প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৫
মিজানুর রহমান রানার মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক উপন্যাস
এই জনমে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আঠারো.
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। এই প্রদেশের খারান এলাকায় বসবাস করে আওরঙ্গজেব। চাকুরি থেকে অবসর পেয়েছে ক’বছর আগে। তার বয়স এখন প্রায় ৭০। ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকে। স্ত্রী মারা গেছে প্রায় দশ বছর আগে।
আওরঙ্গজেব এখন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। কেউ তার পাশে নেই। ছেলেমেয়েরাও তার খোঁজখবর নেয় না। তারা জানে একাত্তরের যুদ্ধে তার বাবা বাংলা নামক অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছেন। এসব কথা তারা তার মায়ের কাছে জেনেছে। এরপর থেকে তারা তার বাবাকে ঘৃণা করতে শিখছে। বাবার সাথে দূরত্ব বেড়েছে।
সে যখন ঘুমায় তখন একে একে দুঃস্বপ্নেরা তার ঘুমের ঘোরে হানা দেয়। সেখানে অনন্যা, রূপালি, ঈশানবালাসহ সব নির্যাতিত নারী ও পুরুষরা তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। সে এসব দুঃস্বপ্ন কিছুতেই মুছতে পারে না। প্রতিদিন তাকে হাই পাওয়ার ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাতে হয়। তারপরও এসব নির্যাতিত মুখ থেকে সে রক্ষা পায় না। মাঝে মাঝে এদেরকে দেখে সে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠে। আশেপাশের বাড়ির মানুষরা দৌড়ে চলে আসে। জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে?
সে কোনো উত্তর দিতে পারে না। মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হয়ে একা একা পথ হাঁটে সে। আর বিড় বিড় করে মনে মনে বলে, ‘আমি কি ভুল করেছি?’ তারপর আবার নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিয়ে বলে, ‘এটা তো আমার চাকুরিকালীন আদেশ ছিলো, দায়িত্ব ছিলো। আমাকে যেভাবে আদেশ করা হয়েছিলো, আমি তা-ই করেছি। তাহলে আমার ভুলটা কোথায়?’
এই এলাকাটা অনেক গরম। গরমকালে এখানে তাপমাত্রা উঠে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় গাছপালা সব পুড়ে যায়। মানুষের মন-মগজও গরমে উত্তপ্ত হয়ে উঠে।
আওরঙ্গজেব ভাবলো সে স্থান পরিবর্তন করবে। তাই সে কিছুদিনের মধ্যেই তার সমস্ত জমিজমা বিক্রয় করে সাথে নগদ অর্থ নিয়ে রাজধানী ইসলামাবাদের দিকে রওয়ানা হয়। বেলুচিস্তান থেকে বাসে করে প্রথমে সে তুরবাত শহরে আসে। এখানে একটি হোটেলে উঠে সে। তারপর সেখানে নারী সম্ভোগে মেতে থাকে। এর মধ্যে এক নারীকে তার পছন্দ হয়। সেই নারীর নাম নওশিন আতিয়া। বেশ সুন্দরী নারী। বয়স ২৫-এর কোঠায়।
তাকে নিয়ে দুদিন হোটেলে অবস্থান করে রাত প্রায় দশটার দিকে ইসলামাবাদে যাওয়ার জন্যে একটি গাড়ি ভাড়া নেয়। নওশিন আতিয়াকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেই চালক গাড়ি চালাতে থাকে।
নওশিন আতিয়ার গায়ের ঘ্রাণ আওরঙ্গজেবের বেশ পছন্দ। সে তার আরও নিকটবর্তী হয়ে বসে। ভাবে, ইসলামবাদে গিয়ে একটা বাড়ি কিনবে, তারপর তাকে নিয়েই তার বাকি জীবনটা চালিয়ে যাবে। নারীটি বেশ সুন্দরী, কথাবার্তায়ও চমৎকার।
ভাবতে ভাবতে সুন্দর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেতে দেখতে কিছুদূর যাবার পর একটা অন্ধকার স্থান এলে চালক হঠাৎ করেই গাড়ি থামায়।
উৎকণ্ঠিত আওরঙ্গজেব চালককে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে? গাড়ি থামালে কেনো?’
চালক উত্তর দেয়, ‘সামনের পাহাড়ের ওদিকে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়েছে ডাকাতরা। তাই সামনে যাওয়ার পথ নেই। এখন কী করবো?’
