প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হয়ে গেছে। যুদ্ধের ক্ষত কবেই শুকিয়ে গেছে। মুছে গেছে কত অসহায় নারীর সতিত্বের কলঙ্কিত দাগ। কিন্তু ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা সকিনা বিবি আজও ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি তার স্বামী হারানোর বেদনা। ১৯৭১ সালের কলঙ্কিত সেই দিনগুলো বারবার তার চোখের সামনে সুস্পষ্ট ফুটে উঠে। মার্চ মাস ফিরে আসলে তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। সে যেন ঘরের দুয়ারে বসে শুধুই স্বামীর কথা ভাবে।
কোনো এক বসন্তের দিনে দখিনা হাওয়া যখন কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে মৃদু মর্মর তুলে ঝিরঝির বইছিল, ঠিক তখনই কোনো এক কালবৈশাখী ঝড় এসে সকিনা বিবির সুখের সংসারটি মাটি করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটিকে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্তিতে সকিনা বিবির বয়স সত্তর বছর পূর্ণ হয়েছে। বয়সের ভারে মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে। বার্ধক্যজনিত কারণে শরীর একেবারে নুয়ে পড়েছে। তবু আজও স্বামীর অপেক্ষায় বিগত কয়েক বছর ধরে সকিনা বিবির অবুঝ মনটা উদাসীন হয়ে উঠছে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কিছুদিন আগে জমির আলীর সাথে সকিনা বিবির বিয়ে হয়েছিল। তখন সকিনা বিবির বয়স আঠারো বছর। সবে মাত্র দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। জমির আলীর সাথে বিয়ে হওয়ার পরপরই সকিনা বিবির লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
সকিনা বিবির স্বামী জমির আলী ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। যার ফলে সকিনা বিবির সংসারে কোনো অভাব অনটন ছিল না। খুব সুখে শান্তিতে কাটছিল তাদের দাম্পত্য জীবন।
সেদিন ছিল পঁচিশে মার্চ ১৯৭১ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন। হঠাৎ করে গভীর রাতে সকিনা বিবিদের বাড়ির টেলিফোনটা ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। টেলিফোনের শব্দ শুনে সকিনা বিবির ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে সকিনা বিবি টেলিফোনটি যেই রিসিভ করল, সেই মুহূর্তে অপর প্রান্ত থেকে জমির আলীর মৃদু কণ্ঠস্বর ভেসে আসল, ‘সকিনা, তুমি সাবধানে থেকো। আমার মনে বলছে, তোমার সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে না। এই জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার পিতা-মাতার দিকে একটু খেয়াল রেখো।’ জমির আলীর মুখে আশ্চর্যজনক কথা শুনে সকিনা বিবি হতবাক হয়ে বললো, ‘ওগো কী হয়েছে, আমাকে সাবধানে থাকতে বলছো কেনো?’ ‘সকিনা, দেশের অবস্থা ভালো না। এই মাত্র খবর পেলাম শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ঘেরাও করেছে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এমনকি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো।’ জমির আলী উত্তর দিল।
এদিকে গভীর রাতে স্বামীর মুখে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা শুনে সকিনা বিবি হঠাৎ চমকে উঠে। ভয়ে হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে। হাত থেকে টেলিফোনটি মাটিতে পড়ে যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরটি তার কাছে যেন কবর মনে হয়। মনের মাঝে খটকা লাগে, এই বুঝি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করতে এলো। ভয়ানক সেই রাতে জমির আলীর চিন্তায় সকিনা বিবির দুই চোখে কোনো মতেই ঘুম আসছিল না। অতীতের স্মৃতিগুলো বারবার তার চোখের সামনে ভাসছিল।
সকিনা বিবি শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে যে বাড়িতে থাকে, সেই বাড়িটি বহু পুরানো আমলের বাড়ি। তার শ্বশুরের পৈত্রিক নিবাস। বাড়িটি খরছনের ছাউনিতে দু'চালা মাটির ঘর। সামনে এক ফালি উঠোন। বাড়ির পিছনের দিক দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদী। যে নদীটি গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। ভরা প্লাবনের সময় মৎস্যজীবীরা নদীর বুকে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে আর নদীর বুকে বালুচর জেগে উঠলে কৃষিজীবীরা ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।
