোনবে আমার কথা।’

‘তারপরও বলবে। পিটারÑতোমার সমস্যাগুলো আমাদের চাইতে অনেক বেশি কিন্তু হেরে যাওয়া চলবে না। জীবনের যুদ্ধে তুমিও একজন যোদ্ধা এটা ভুলে যেও না।’

আমি কান্না আর ধরে রাখতে পারিনি। নরেন্দ্র দা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আর বুঝানোর চেষ্টা করছেন। আমার কান্না কিছুতেই থামছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলাম বুকটা হালকা লাগছে।

‘আমার পেনশন অ্যাকাউন্টে সামান্য কিছু টাকা জমা আছে সেটা কাল তুলে নিব।’

‘প্রয়োজন নেই। আমাদের যার কাছে যা আছে তা দিয়ে চলে যাবে। তোমার সে টাকা মেডিকেল সিকিউরিটির জন্য থাকুক।’

‘আর বাঁচবই বা কত দিন। আপনাদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যেতে আমার কাছে ভালো লাগবে না দাদা। আমাকে এটাতে বারণ করবেন না।’

‘এসো ডিনারটা সেরে নেই। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আস আমি ডাইনিং এ অপেক্ষা করছি।’

আমার নিজের আত্মসম্মানকে আজ ওরা বজায় রাখল। নরেন্দ্র দা ও অনিমেষ বেশ চৌখুস তাই পুরো বিষয়টাকে সহজে মানিয়ে নিলেন। নরেন্দ্র দা কেন আমাকে আগামীকাল চলে আসতে বলছেন আমি এবার বুঝতে পারছি। তার নিজস্ব কোনো কাজ নেই উদ্দেশ্য আমাকে তিনবেলা ভরপেট খাওয়ানো। মুখ খুলে বলেনি আমি লজ্জা পাব বা আমার আত্মসম্মানে লাগবে বলে তাই কৌশলটা অবলম্বন করেছেন। সারোয়ার টের পেলে বোধ হয় লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দিত। বেশ আবেগী একটা মানুষ তাছাড়া একসাথে যখন চাকরি করতাম তখন থেকেই আমার প্রতি দুর্বল ছিল। ফ্রেশ হয়ে আসতেই দেখি নরেনদা আমার জন্য খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে। এখন রাত নয়টা আমাদের মতো ব্লাড সুগার পেশেন্টদের জন্য ডিনারের এটাই উপযুক্ত সময় অথচ বাসায় আমার খাওয়া হয় আরও অনেক দেরিতে। টেবিলে মনমোহন সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছে। শীতের রাত তাই ঠান্ডা কিছুই ভালো লাগবে না তাছাড়া আমি আজ ওদের অতিথি তাই যা কিছুই আছে আপ্যায়নটা হবে গতানুগতিকের চাইতে একটু ভিন্ন। টেবিলে রাখা ভাতগুলো থেকে ধোঁয়া উঠছে তারমানে রান্না হয়েছে সহসাই।

‘এসো পিটার, সবকিছু গরম করা আছে। চটজলদি খেয়ে না নিলে এগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে তখন আবার খেতে ভালো লাগবে না। বিশাখা বড় মাছের কালিয়া দিয়ে গেল। ওর মায়ের হাতের রান্না বেশ সুস্বাদু হয়, আমি খেয়েছি বহুবার। ওদের ওখানে মাছের কালিয়া রান্না হলে আমার জন্য দিয়ে যাবেই। এক কাজ কর এখান থেকে শেয়ার করি আমরা দুজনে।’

‘বিশাখা বেশ লক্ষীমন্ত একটা মেয়ে আর মিশুকও বটে। আপনার তো মেয়ে নেই তাই মেয়ের গ্যাপটা সে পূরণ করে দিয়েছে।’

‘তা বলতে পার। একটা ঘরে মেয়ে থাকা সত্যি ভাগ্যের বিষয়। আমার সে সৌভাগ্য না হলেও তার কিছুটা এই মেয়ে পূরণ করছে। আমার রাজীবের সাথে একসাথে বড় হয়েছে বুঝলে। দুজনের মাঝে বেশ বন্ধুত্ব সেই ছোটবেলা থেকেই।’

‘দাদা আগামী চার-পাঁচ দিন কক্সবাজারে কীভাবে কী করবেন সেটা কী গোছাতে পেরেছেন?’

