প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৯:১৬
বই পড়াহীন জাতি : সভ্যতা ও সামাজিক মূল্যবোধের বিপর্যয়

সভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা কখনোই কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে না। একটি জাতির প্রকৃত অগ্রগতি নির্ধারিত হয় তার মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক চরিত্র, এবং চিন্তাশীল বৌদ্ধিক পরিসরের মাধ্যমে। এসবের ভিত রচনা করে পাঠচর্চাÑবিশেষত বই পড়া। অথচ বর্তমান সময়ে জাতি এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিতÑএকটি প্রজন্ম ধীরে ধীরে বই বিমুখ হয়ে উঠছে। এ বই বিমুখতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, এর প্রভাব সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র এবং সর্বোপরি সভ্যতার কাঠামোর উপর চেপে বসেছে। একুশ শতকের চতুর্থার্ধে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, বইহীন একটি জাতি কীভাবে মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলছে এবং অন্ধ প্রযুক্তির দাসত্বে নিপতিত হচ্ছে।
বই কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়Ñএটি একটি আত্মশীলন প্রক্রিয়া। যখন একজন মানুষ বই পড়ে, তখন সে কেবল তথ্য গ্রহণ করে না, বরং অনুভব করতে শেখে, বিশ্লেষণ করতে শেখে, এবং নিজের চিন্তাকে গভীর করে তোলে। সাহিত্য, ইতিহাস, আত্মজীবনী কিংবা দর্শনের বই একজন পাঠককে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়Ñযেখানে সে অন্যের জীবনে প্রবেশ করে, অনুভব করে, বোঝে। এই বোঝাপড়া জন্ম দেয় সহমর্মিতা, সহনশীলতা ও মানবিকতাবোধ। কিন্তু আজকের বইবিমুখ তরুণ প্রজন্ম সংবেদনশীল নয়, বরং হিংস্র, ধৈর্যহীন এবং চিন্তাহীন হয়ে উঠছে।
গ্রন্থপাঠের অভাবে যে বোধের জগৎ তৈরি হয় না, তা কখনোই যুক্তির পরিপক্বতায় পৌঁছাতে পারে না। তখন চিন্তা ও মতবিনিময়ের স্থানে জন্ম নেয় কু-ধারণা, কুসংস্কার, ও গুজব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে আমরা দেখি, একটি অসত্য পোস্ট কিভাবে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে, জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং প্ররোচিত করে হিংসা ও সংঘাতে। এ দৃশ্যপট আসলে পাঠচর্চা হীনতার এক সুস্পষ্ট ফলাফল। বইপড়ার অভাব আমাদের সমাজকে ধাপে ধাপে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেÑযেখানে আত্মিক বিবেচনা, যুক্তি ও সহিষ্ণুতা নেই, বরং আছে হঠকারিতা, অসহিষ্ণুতা ও আবেগতাড়িত প্রতিক্রিয়া।
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের বড় একটি কারণ হলোÑপরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বইয়ের চর্চার অবসান। একসময় পরিবারে মা-বাবা বই পড়তেন, শিশুরাও তাই উৎসাহ পেতো। আজ বাবা-মা নিজেরাই টেলিভিশন বা ফোনে ব্যস্ত। শিশুর শৈশবেই বইয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটছে না। স্কুলেও বই পড়া একটি পরীক্ষামূলক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো গ্রন্থ পড়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হয়। অথচ পাঠ্যক্রম বহির্ভূত সাহিত্যচর্চা একজন ছাত্রকে শুধু জ্ঞানী নয়, রুচিশীল এবং মানবিক মানুষ করে তোলে।একটি জাতির সভ্যতা পরিমাপ করা যায় তার বই পাঠের অভ্যাস দিয়ে। ইউরোপের রেনেসাঁ ছিল মূলত এক পাঠচর্চাভিত্তিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সেখানে বইকে ঘিরে সমাজে যে আলোকবর্তিকা জ্বলেছিল, তার মাধ্যমেই বিজ্ঞান, শিল্প ও মানবিকতা এক নতুন দিগন্তে পৌঁছায়। ভারতীয় উপমহাদেশেও শাস্ত্র, কাব্য, দর্শন ও ইতিহাসের যে বর্ণাঢ্য গ্রন্থসংস্কৃতি ছিল, তা আমাদের চিন্তার ভিত গড়ে তুলেছিল। অথচ আজ আমরা নিজেদের সেই ঐতিহ্য ভুলে গেছি। শিশুরা ‘রূপকথা’ নয়, মোবাইল গেমসে অভ্যস্ত। কিশোর-কিশোরীরা জীবন বোঝে না, বোঝে ‘রিল’। ফলে জীবনের বাস্তবতা তাদের কাছে ক্লান্তিকর এবং সম্পর্কের মর্ম তাদের কাছে বোঝার নয়Ñভোগের বস্তু।