সকিনা বিবির শ্বশুর ছলিমুদ্দিন বেপারী ছিলেন একজন মৎস্যজীবী। বিগত পনেরো বছর ধরে তিনি ভৈরব নদীর বুকে মাছ ধরে সংসার চালিয়েছেন। একমাত্র সন্তান জমির আলী চাকরি পাওয়ার পরপরই তিনি নদীর বুকে মাছ ধরা বন্ধ করে দেন।
বর্ষার সময় সকিনা বিবিদের সবুজ শ্যামল গ্রামটি দ্বীপে পরিণত হয়। জলবন্দি হয়ে পড়ে গ্রামের সব শ্রেণীর মানুষ। নদীর বুকে জোয়ার ভাটা জেগে না ওঠা পর্যন্ত নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে প্রবেশ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। চলাচলের জন্য সাধারণত বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। দেশ ভাগের পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাব্বত আলী কোনো এক অনুষ্ঠানে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, এই গ্রামের মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে কংক্রিটের পুল বানিয়ে দেবেন। কাদামাটির রাস্তাগুলো পাকা করে দেবেন। বিগত আট বছর ধরে মোহাব্বত আলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু তার সেই অঙ্গীকার আজও বাস্তবে পরিণত করেননি। তিনি শুধু মাত্র গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নমূলক কাজের আশ্বাস দিয়ে নিজের ভোটের অধিকার আদায় করেছেন।
১৯৭১ সাল। শ্রাবণের শেষ। বর্ষার সময়। ভৈরব নদী তার নবযৌবন ফিরে পেয়েছে। নদীর দুপাড় প্লাবনের পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। দিনরাত নদীর বুকে মৎস্যজীবীরা মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বর্ষার এই ভরা মৌসুমে কিছুদিন পর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, পাকিস্তানি খান সেনারা রাজাকারদের সহায়তায় সকিনাদের পাশের গ্রামে একটি হাইস্কুলে যুদ্ধের ঘাঁটি তৈরি করেছে। খান সেনাদের ভয়ে ঐ গ্রামের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে বনজঙ্গলে পালিয়ে গেছে। গ্রামটি একেবারে জনশূন্য হয়ে গেছে। পথে-ঘাটে মেয়েদের দেখতে পেলে পৈশাচিক খান সেনারা জোরপূর্বক ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যুবক ছেলেদের দেখার সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করছে। এভাবে গ্রামাঞ্চলে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে পাকিস্তানি খান সেনাদের পাশবিক অত্যাচার আর মুক্তিফৌজ নিধন।
এদিকে পাশের গ্রামে পাকিস্তানি খান সেনাদের অবস্থান নেওয়ার কথা শুনে সকিনা বিবিদের গ্রামের মানুষ নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। গ্রামের সব পেশাজীবী মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যুবক ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের বাবা-মা দুচিন্তায় পড়ে যায়। অবিবাহিত মেয়েরা তাদের সতিত্ব রক্ষার্থে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা খান সেনাদের শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে ঘরের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
ঠিক তেমনি এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে গিয়েছিল সকিনা বিবিদের গ্রামে। একদল খান সেনা রাতের আঁধারে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করে জামিল মিয়ার দুই মেয়েকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের ওপর সারারাত শারীরিক নির্যাতন চালায়। অত্যাচারী খান সেনাদের শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে জামিল মিয়ার দুই মেয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
