প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৩, ০০:০০
আমাদের প্রবীণদের বড় একটি অংশ মনে করেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের বোধ-বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান, আক্কেল-তরিবত অনেক কম।এই ঘাটতি পূরণে প্রবীণদের প্রথম পছন্দ হেদায়েতের তরিকা। প্রবীণরা নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে কিশোর-তরুণদের হেদায়েত করে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিবরণ দেন। প্রবীণ তার বিশ্বাস মূল্যবোধ অনুযায়ী তরুণ প্রজন্মকে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। প্রবীণদের অধিকাংশই আমাদের শিশু- কিশোরদের পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা দিতে চান না। তারা মনে করেন, ওরা ছোট মানুষ, এখনো অনেক কিছু বুঝতে পারে না কিংবা বুঝতে চায় না। এই ধরনের মনোভাবে শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের প্রতি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিতে থাকে। আমাদের মধ্যে শিশু- কিশোরদের কাছ থেকে কথা শুনতে আগ্রহ কম। আমরা তাদের মনের মধ্যে জমে থাকা কথা, রাগ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, অভিযোগ, অভিমান, কষ্টগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে শুনতে চাই না। শিশু-কিশোররা অভিভাবকদের কাছে কোনো অভিযোগ করলে আমলে নেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি লক্ষ্য করা যায়। কেউ কেউ ছোটদের পাত্তাই দিতে চান না।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার কনভেনশনে মোট ৫৪টি আর্টিকেল আছে, যার মধ্যে প্রথম ৪২টি হলো শিশুর অধিকার সংক্রান্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের এই অধিকারগুলো পড়ানো হয়। এতে করে পিতামাতা এবং শিক্ষকরা শিশুদের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে শেখেন। মাঝে মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হবার সংবাদ চোখের সামনে আসে। শিশু পরিবারে মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হবার ঝুঁকিতে আছে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজনের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে অভিভাবককে নালিশ করতে চায় না। আবার কেউ নালিশ করলে মান সম্মানের ভয়ে চেপে যান কিংবা আমলে নেন না। শিশু নির্যাতনকারীরা ভয় দেখায়, লোভ দেখায়, হত্যার হুমকি দেয়। ফলে পিতামাতার কাছে নালিশ অভিযোগ করতে শিশুরা সাহস পর্যন্ত পায় না। আমাদের শিশু,কিশোর, তরুণদের নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দণ্ডঅপছন্দ, প্রকাশ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাবা-মার কাছে মন খুলে কথা বলতে পারে না। আর যদিও কেউ বলে, তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। কে কোন্ বিষয়ে পড়বে এটাও আমাদের অভিভাবকরা একতরফা নির্ধারণ করে দেন।
আমাদের প্রবীণদের সাধারণত ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিদের আচার-আচরণ, চলন-বলন, পোশাক পরিচ্ছদ,খাওয়া দাওয়া, পড়াশোনা ইত্যাদি বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। তারা তাদের শৈশব কৈশোরে কী কী করছেন এবং কতরকম প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন তার দীর্ঘ ফিরিস্তি দিতে থাকেন। তাদের কম বয়সে জিনিসপত্রের দাম কতো কম ছিল সেই বর্ণনা তরুণদের কাছে তেমন কোনো আবেদন রাখে না। যখন তেল, নুন, চাল, ডাল, মাছ, মাংসের দাম কম ছিল, তখন মানুষের আয় রোজগারও কম ছিল। এখন মানুষ আগের চাইতে আয় রোজগার অনেক বেশি করে। খাওয়া দাওয়া, জীবন যাপন, পোশাক পরিচ্ছদ, শিক্ষা, চিকিৎসায় আগের চাইতে ব্যয় অনেক বেশি।
প্রতিনিয়ত মানুষ উন্নততর জীবন যাপনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ প্রবীণ মনে করেন, তারা জীবনে অনেক লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, ফলে তাদের অভিজ্ঞতাণ্ডদক্ষতা তুলনামূলকভাবে বেশি। অবশ্যই প্রবীণদের অভিজ্ঞতাণ্ড দক্ষতা তুলনামূলকভাবে বেশি, কিন্তু নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে নবীনরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হচ্ছে।
