প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:২০
এই জনমে
মিজানুর রহমান রানার মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক উপন্যাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সতেরো.
ঈষাণবালা ও তুষার দাঁড়িয়ে পড়লো। ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে ইরফান, অধরা, ইমতিয়াজ ও রূপালি। তারপর ঈষাণবালা ও তুষার একযোগে প্রশ্ন করলো, ‘আমরা এখানে আছি তোমরা জানলে কীভাবে?’
প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নই ছুড়ে দিলো ইরফান, ‘আজ কত তারিখ?’
তুষার উত্তর দিলো, ‘১৬ ডিসেম্বর।’ উত্তর দিয়েই সে বুঝতে পারলো ঘটনাটা কী? তারপর বললো, ‘ওহ, এই খবর? তোমরা ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষেই আজ ডাকাতিয়ার তীরে বেড়াতে এসেছো সেই প্রথম দিনটার কথা মনে করে, তাই না।’
‘হ্যাঁ।’ উত্তর দিলো ইমতিয়াজ। ‘এখান থেকেই আমরা তিন বন্ধু শুরু করেছিলাম। এখানেই আমার হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরই আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
তারপর তিন বন্ধু একত্রে বলে উঠলো, ‘এখানেই আমাদের প্রেমেরও সূচনা হয়েছিলো।’
কথাটা শুনে হাসতে হাসতে একবন্ধু আরেক বন্ধুকে খুশিতে জড়িয়ে ধরলো। এ সময় অধরা চিৎকার করে উঠে বললো, ‘আহ্’।
সবাই একসঙ্গে অধরার দিকে ফিরলো, তারপর প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে তোমার?’
অধরা তার পেটের দিকে ইশারা করে বললো, ‘হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা পেয়েছি।’
এ কথা শুনে সবার হাসির মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। ঠিক সেই সময়টাতেই হঠাৎ করে প্রচণ্ড বাতাসে ডাকাতিয়া নদীর একপশলা জল এসে সবাইকে ভিজিয়ে দিলো।
নদীর জলে ভিজে তুষার অধরাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ইরণা কোথায় রে?’
ঈষাণবালা শাড়ির জল মুছতে মুছতে তুষারের দিকে কটমট করে তাকালো। অধরা বিষয়টা বুঝতে পেরে এবার পেট ব্যথার কষ্ট ভুলে ঈষাণবালার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো, ‘আরে না না, আপনি যা ভাবছেন তা-না। ইরণা আমার ছোট বোন। সেও আমাদের সাথে যুদ্ধে এখান থেকেই যোগ দিয়েছিলো, সে এখন তার স্বামী সন্তানসহ দেশের বাইরে আছে।’
ঈষাণবালা একটা গভীর নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো, ‘ওহ, তাই বুঝি? আমি তো ভেবেছিলাম...।’
আবারও হাসির রোল পড়লো। এই সময়ই পাশে একটা দামী গাড়ি এসে থামলো। ঠিক যেনো তাদের গায়ে এসে পড়ার উপক্রম।
সবার হাসি থেমে গেলো। ইরফান প্রচণ্ড রাগে গাড়িটার দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ক্রমে ক্রমে গাড়ির দরজা খুললো, অবাক হয়ে সবাই দেখলো আমির ও সুজানা গাড়ি থেকে নেমে আসছে।
তাদেরকে দেখে এবার সবার খুশির মাত্রা বেড়ে গেলো।
ইরফান প্রশ্ন করলো, ‘সবাইকে তো পেলাম। অনন্যা দিদি কোথায়?’রাস্তা ধরে দ্রুতবেগে হাঁটছিলো হেকমত আলী। এ সময় এক নারী তার সামনে এসে দাঁড়ায়। জানালেন তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এখন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে মুক্তিযুদ্ধের বই বিক্রয় করে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী সম্পর্কে জানিয়ে দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলছেন। আর এই আয় দিয়েই সে সংসার চালাচ্ছেন। তাকে একটি বই কেনার অনুরোধ করলেন।
হেকমত একটি বই হাতে নিয়ে দেখলো, লেখকের নাম ‘অনন্যা চৌধুরী’। সে একবার বইয়ের দিকে আবার এই নারীর দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎই তার মনের আঙ্গিনায় যুদ্ধকালীন অনন্যার ছবি ভেসে উঠলো। ঠিকই তো, ঠিক আছে। এই সেই নারী যাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে দেখেছিলেন, যুদ্ধ করতে দেখেছিলেন। সত্যিই তিনি মুক্তিযোদ্ধা, সত্যিই তিনি অনন্যা।
‘কী ভাবছেন?’ তাড়া দিলেন নারী। ‘একটি বই কিনে নিন। তাহলে আপনার সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারবে, দেশের প্রতি তাদের মায়া জন্মাবে। তারা যখন জানতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ করে পাকবাহিনীসহ রাজাকার বাহিনীর হাত থেকে দেশের মা-বোনদের রক্ষা করেছিলো, কীভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলো, কতোটা বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছিলো, কত স্বজন হারানোর বেদনা ভুলে দেশের জন্যে জীবন দিয়েছিলো, তখন তারা নেশার জগতে, অন্যায়ের দিকে পা বাড়াবে না। তারা বুঝতে পারবে তাদের পূর্বপুরুষরা কতোটা সাহসী ছিলো। কতোটা ন্যায়ের পথে ছিলো। তাই আপনার সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানান, দেশের উন্নয়নে এটা আপনার কর্তব্য।’
হেকমত ভাবছে। আসলেই তো তাই। তাকে তো এবার আসল প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সে আল্লাহর কাছে সারাটি জীবনই সেজদা করে করে ক্ষমা চেয়েছে যুদ্ধকালীন অন্যায়ের জন্যে। সম্ভবত মহান আল্লাহই তাকে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিয়েছেন। আজকে সে বই কিনবে, একটি নয়। সবক’টি।
‘আপনার কাছে কয়টি বই আছে?’ প্রশ্ন করে হেকমত।
‘দশটি।’ উত্তর দেয় অনন্যা চৌধুরী।
‘আমি দশটি বই-ই কিনতে চাই। শুধু আমার সন্তান নয়, সবার সন্তানদেরকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে চাই। আর আমি নিজেও সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাই, যাতে আমি কখনও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল না করি।’
অনন্যা চৌধুরী অবাক হলেন। তিনি হেকমতকে বললেন, ‘আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?’