সেদিন রাতে নারীদের ইজ্জত নিয়ে পাকসেনাদের ছিনিমিনি খেলার কথা শুনে সকিনা বিবির শরীর জ্বলে ওঠে। তার মনের মাঝে জাগ্রত হয় দা-বঁটি নিয়ে পাকিস্তানি পাষ-ের সাথে যুদ্ধে নেমে পড়ার। এরই প্রেক্ষিতে বেশ কিছুদিন পর সকিনা বিবি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধাদের রান্নাবান্নার সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সকিনা বিবির বীরাঙ্গনার পরিচয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রথম দিকে সকিনা বিবি তার শ্বশুরের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়ানোর পাশাপাশি রাতের আঁধারে অস্ত্র বহন করার দায়িত্ব ছিল সকিনা বিবির। স্বামী ও শ্বশুরের রেখে যাওয়া সম্পত্তি দিয়ে এই সব খাবারের ব্যবস্থা করতেন সকিনা বিবি। সেই সময় ধান ভাঙ্গার কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। ঢেঁকিকলের মাধ্যমে ধান ভাঙ্গতে হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিনরাত ঢেঁকিতে ধান ভেঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে খাবার জোগাড় করতো সকিনা বিবি। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে গিয়ে সকিনা বিবির সংসারে এক পর্যায়ে অভাব দেখা দেয়। তবু সকিনা বিবি কোনো মতেই হাল ছাড়েননি। তিনি পাড়া-গাঁয়ের মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন এবং মহাজনদেরকে আশ্বাস দিয়ে বলতেন, যুদ্ধের পর স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করবেন।
যুদ্ধের সময় সকিনা বিবির মোটেও ভয় ছিল না। শত্রুদের সাথে মোকাবেলা করা এবং দেশকে শত্রু মুক্ত করার আনন্দ তাকে অনুপ্রেরণা জোগাতো। এমনকি সকিনা বিবি রাতের আঁধারে কালো বোরখা পরে অস্ত্র পৌঁছে দিয়ে আসতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
কিন্তু যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা জেনে যায় সকিনাদের বাড়িতে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আস্তানা সম্পর্কে। যার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন কলিমউদ্দিন রাজাকারের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা সাঁকো পার হয়ে প্রবেশ করে সকিনাদের গ্রামে। সেদিন পাকসেনাদের কথা শুনে এলাকার নারীরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। নির্যাতনের ভয়ে কে কোথায় আত্মগোপনে করেছিল তার ঠিক নেই। কেননা পাকসেনাদের চেয়ে রাজাকারদের অত্যাচারের ভয়ভীতি বেশি বিরাজ করতো নারীদের মধ্যে। রাজাকাররা সুযোগ পেলেই নারীদের ইজ্জত হরণ করতো। এমনকি ইজ্জত হরণ করা শেষে গলা টিপে হত্যা করতো। সেজন্যে রাজাকার আর পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচারের ভয়ে সেদিন সকিনাদের গ্রামের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বনজঙ্গলে পালিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু সকিনা বিবি ও মুক্তিযোদ্ধারা ভীতি প্রদর্শন না করে পাকসেনাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য ঝোঁপঝাড়ে কিংবা গাছের আড়ালে অবস্থান করে। মুক্তিযোদ্ধারা ঝোঁপের আড়ালে অবস্থানের এক পর্যায়ে পাকসেনাদের আসতে দেখে একজন মুক্তিযোদ্ধা চুপি চুপি সবাইকে জানিয়ে দিল, পাকিস্তানি শয়তানরা আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে, তোমরা সবাই প্রস্তুত হও। পাকিস্তানি খান সেনারা সকিনাদের বাড়ির কাছাকাছি আসার সাথে সাথে কমান্ডারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের উদ্দেশ্যে অনাবরত গুলি ছোড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে দুই জন পাকসেনা সাথে সাথে মারা যায় এবং বাকিরা মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর রেডিও বার্তার মাধ্যমে সকিনা বিবিরা জানতে পারে পাকসেনারা পরাজয় বরণ করে নিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মুক্তিসেনাদের বিজয় মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠেছে বাংলার আকাশ।
এদিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিজয় উল্লাসের ক্ষণে সকিনা বিবি হন্তদন্ত হয়ে তার স্বামীর কাছে টেলিফোন করে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন সকিনা বিবি শত চেষ্টার পরও তার স্বামীর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। তারই প্রেক্ষিতে মর্মাহত হয়ে স্বামীর জন্য সকিনা বিবি আজও অপেক্ষার প্রহরে ঘরের দুয়ারে বসে থাকে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে, না জানি আবার কবে ফিরে আসবে ভালোবাসার মানুষটি।