প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ০০:০০
পৃথিবীতে কবে গুজব শুরু হয়েছিল তার দিন-তারিখ ঠিক করে বলা মুশকিল। এক সময় মানুষের মুখে মুখে গুজব ছড়িয়ে পড়তো।আধুনিক যুগে গুজব ছড়ানো হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অতীতের তুলনায় এখন গুজব ছড়ায় দ্রুত গতিতে। এতে করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গুজব চূড়ান্ত বিচারে প্রাণ ও প্রকৃতির জন্যে ক্ষতিকর। কোনো তথ্য যখন সঠিকভাবে পরিবেশিত হয় না কিংবা এমনভাবে পরিবেশিত হয়, যা উদ্দেশ্যমূলক তখন সেটাকে আমরা কুতথ্য বলতে পারি।
আজ থেকে তিন যুগ আগে আমরা দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম, ঢোলকলমি গাছে বসবাস কারী এক ধরনের পোকার কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয়।সেটা সংবাদ মাধ্যম আর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে সারাদেশে হৈচৈ ফেলে দেয়। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জরুরি বৈঠকে ঢোল কলমি নিধনের সিদ্ধান্ত হলো। সারাদেশে ঢোল কলমি কেটে পুড়িয়ে ফেলা হলো। পরে দেখা গেল, এই পোকার কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয় না।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। এটাকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় বেশ ক'জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুর সংবাদ বেশ ক'বার পত্র পত্রিকায় এবং অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এটিএম শামসুজ্জামান নিজে গণমাধ্যমে উপস্থিত হয়ে মৃত্যুর কথা অস্বীকার করেন।
কিছুদিন আগে শুনলাম, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি নিখোঁজ। পদ্মা সেতুতে শিশু বলি দিতে হবে কিংবা মাথা লাগবে এমন গুজব মানুষের মনে আতংক তৈরি করে। বাসা বাড়ির টয়লেট এবং বেসিনে হারপিক ছেড়ে দিলে এডিস মশা ধ্বংস হবে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে এ বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ তৈরি হয়। তারা বলতে থাকেন, লেবু, চা,গরম পানি, অ্যালকোহল পান করলে সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা কমে যায়। তাপমাত্রার কত ডিগ্রি পর্যন্ত করোনা ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে তা নিয়ে বাহাস হয়েছে। করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কীটস এবং প্রতিষেধক নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। কেউ কেউ টিকা সম্পর্কে আস্থাহীনতায় ভোগেন। অনেক শিক্ষিত মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে বিলম্বে টিকা নেন। আবার সন্দেহকারীদের মধ্যে অনেকেই প্রথম দিকে টিকা নেন। সচেতন মানুষদের কেউ কেউ টিকা সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেন। মুফতি কাজী ইব্রাহিম করোনা চিকিৎসার সূত্র আবিষ্কার করে ফেলেন।ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর সমাবেশে পুলিশের হামলায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা নিয়ে গুজব চরমে উঠে। মৃত দাবি করা ব্যক্তিকে পরে পুলিশ গ্রেফতার করে। ছেলেধরা সন্দেহে এক নারীকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ছবি কারসাজি করে, এডিট করে, বানোয়াট ভিডিও তৈরি করে, কাল্পনিক বিষয় কিংবা তথ্য বিকৃত করে মানুষকে উত্তেজিত করে শান্তি শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো হয়।কেউ কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কুতথ্য ছড়িয়ে দিয়ে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে জনমনে আতংক তৈরি করে। কোনো কোনো সময় নিছক মজা করার জন্যে তথ্য বিকৃতি কিংবা সত্য মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে গিয়ে গ-গোল বাঁধিয়ে দেয়া হয়।
আমরা দেখেছি, ধর্ম ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে ভূয়া, বানোয়াট, মিথ্যা, বিকৃত উস্কানিমূলক তথ্য প্রচার করে রাষ্ট্রে বসবাসরত জাতি গোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায়কে চরম হেনস্তার শিকার হতে।
অসত্য, বিকৃত তথ্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কারো চরিত্র হনন ও কলঙ্ক লেপন, ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্মানুভূতিতে আঘাত, বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গামা হাঙ্গামা সৃষ্টি করা ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী।
ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল, ইমো,হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া কু তথ্য মানুষের জানমাল ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
ইন্টারনেটের কল্যাণে পৃথিবীর প্রায় সকল তথ্য ভাণ্ডার আমাদের সামনে উন্মুক্ত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কাছে তা পৌঁছে যাচ্ছে।
তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ, সেবা খাত থেকে মানুষ সুফল পাচ্ছে। আমাদের সমাজে শিশু ও প্রবীণরা নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী। যে কোনো দুর্যোগ দুর্বিপাকে এই দুই শ্রেণির মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাপ্ত কু তথ্য তাদের মধ্যে আতংক, আশংকা, উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রবীণ শারীরিক ও মানসিক ভাবে দুর্বল। তারা যে কোনো দুঃসংবাদে আতংকিত হয়ে পড়ে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না অথবা ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলে।
আমাদের প্রবীণদের সকল রকমের কুতথ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। গ্রামে প্রবাদ আছে, চিলে কান নিলে চিলের পিছনে দৌড়ানোর আগে কানে হাত দিয়ে দেখতে হয়। প্রবীণদের একটু যাচাই বাছাই করে তথ্য গ্রহণ করা উচিত। একটু মাথা খাটালে একজন মানুষ বুঝতে পারবে সংবাদ প্রদানের উদ্দেশ্য কী!
ফেসবুকে কিছু দেখে যাচাই বাছাই না করে পোস্ট শেয়ার করা অথবা কমেন্ট করা ঠিক হবে না। প্রবীণদের নতুন প্রজন্মের সাথে কার্যকর যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে প্রযুক্তিগত ধারণা পেতে সহজ হবে। আমাদের প্রবীণদের অনেকের মধ্যে অজানা আশংকা কাজ করে--কী হবে, কেমন হবে, কখন হবে, ভালো হবে নাকি খারাপ হবে? এসব চিন্তা মাথায় কাজ করে। দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের নতুন চিন্তা ভাবনাগুলোকে সহজে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এমতাবস্থায় কুতথ্য প্রবীণ জীবনকে আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
কুতথ্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, আস্থাহীনতা তৈরি করে, পারস্পরিক সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলে।
চিন্তা ভাবনায় অগ্রসর প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন তরুণরা প্রবীণদের সাথে নিয়ে কুতথ্য প্রতিরোধে প্রচেষ্টা চালানো দরকার। কুতথ্য প্রতিরোধ করতে পারলে প্রবীণরা অনেকখানি ভালো থাকবেন।