পৃথিবী প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে, নতুন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। পুরানো অনেক সমস্যা সংস্কার করে সমাধান করা যাচ্ছে না। একসময় টেলিভিশন দেখতে এন্টেনা লাগতো। ল্যান্ড ফোনের যন্ত্রণার কথা অনেকেই ভুলে যান নি। ভিসিআরে সিনেমা দেখা, টেলিভিশনের লাইসেন্স, ডিস বিড়ম্বনা, টাইপ রাইটারে খট খট শব্দ, শর্টহ্যান্ড নতুন প্রযুক্তির কাছে হেরে গিয়ে ইতিহাস হয়েছে।
প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির নানান রকমের পরিবর্তন হচ্ছে। এসব দ্রুত গতিতে আয়ত্ত করছে তরুণ প্রজন্ম। পৃথিবী এখন পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারছে।
কিছু দিন আগ পর্যন্ত আমাদের বলা হতো, শিশু কিশোরদের হাতে মোবাইল, ইন্টারনেট দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
কোভিড-১৯ সংক্রমণে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই সময়ে অনলাইনে মোবাইল, ল্যাপটপ ব্যবহার করে শিক্ষা জীবন সচল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রবীণ একসময় বড় পদে ছিলেন, শিক্ষা দীক্ষায়, দক্ষতায় সেরা ছিলেন। তাঁকেও মাঝে মধ্যে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের ঝামেলা মোকাবেলা করতে নাতি-নাতনির সহযোগিতা নিতে হয়।
আমাদের প্রবীণদের অনেকের এমন ধারণা প্রবল যে, তাঁরা অনেক কিছু শিখেছে, দেখেছে, বুঝেছে,জেনেছে, অতএব নতুন করে আর কিছু শেখার নেই। বদলে যাওয়া পৃথিবীর নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে, কিন্তু সংকট নিরসনে সেই অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়। নতুন পরিস্থিতিকে নতুন চিন্তা দিয়ে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণ পৃথিবীর সামনে নতুন পরিস্থিতি ছিল। সেটা মোকাবিলা করতে হয়েছে নতুন ধরনের চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিন দিয়ে। আমাদের প্রবীণদের দক্ষতা অভিজ্ঞতা সমাজের জন্যে অনেক মূল্যবান। তারা যৌবনে সমাজ পরিবর্তনে, পরিবারের মঙ্গল সাধনে যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের জানা-বোঝা যথেষ্ট নয়। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের জানা-বোঝার এবং শেখার অনেক কিছু আছে।প্রবীণরা যদি সংকট নিরসনে তরুণদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনেন, তাতেই বেশি লাভ। সংকট নিরসনে তরুণরা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রবীণরা বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারেন, কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসা কিছুটা কঠিন বৈকি!
প্রবীণদের কেউ কেউ যে কোনো ধরনের পরিবর্তনকে ভয়ের চোখে দেখেন, আতংকে থাকেন। ফলে পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে দেখেন না। আমরা চাই বা না চাই, পৃথিবীতে নানা রকমের পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন পরিস্থিতি সামনে আসছে। পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের প্রবীণদের দীর্ঘ জীবনে নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে নানান রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ফলে তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার চাহিদা থাকে। তরুণ প্রজন্মের কাছে অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ অনেক সময় জরুরি কিছু নয়। প্রবীণদের উচিত হবে নিজেদের অভিজ্ঞতাণ্ডদক্ষতা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। যার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে তিনি বিষয়টি কী ভাবে নিচ্ছেন সেটা বিবেচনা করা জরুরি।
প্রবীণরা যদি বেশি শোনেন তবে আমাদের বেশি লাভ। তখন তরুণদের নতুন নতুন চিন্তাভাবনাগুলো গ্রহণ করে নিজেদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে পরামর্শ দেয়া যায়। প্রবীণরা তরুণ প্রজন্মের কাছে শোনার আগ্রহ দেখালে তরুণরা এগিয়ে আসবে। নবীন প্রবীণের মিলিত শক্তি আমাদের বার্ধক্যকে শান্তিপূর্ণ ও আনন্দদায়ক করতে সহায়তা করবে।
প্রবীণ কথা বলতে পারলে স্মৃতিশক্তি কার্যকর থাকে, মানসিক শান্তি পায়, সম্মানিত বোধ করে, নতুন প্রজন্মের সাথে হৃদ্যতা বাড়ে। এটাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।