‘তাহলে পেছনে ঘোরাও দ্রুত, ওরা এসে পড়লে বিপদ হতে পারে।’
চালক গাড়িটা পেছনে ঘোরানো শুরু করার সাথে সাথেই চারদিক থেকে প্রায় দশটি টর্চের আলো খুবই দ্রুত ছুটে আসে। তাদের হাতে চকচকে তলোয়ার। মুখোশপরা ভয়ঙ্কর ডাকাতরা টেনে-হেঁচড়ে আওরঙ্গজেব ও নওশিন আতিয়াকে গাড়ি থেকে নামায়। ওরা গাড়িতে থাকা আওরঙ্গজেবের সবক’টি ব্রিফকেস থেকে টাকাগুলো বের করে আনন্দের হাসি হাসে। তারপর সেই ব্রিফকেসগুলো লুট করে নিয়ে যায়।
আওরঙ্গজেব এ সময় তাদেরকে বলে, ‘আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। তোমরা আমার সাথে যা করছো, তার জন্যে তোমাদেরকে পস্তাতে হবে। খুব শীঘ্রই অ্যারেস্ট হবে।’
ডাকাতরা এ কথা শুনে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। একজন অন্যজনকে বলে, ‘ওরে খতম না করলে আমাদের বিপদ হতে পারে। মেরে ফেল ওকে।’
‘না, মেরো না, আমার তো যা কিছুই ছিলো সবই নিয়েছো, আমাকে মেরে তোমাদের কী লাভ?’
কে শোনে কার কথা! মানুষকে দয়া দেখানো ডাকাতদের কাজ নয়। ডাকাতদের কাজই হলো নিষ্ঠুরতা ও ভোগ বিলাসিতা। সেটাই আওরঙ্গজেব দেখলো শেষ জীবনে।
ডাকাতদের চকচকে ধারালো তলোয়ারের আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে রইলো আওরঙ্গজেব। এ সময় চিৎকার করে উঠলো নওশিন। আওরঙ্গজেব দেখলো ডাকাতরা তার ব্রিফকেসগুলোসহ নওশিন আতিয়াকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় সে শুনতে পেলো হাজারো বাঙালি নারী-পুরুষের আর্তনাদ-- ‘আমাদের মেরো না, আমাদের মেরো না, আমাদেরকে ছেড়ে দাও, দোহাই আল্লাহর।’
রক্তক্ষরণ হতে হতে আওরঙ্গজেব এক সময় নিস্তেজ- নিষ্প্রাণ হয়ে পড়লো রইলো তপ্ত বালুকাময় জমিনে।
একটি মৃত্যু মানুষের সব দম্ভ, ক্ষমতা সব কিছুই কেড়ে নেয়। পৃথিবীতে পড়ে থাকে শুধু তার কৃতকর্ম। মানুষ বুঝে না, তারা শুধু পৃথিবীতে আসে পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে। মানুষ হিসেবে কে কতোটা সফল তা নির্ভর করে শুধুমাত্র আচরণে। মানুষ পৃথিবীতে এসে অর্থবিত্ত, ক্ষমতার মায়াজালে জড়িয়ে সবকিছুই ভুলে যায় শুধু নিজের স্বার্থ ছাড়া। ব্যক্তিস্বার্থের কাঙাল মানুষ সবকিছু পেতে হয়ে যায় অমানুষ।
এই জনমে নারীর মায়াজাল সম্পদের লোভ, ব্যক্তিগত মোহ আর ক্ষমতার অহঙ্কার ছিন্ন করা অত সহজ কাজ না। কেউ পারে, আর কেউ তা’ পারে না।
নওশিন আতিয়া ডাকাতদের গাড়িতে উঠেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তারপর তাদের সাথে হাত মেলায়। ভাগ-বাঁটোয়ারা করে টাকাগুলো সবাই গুণে গুণে পকেটে ভরে।
নওশিন আতিয়াই হোটেল থেকে ডাকাতদের আওরঙ্গজেবের খবর দিয়েছিলো!
জহিরুল হক খান মুক্তিযুদ্ধ শেষে তাঁর অদম্য সাহসিকতার জন্যে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত হন। এরপর সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। তাঁর তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া ছিলো না। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা বেশ ভাবতেন, সহকর্মীদের খোঁজ খবর নিতেন। কেউ যদি বিপদে পড়তো তাহলে দ্রুত তার পাশে দাঁড়াতেন।
২ নভেম্বর ২০১২ সাল। একদিন সন্ধ্যায় একটি ক্লাবে তার সাথে দেখা হয়ে যায় আমিরের। দুজনেই একে অপরের কুশলাদি নিলেন। সুজানার খবরও নিলেন। তারপর খাওয়া দাওয়া করে বিদায় নিলেন।
সেই রাতে তিনি ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখলেন।
তিনি দেখলেন, মেঘের অন্ধকার রাজ্যে একটা সুন্দর সিঁড়ি। সেই সিঁড়িতে সবাই উঠতে পারছে না। কারণ কারো কারো কাছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ছিলো না। কিন্তু তার নিজের কাছে অনেক পাওয়ারফুল একটা আলো। সেই আলোতে তিনি পথ চিনে চিনে সিঁড়িতে উঠে চলেছেন। এ সময় একজন লোক তার কাছে আলো চাইলো। তিনি দেখলেন, লোকটা আওরঙ্গজেব। পাকিস্তানি আর্মি অফিসার।
সে বললো, ‘ভাই আমাকে কি একটু আলোর ব্যবস্থা করা যাবে?’