গ্রন্থচর্চা হীন এই সমাজে মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সততা, সহানুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধÑএসব শব্দ এখন ক্লাসরুমে একটি অনুশীলনী মাত্র। বাস্তব জীবনে এগুলোর প্রয়োগ নেই। আমরা এমন এক সমাজে পরিণত হয়েছি, যেখানে প্রতারণা, হিংসা ও ভোগবিলাসই আধুনিকতার সংজ্ঞা। অথচ বই পড়া হলে, মানুষ আত্মসমীক্ষা করতে শেখে, ভুল স্বীকার করতে পারে, এবং ভালো হওয়ার চেষ্টা করে। আজ এই আত্মসংশোধনের সুযোগও হারিয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুই পাস করানো নয়, বরং মানুষ গড়ার মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করছি, তা কেবল পরীক্ষানির্ভর, মুখস্থ নির্ভর, এবং মেধাহীন এক প্রজন্ম তৈরি করছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো পাঠ নেই, ক্লাসে কোনো মুক্ত আলোচনার পরিবেশ নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বই পড়ার অনুপ্রেরণা নেই। পাঠাগারগুলো জনশূন্য, শিক্ষকরা নিজেরাই পাঠচর্চা বিমুখ। এই শূন্যতার মধ্য দিয়ে আমরা একটি জাতিকে ক্রমশ আত্মাহীন করে তুলছি।
পাঠ্যচর্চাহীন সমাজে কেবল বুদ্ধির জীর্ণতা নয়, রুচির অধঃপতনও ঘটে। পোশাক, ভাষা, বিনোদন এবং মতপ্রকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা আজ ভোগবাদ, কৃত্রিমতা ও গোপন হীনম্মন্যতার শিকার। বই না পড়লে মানুষ সংস্কৃতি ভুলে যায়। ঐতিহ্যকে লজ্জার বস্তু বলে মনে করে। নিজের মাটি, নিজস্ব ভাষা ও ইতিহাসকে অস্বীকার করতে শুরু করে। তখন রাষ্ট্রব্যবস্থাও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে, কারণ ব্যক্তি মানসিকভাবে অপূর্ণ। পাঠ্যহীনতা মানুষকে শুধু অন্ধ করে না, সেটি ধীরে ধীরে তাকে এক ভয়ংকর আত্মবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বে পরিণত করে।
এই গভীর বিপর্যয় থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো গ্রন্থপাঠে ফেরার আন্দোলন। ব্যক্তিগতভাবে, পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিতেও বইকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঘরে ঘরে লাইব্রেরি না হলেও অন্তত একটি বই পড়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। স্কুলে পাঠ্যবইয়ের বাইরের সাহিত্য পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে। পরিবারের সদস্যরা যদি প্রতিদিন আধা ঘণ্টা বই হাতে নেন, শিশুরাও অনুসরণ করবে। বইমেলা কেবল একটি উৎসব নয় তা হতে হবে পাঠচর্চা উৎসাহিত করার উপলক্ষ।
জাতিকে সভ্য রাখতে হলে তাকে চিন্তাশীল করতে হবে, মানবিক করে তুলতে হবে, এবং মূল্যবোধে ঋদ্ধ করতে হবে। এসবের কোনোটাই হবে না যদি বই না পড়া হয়। বইহীন জাতি যেমন ইতিহাস ভুলে যায়, তেমনি হারিয়ে ফেলে ভবিষ্যৎ গড়ার শক্তিও। আজ যদি আমরা বইয়ের দিকে না ফিরি, তাহলে কাল আমাদের সন্তানরা শুধুই তথ্যের বোঝা বয়ে বেড়াবে জ্ঞানহীন, অনুভূতিহীন, এবং ভবিষ্যৎহীন।
এই আত্মবিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বইকে ভালোবাসার আন্দোলনই হতে পারে জাতি গঠনের সবচেয়ে জরুরি বিপ্লব।