‘না। আমি মজা করছি না, আমি প্রায়শ্চিত্ত করছি। পৃথিবীটা হচ্ছে একটা অদ্ভুত মায়াজাল, এখানে অর্থ ও স্বার্থের জন্যে মানুষ ভালো কিছু করতে পারে না শয়তানের প্ররোচনায়। আমি চেষ্টা করছি সেই মায়াজাল ছিন্ন করে শেষ জীবনটা ভালো কিছু করে কাটিয়ে দিতে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আমার গুনাহের জন্যে ক্ষমা চাই আল্লাহর কাছে, তবে মানুষের কাছে যে অন্যায় করেছি তার জন্যে আমি ক্ষমা পাবো কিনা জানি না, তবে ক্ষমার প্রত্যাশায় আপনার কাছ থেকে বইগুলো কিনে নিতে চাচ্ছি।’
‘কী অন্যায় করছেন আপনি, কীভাবে?’ অন্যন্যা চৌধুরী প্রশ্ন করলো।
হেকমত আলী কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মনে মনে ভাবলো এই প্রশ্নের উত্তর দিলো তো আপনি বইগুলো বিক্রি করবেন কিনা জানি না। আমি তো মহাপাপী, ক্ষমার অযোগ্য। শয়তানের দোসর হয়ে মানুষকে মেরেছি, সম্পদ লুট করেছি, নারীদেরকে তুলে এনে মেহের জল্লাদের কাছে তুলে দিয়েছি। গণিমতের মালের আশায় মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছি, মুরগি, ডাব চুরি করেছি। ধনসম্পদ কেড়ে নিয়েছি। পাপের বোঝা তো অনেক, এটা মানুষের কাছে বলে তো কোনো লাভ নেই। এটা শুধু আল্লাহর কাছে বলা যায়, যে তার গুনাহগার বান্দাকে দুনিয়ার মানুষের সামনে লজ্জিত করেন না ক্ষমা চাইবার অন্তর থাকলে। আমি কীভাবে আপনাকে এসব কথা বলি।
হেকমতকে নিরুত্তর থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করলো অনন্যা। ‘কী হয়েছে আপনার?’
‘আমার খুব তাড়া আছে। আপনি কি আপনার সবক’টি বই বিক্রি করতে চান? তাহলে হিসাব করুন কত টাকা আসে। আমি আপনার সব বই কিনবো। আমি বইগুলো আপনার হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিবো। আর দেশের জন্যে এটাই আমার পরম পাওয়া যে, একজন মুক্তিযোদ্ধার লেখা বইগুলো আমি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করে যাবো।’অনন্যার কথার জবাব না দিয়ে হেকমত দ্রুত অনন্যার কাছ থেকে পালাতে চায়।
অন্যন্যা চৌধুরী চশমার ফাঁক দিয়ে হেকমতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ভাবছেন, মানুষকে একটি বই কিনতে বললে পালিয়ে যায়, আর এই লোকটি কতোটা ভালো হলে তার সবক’টি বই কিনে নিতে চায়! তার এ সময় মনে হলো, আসলে মানুষ চেনা বড়ো দায়।
অনন্যা চৌধুরীর কাছ থেকে হেকমত দশটি বই হাতে নিয়ে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে রাস্তাটা পার হচ্ছিল। ঠিক এই সময়েই একটা বেপরোয়া ট্রাক এসে হেকমতকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত চলে যায়।
হেকমতের হাতের বইগুলো বাতাসের সাথে উড়ে যায়। আর তার শরীরের রক্তে রাস্তা ভেসে যায়। ট্রাকের ধাক্কায় প্রায় দশহাত দূরে গিয়ে পড়ে হেকমত। তারপর পড়ে থাকে রাস্তায়।
রাস্তাজুড়ে মানুষের জটলা। সবাই হেকমতের রক্তাক্ত দেহটাকে চারদিক থেকে দেখছে। এ সময় অনন্যা চৌধুরী এগিয়ে এলেন। মানুষজনকে সরিয়ে হেকমতের কাছে আসতেই, হেকমত চোখ খুললো। তারপর তাঁর দিকে একটা চোখ হালকা খুলে বললো, ‘পানি, পানি, আমাকে একটু পানি দিবেন?'
অনন্যা তার ব্যাগের
ভেতরে ছোট্ট একটা বোতল থেকে লোকটাকে পানি পান করান। এ সময় চশমার ভেতর দিয়ে দেখে হেকমতকে চিনে ফেললেন অনন্যা চৌধুরী। তারপর বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘ওহ তুমি হেকমত আলী?’
তারপর জনতার দিকে তাকিয়ে অনন্যা বলে উঠলেন, ‘এই লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন। সে তার অতীত কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়েছিলো, কিন্তু সে আর বাঁচার সুযোগ পেলো না। আসুন, আমরা তাকে আরও বেঁচে থাকতে সহযোগিতা করি, যাতে সে বেঁচে থেকে তার পূর্ণ কৃতকর্মের জন্যে মানুষের কাছে ক্ষমা পায়।’ (চলবে)