জহিরুল হক খান উত্তর দিলেন, ‘তোমার আলো নেই কেনো?’
‘ভাই দুনিয়াতে তো আমি অনেক পাপ করেছি, অন্যায় করেছি। তাই সৃষ্টিকর্তা আমাকে অন্ধকারেই রেখেছেন। আলোর ব্যবস্থা দুনিয়াতে করে আসতে পারিনি। বুঝতে পারিনি যে, এই পাড়ে আসতে হলে দুনিয়াতেই মানুষকে আলোর পথে ডাকতে হবে। ভালো কাজ করতে হবে, তাহলে এই জগতে আলোর ব্যবস্থা হবে।’
‘ওহ, তাহলে আমি আলো পেলাম কীভাবে?’
‘তুমি তো সত্যের পক্ষে ছিলে, মানুষকে আলোর সন্ধান দিয়েছিলো, তাই তুমি পাওয়ারফুল আলো পেয়েছো।’
এ সময় পাশের টিমটিমে লাইটের আলোতে চলা একজন বললো, ‘তুমি দুনিয়াতে যা করেছো, এখানে তার প্রতিদান পাবে। এটাই আল্লাহতায়ালার ওয়াদা। বিন্দু পরিমাণও কাউকে তিনি ছাড় দিবেন না।’
জহিরুল হক খান তাকে চিনে ফেললেন, ‘এ যে হেকমত আলী!’ তিনি তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এই সামান্য আলো পেলে কীভাবে? তুমি তো রাজাকারদের দোসর ছিলে?’
‘আমি সারাটা জীবন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে চাইতে মানুষের উপকার করার অন্তর নিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলাম। আল্লাহ মানুষের অন্তরটা দেখেন। অন্তরের অনুশোচনাই আল্লাহকে খুশি করে, মানুষের পাপ মার্জনা করতে সহযোগিতা করে।’ উত্তর দিলো হেকমত আলী।
এ সময় মাথা চাপড়াতে লাগলো আওরঙ্গজেব। সে বার বার মাথা ঠুকতে ঠুকতে বললো, ‘আমি কেনো ক্ষমা চাইলাম না, আমি কেনো ক্ষমা চাইলাম না, আমি কেনো ভালো কাজ করলাম না ...।’
এ সময় জহিরুল হক খান কারো সাথে ধাক্কা খেলেন। তারপর নিজের আলোটা তার মুখে ধরে দেখলেন এবং বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘এ যে মেহের জল্লাদ! কী হয়েছে তোমার? তোমার কোনো আলো নেই কোনো? অন্ধকারে পথ চলবে কীভাবে?’