‘সবে তো যাওয়ার প্ল্যান করলাম তুমি টেনশন নিও না সেটাও হয়ে যাবে। কাল চলে আস তারপর বসে প্ল্যান করে নিব।’

রাতের ডিনার শেষে আমি চলে আসি বাসায়। দরজা খুলে রুমে আসতেই দেখি নাতিন একটা প্লেটে করে কিছু একটা নিয়ে এসেছে। পাশে বসে চুপিচুপি বলছেÑতুমি এটা খেয়ে নাও গ্রান্ডপা, সারাদিন কিছু খাওনি। আমার কেমন যেন মায়া লেগে গেল। এইটুকু বাচ্চা আমার সারাদিন না খাওয়াটা টেনশন করছে অথচ আমার নিজের সন্তান সেটা করছে না, সবই নিয়তি। দাদা ঠিকই বলেছিলÑকারো ঘরে মেয়ে থাকা সত্যি ভাগ্যের বিষয়। এ ঘরে আমার অ্যাঞ্জেল এই নাতিন। বাটিতে করে তার আনা খাবার আমি না করে দেই আর বলি আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। সে কিছুতেই বিশ্বাস করছে না তারপর বহু কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হই। খুব ভোরে ঘুম ভাঙলেও আমার আর সেদিন পার্কে যাওয়া হয়নি। এ জীবনে কভু কক্সবাজার যাব তা ভাবতেই পারিনি তাই ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি। এদিকে বাসায় সকাল ৯টার মধ্যে যার যেমন নাশতা সেরে কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি ডাইনিং এর সামনে গিয়ে বড় ছেলেকে বাইরে যাওয়ার বিষয়ে বলতেই সে একপ্রকার রেগে যায়। বলেÑসন্তানরা কষ্ট করছে আর উনি গায়ে বাতাস লাগাতে কক্সবাজার যাবেন। বউ সাথে সাথে বলে উঠলÑওহ্ গড, ঢং দেখে আর বাঁচি না। কথাগুলো একটা সময় মনে কষ্ট দিত কিন্তু এখন সয়ে গেছে। নরেন্দ্র দা বলেছিল বাসায় বলে আসতে তাই বলা আর কী! পরিবারে আমার প্রয়োজনটা ফুরিয়ে গেছে আরও আগে। এখন তো রান্না-বান্নাও আমার হিসেবে হচ্ছে না আর। বেহায়ার মতো যা পাই তাই কোনোরকম খেয়ে ক্ষুধা মিটাই। বাসাটা আমার নামে সেজন্য বের করে দিতে পারছে না নতুবা সেটাও করত হয়তো। ব্যাগটা নিয়ে সরাসরি চলে আসি নিকুঞ্জ নিকেতনে।

‘কী ব্যপার পিটার আজ পার্কে আসলে না কেন?’

‘সময় করতে পারিনি দাদা। জামা-কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে গিয়েই দেরি করে ফেলেছি।’

‘তা এতসব কাপড় কেন নিলে! বছর খানেকের জন্য যাচ্ছ নাকি?’