মেহের জল্লাদ কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো, ‘হায়, আমি যদি জানতাম দুনিয়ার অর্থ সম্পদ, গাড়ি-বাড়ি ছেলে সন্তান, ক্ষমতার বাহাদুরি এখানে কোনো কাজে আসবে না, তাহলে আমি উত্তম কাজ করে আসতাম। তখন তো ভেবেছিলাম, দুনিয়াটাই সব। দুনিয়াতে যা করি, সেটাই আসল। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, দুনিয়ার মোহ আমাকে ভুলিয়ে রেখেছিল। আমার নফস ও শয়তান আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিলো। আমি সত্য-মিথ্যার প্রভেদ বুঝতে পারি নাই। তাই আমি ক্রমাগত আল্লাহর শাস্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ...। আমার কোনো আলো নেই। অন্ধকার আর অন্ধকারেই আমার বসবাস ...। দুনিয়াতে যদি আর একটিবার যেতে পারতাম, তাহলে ভালো ভালো কাজ করে আসতাম।’
ধীরে ধীরে সব অস্পষ্ট ঘোলাটে হতে লাগলো। হঠাৎ করেই জহিরুল হক খানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি উঠে বসলেন। তারপর এক গ্লাস পানি পান করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত ৫টা ১৫ মিনিট। এ সময় ফজর নামাজের আযান হলো। তিনি উঠে তার স্ত্রী সাবিনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন নামাজ পড়ার জন্যে। তারপর তাকে স্বপ্নের কথা জানালেন। প্রশ্ন করলেন, ‘আমি হঠাৎ করে এমন স্বপ্ন দেখলাম, যার মানে বুঝতে পারলাম না।’
সাবিনা দীর্ঘদিন স্বামীর ঘর করেছে, তিনি তাঁর স্বামীর বিষয়ে ভালো জানেন। তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘যারা ভালো মানুষ তারা এমন স্বপ্নই দেখে। হয়তো আল্লাহতায়ালা তোমাকে ভালোবাসেন বলেই এমন স্বপ্ন দেখিয়েছেন।’
তাঁরা দুজন একত্রে পাশাপাশি ফজর নামাজ আদায় করলেন। এ সময় সাবিনা দেখলেন তাঁর স্বামী আল্লাহর কাছে সুন্দর একটি স্বপ্ন দেখার জন্যে শোকরিয়া আদায় করলেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
প্রার্থনা শেষ হবার কিছুক্ষণ পরই জহিরুল হক খান অসুস্থতা বোধ করেন। এরপর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করে তাঁকে সুহিলপুর পাঠানপাড়ায় কবরস্থ করা হয়। তাঁর জানাজায় হাজার মানুষের ঢল নেমেছিলো। আমির ও সুজানাও খবর পেয়েছিলো। তারা অধরা, ইরফানসহ তাদের দলের সবাইকে খবর দিয়েছিলেন।
জানাজা শেষে সবাই হাত তুলে জহিরুল হক খানের জন্যে দোয়া করলেন। এরপর আমির ইরফানকে বললেন, ‘গতকাল রাতেও জহিরুল হক খানের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। একদম তরতাজা মানুষ, কোনো রোগ-বালাই ছিলো না। আল্লাহ তাকে সুন্দর একটা মৃত্যু দিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী সাবিনার কাছে শুনেছি ফজরের নামাজের পর তিনি আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এরপরই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।’
অধরা, তুষার, ইমতিয়াজ, রূপালি, ঈশানবালা, সুজানা নির্বাক। অনন্যা ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে ইরফানের দিকে। সে ভাবছে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ লড়াই, দেশপ্রেম, বীরত্বগাথা মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের কল্যাণে কাজ করতে সাহস যোগায়। আর দেশের শত্রুদের কীর্তিকাণ্ড ও শেষ পরিণতি মানুষকে সতর্ক হয়ে সঠিক পথ চিনে নিতে সাহায্য করে।
সেই রাতে আবারও অধরা একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। সে দেখলো, দুবছরের একটি খুব সুন্দর শিশু তার হাত ধরে টানতে টানতে বলতে লাগলো, ‘মা উঠো, মা উঠো, আমি খুব দ্রুতই আসছি তোমার কাছে। তুমি আমাকে আদর করবে না?’
অধরার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সে তার পেটে হাত দেয়। তারপর আদর করে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা, আমার আদরের ধন। তোমার জন্যেই আমি অপেক্ষা করছি। কবে আসবে তুমি?’
ইরফানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে অধরাকে প্রশ্ন করে, ‘ঘুমের ঘোরে কার সাথে কথা বলছো?’