‘না দাদা কখন কোন জায়গায় যাই তাই সে মোতাবেক কাপড় কিছু বাড়তি নিয়ে নিয়েছি আর বাকিটা প্রয়োজনীয় সামগ্রি।’

‘বুঝতে পারছি। শোনÑভ্রমণ করার একটা সহজ বিষয় হলো তোমার যতটুকু প্রয়োজন অর্থাৎ না নিলেই নয় এরকম কিছু সামগ্রি নিয়ে ভ্রমণ করবে। ব্যাগ যত হালকা থাকবে তোমার বহন করতে ততই সহজ হবে। ব্যাগ ভারী হলে সমস্যা হয় বহন করতে, তখন ঘুরবে না গাধার মতো বোঝা বহন করবে। তুমি বরং এখান থেকে কিছু জামা কাপড় কমিয়ে নাও আর আরেকটা কথা তোমার ওষুধগুলো কিন্তু সাথে নিয়ে নিবে নতুবা দেখা গেল কিছু আইটেম সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না তখন ঝামেলায় পড়ে যাবে বুঝলে।’

‘ঠিকই বলেছেন দাদা আমি ব্যগ হালকা করব আর আজই ব্যাংক থেকে ফিরার পর ওষুধগুলো নিয়ে আসব। প্রেশক্রিপশন সাথে নিয়ে নিয়েছি।’

‘চল চা নাশতা সেরে আমরা বেড়িয়ে পড়ি। আমিও আমার ব্যাংকে যাব টাকা তুলতে তারপর কিছু কেনাকাটা করে ফিরব বাসায়। তোমাকে একটা বিষয় বলেছিলাম করতে করেছিলে?’

‘হ্যাঁ ছেলেকে বলেছিলাম সকালে।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী রেগে গিয়ে বলেÑসন্তানরা কষ্ট করছে আর উনি গায়ে বাতাস লাগাতে কক্সবাজার যাবেন।’

‘চা নাও। আমার একটা বিষয় জানার ছিল কিন্তু তোমাকে জিজ্ঞেস করতে পারব না বলে বলেছিলাম বাসায় বলে দিতে।’

‘যা জানার ছিল তা কী জানতে পেরেছেন দাদা।’

‘অবশ্যি, যা বোঝার তা বুঝে গেছি তবে তোমাকে বলার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না তাই কখনো সেটা জানতেও চেও না।’

‘না দাদা চাইব না কারণ জীবনের কাছ থেকে লেনদেন বুঝে নিয়েছি আর এখন কারো কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, চাওয়া নেই, অধিকার নেই।’

‘তাহলে জীবনের মূলমন্ত্র মনে গেঁথে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাও নিজের মতো করে। কক্সবাজার যাচ্ছি আমাদের জন্য। ফেলে আসা অতীতকে ভুলে বর্তমানে বাঁচতে শিখার জন্যই এই আয়োজন। এই কয়েকটা দিন শুধু নিজের জন্য বাঁচ দেখবে জীবনের আফসোসগুলো ধীরে ধীরে উধাও হতে থাকবে। চল নাশতা শেষ এবার আমরা আমাদের কাজে নেমে পড়ি।’

‘দাদা আপনি এর আগে কখনো কক্সবাজার গিয়েছিলেন?’

‘অনেকবার।’

‘বাকিরাও কী গিয়েছিল?’

‘হুম শুনেছি সকলেই কম বেশি গিয়েছে সেখানে।’

‘তাহলে কক্সবাজারের আয়োজন কী শুধু আমার জন্যই করা হলো?’

‘হা হা হা...

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলি দাও,

তার মতো সুখ কোথাও কী আছে

আপনার কথা ভুলিয়া যাও...

আমরা চাইলে না বলেও বহুকিছু বুঝিয়ে দিতে পারি, দাদা সেটাই করেছেন কবিতার চরণগুলো বলে। বিষয়টা আমিও বুঝেছিলাম তবুও জানার আগ্রহ জন্মেছিল। এখন আমার চারপাশে বিষণ্নতা আর অবমূল্যায়নের দেওয়াল তার মাঝে যখন গ্রহণযোগ্যতা কোথাও পাই তখন বুঝতে পারলেও কানে শুনতে বেশ আগ্রহী হয়ে যায় মন। মূল্যয়ন পেতে আমারও মন চায় কারণ আমি মানুষ।’

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়