অধরা হাসতে হাসতে জবাব দেয়, ‘আমাদের অনাগত সন্তানের সাথে কথা বলছি, সে বলছে শীঘ্রই সে আসছে...।’
এই জীবনেই সুখ-দুঃখ আসে পালাক্রমে। সুখের সময়গুলো হয়তো দ্রুত কেটে যায়! তবে কঠিন ও বিপদের কোনো ঘটনা যেন জীবনের সব আনন্দও বিষাদময় করে তোলে। জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো খারাপ ঘটনার স্মৃতি নিয়েই জীবন কাটাতে হয়। সুখের সময়গুলো সেভাবে মানুষকে স্মৃতিকাতর করে না তুললেও, ভয়ংকর কোনো স্মৃতি আজীবন মনে রয়ে যায়। চাইলেই তা ভোলা যায় না। তারা আমাদের মস্তিষ্কের সংবেদনশীল কেন্দ্রে ভীতিকর স্মৃতির গঠন অধ্যয়ন করছে- অ্যামিগডালা এবং তাদের প্রক্রিয়াটির পেছনে একটি কারণ রয়েছে। স্ট্রেস নিউরোট্রান্সমিটার নরপাইনফ্রাইন ফাংশনগুলো মস্তিষ্কের অ্যামিগডালায় প্রতিরোধক নিউরনকে উদ্দীপিত করে মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াকরণের ভয় দেখায়, যাতে বৈদ্যুতিক স্রাবের পুনরাবৃত্তিমূলক বিস্ফোরণ প্যাটার্ন তৈরি হয়। ফলে মানুষের খারাপ স্মৃতিগুলো দীর্ঘদিন ধরে মনে গেঁথে থাকে। যা মোছা বড়োই কঠিন।
দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত পার হয়েছে। অপূর্ব এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রূপালি মাঝে মাঝে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অপূর্বর চেহারাটা হয়েছে ঠিক ক্যাম্পের সেই অফিসারটার মতো। রওনক হাসান। অপূর্বর চেহারাটা দেখে যখন রওনক হাসানের চেহারা ভেসে উঠে তখন রূপালির মাথায় খুন চেপে বসে। সে সহ্য করতে পারে না। আজ সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। জীবনটা আর এভাবে পার করা যাবে না। এর একটা শেষ তাকে দেখতেই হবে।
ইমতিয়াজ গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত। রূপালি ধীরে ধীরে উঠে, তারপর রান্নাঘর থেকে বটি দা’টি বের করে। ক্রমে ক্রমে এক পা দুপা করে অপূর্বর কামরায় প্রবেশ করে।
অপূর্ব ঘুমাচ্ছে। ধীরে ধীরে রূপালি তার বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। ঠিক যখনই অপূর্বর গলায় কোপটা দিতে যাবে তখনই অপূর্ব জেগে উঠে। তারপর মৃদু লাইটের আলোতে মাকে দা হাতে দেখে বিস্ফোরিত নেত্রে বলে উঠে, ‘এটা তুমি কী করছো মা?’
অপূর্বর চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে উঠে ইমতিয়াজ। সে দ্রুতবেগে অপূর্বর কামরায় এসে দেখে রূপালি দা দিয়ে তার সন্তান অপূর্বকে খুন করতে চাইছে ...।
অপূর্ব খুব দ্রুত উঠে বসে। সেই সময়ই ইমতিয়াজ রূপালির দা ধরা হাতটা ধরে ফেলে। অপূর্ব দ্রুত উঠে মায়ের পায়ের কাছে এসে পা দুটি ধরে কাঁদতে থাকে, ‘মাগো তুমি আমাকে খুন করো না, মা। আমি তো তোমারই পেটের সন্তান মা। তুমি আমাকে কতো কষ্ট করে মানুষ করেছো, আমি তো জীবনে কখনও তোমার অবাধ্য হইনি। তোমার কথা ফেলে দেইনি, তোমার অসম্মান করিনি। তাহলে তুমি আমাকে কেনো মারবে মা? জানি, তুমি কষ্ট পেয়েছিলে, দুঃখ পেয়েছিলে, যদি আমি তোমার দুঃখ কষ্টের কারণ হয়ে থাকি, তাহলে তুমি আমাকে খুন করতে পারো, আর যদি অন্য কেউ তোমার দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে কথা দিচ্ছি, এই জনমে আমি তোমার দুঃখ-কষ্টের কারণ হবো না। তবুও তুমি আমাকে মেরো না মা, আমি বাঁচতে চাই। দেশের জন্যে কিছু করতে চাই, যা তোমার সন্তান হিসেবে তুমি গর্ববোধ করতে পারো।’ মায়ের পা জড়িয়ে ধরে অপূর্বর কান্না থামছেই না।
রূপালির হাত থেকে দা’টি কেড়ে নিল ইমতিয়াজ। এবার রূপালির বোধোদয় হলো। সেও কান্না করছে। অঝোর ধারায় তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
দূরে কোথায়ও ফজরের আযান হচ্ছে। ইমজিয়াজ বললো, ‘রূপালি আমি নামাজে যাচ্ছি। তুমিও নামাজ পড়ো। একমাত্র নামাজই মানুষের জীবনের সব কষ্ট-দুঃখ ভুলিয়ে সুখের সুবাতাস বইয়ে দিতে পারে। নামাজই মানুষকে তার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে। আল্লাহকে স্মরণে রাখো, আল্লাহ তোমাকে সকল প্রকার বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন।’
রূপালির মনে হলো, এতো দিন স্রষ্টাকে সে ডাকেনি, স্রষ্টাকে সে অনুধাবন করেনি। আজ থেকে স্রষ্টার সান্নিধ্যে যাবার অবিরত চেষ্টা করবে। তিনিই তাঁকে তার জীবনের এই কঠিন মায়াজাল থেকে মুক্তি দিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর পথের সন্ধান দিতে পারেন। (সমাপ্ত)