সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০

মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘ভিত্তিফৌজ’ বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া ও মুক্তিযোদ্ধা যাছাই-বাছাই প্রসঙ্গ
অনলাইন ডেস্ক

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাটি সাবেক ইপিআর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে আওয়ামী লীগের জনাব আব্দুল হান্নানের কণ্ঠে ২৬ মার্চ ১৯৭১ সকাল বেলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থেকে সম্প্রচার করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এ ঘোষণায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেন এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে আমরা সংগঠিত হই এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

মহান মুক্তিযুদ্ধে এমএফ, এফএফ, বিএলএফ, বিএফ (ভিত্তিফৌজ) এবং ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গ্যারিলা বাহিনীর নামে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়েছিল। তন্মধ্যে ভিত্তিফৌজ (বিএফ) বাহিনীর গঠনের প্রয়োজনীয়তা এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করছি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ১৯৭১ সালে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে ২০০৩ সালে। অর্থাৎ ৩২ বছর পর। এই সুদীর্ঘ সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেছেন, অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সনদ হারিয়ে ফেলেছেন বা নষ্ট হয়ে গেছে, যা তালিকা চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে প্রমাণপত্র হিসেবে গণ্য হয়েছে। সঙ্গত কারণেই তালিকাটির সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ মুক্তিযোদ্ধা নন এমন ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের অধিকারী হয়ে যান এবং নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন। সমস্যাটির কথা অনুধাবন করে সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন। কমিটি ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নপূর্বক তা অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেন। সরকার তা অনুমোদনক্রমে গেজেট আকারে প্রকাশ করেন। গেজেটে প্রকাশিত এই তালিকা মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা হিসেবে বিবেচিত। গেজেটে অবশ্য এ কথা ও বলা হয়েছে যে, এই তালিকায় যদি কোনো অমুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে এবং তা যদি যথাসময়ে তদন্তে প্রমাণিত হয়, তা হলে প্রকাশিত তালিকা হতে তার নাম প্রত্যাহার করা হবে, তার অনুকূলে প্রদত্ত সাময়িক সনদ বাতিল করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। এ সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চূড়ান্ত তালিকাটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল এবং একটি অসাধারণ কাজ।

২০০২ সালে জাতীয় সংসদে জামুকা আইন ২০০২ পাস হয়। এই আইনে বলা হয়েছে, যে সকল ব্যক্তির ২০১০-এর পূর্বে প্রকাশিত জামুকার সুপারিশ বিহীন শুধু গেজেট রয়েছে, কিন্তু অন্য কোনো প্রমাণক নেই তারা যাচাই-বাছাই করে এর আওতায় আসবেন। বর্তমানে উক্ত আইন মোতাবেক এখনও যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলামান। তবে এই যাচাই-বাছাই নিয়ে জামুকার কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। আশা করি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রকাশিত হবে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় ও দেশীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমএফ, এফএফ, বিএলএফ, বিএফ ও ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গ্যারিলা বাহিনীর মধ্যে বিএফ (ভিত্তিফৌজ)-এর গঠন প্রণালী সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করছি।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ চলাকালে কিংবা পরবর্তী সময়ে দেশ গড়ার সৈনিক রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘ভিত্তিফৌজ’ গড়ে তোলা হয়। তৎকালীন কুমিল্লার হাজীগঞ্জের ড. হাবিবুর রহমান (ছদ্ম নাম ছিল ড. আবু ইউছুফ)কে আহ্বায়ক করে ‘ভিত্তিফৌজ’ সংক্রান্ত স্কিম প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। সদস্য ছিলেন চট্টগ্রামের মাহবুব আলম চাষী, তাহের উদ্দীন ঠাকুর এবং কুমিল্লা বোর্ডের উপ-পরিচালক অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত গুপ্ত। প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমদ ভিত্তিফৌজের সব রকম পরিকল্পনার সংগে যুক্ত ছিলেন। অ্যাডভোকেট আহম্মদ আলী এমপিএ উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ড. হাবিবুর রহমান যুব ব্যবস্থাপনা ও ট্রেনিংয়ের ওপর চারটি ইনস্ট্রাকশন সেট তৈরি করে ছিলেন। তন্মধ্যে স্কিমস অব ইয়ূথ ট্রেনিং কোর্স একটি। ইয়ূথ ক্যাম্প পরিচালনার কাজে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি যোগাযোগ করেন। যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে পরিচালনার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুজিব নগরে একটি ইয়ূথ ট্রেনিং কন্ট্রোল বোর্ড গঠন করেছিলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছিলেন এই বোর্ডের প্রধান বা চেয়ারম্যান। এই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ত্রিপুরা রাজ্যকেন্দ্রিক পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক পশ্চিমাঞ্চলের জন্য দুটি ইয়ূথ ক্যাম্প ডাইরেক্টোরেট গঠন করা হয়েছিল। পশ্চিমাঞ্চলের চাইতে পূর্বাঞ্চলের ইয়ূথ ক্যাম্পগুলো বেশি কার্যকর ছিল। ইয়ূথ ক্যাম্পগুলোর দৈনন্দিন কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কতগুলো পদ সৃষ্টি করা হয়। পদগুলো হচ্ছে--ক্যাম্প প্রধান, উপ-ক্যাম্প প্রধান, ক্যাম্প তত্ত্বাবধায়ক, ছাত্র প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য অফিসার, পলিটেক্যাল মোটিভেটর এবং ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর।

পূর্বাঞ্চল ইয়ূথ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ডাইরেক্টোরেট প্রকল্প সমন্বয়কারী মাহবুব আলম, পরিচালক (প্রশিক্ষণ), ড. হাবিবুর রহমান, নুরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ, মুজাফ্ফর আহম্মদ, খালেদ মুহম্মদ আলী এমএনএ, বজলুর রহমান, রাজনৈতিক নেতা, অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত গুপ্ত, উপ-পরিচালক ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী এবং হিসাব রক্ষণ অফিসার মোশাররফ হোসেন।

বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় আগত যুবকদের অভ্যর্থনা ক্যাম্পে রাখা হতো। ক্যাম্পগুলোতে যুবকদের বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক ও নিরাপত্তার সুযোগ ছিল। অভ্যর্থনা কেন্দ্র থেকে যুবকদের ৪৫ দিন প্রশিক্ষণের জন্য যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রেরণ করা হতো। যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে গ্রেনেড নিক্ষেপ, মাইন পুঁতে রাখার কৌশল, রেকি, মূল মুক্তিবাহিনীর অভিযানের তথ্য সহায়তা কৌশল প্রভৃতি প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।

ভিত্তিফৌজ গঠন করা হয় নানা কারণে। লক্ষ লক্ষ ছাত্র যুবককে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু যুব শক্তিকে কাজে না লাগিয়ে ফেলে রাখাও ছিল বিপদজনক। নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ভারী অস্ত্রের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দরকার ছিল। কিন্তু ক্রান্তিকালে এত সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। যুবকদের মধ্যে একটা অংশকে 'ভিত্তিফৌজ' বা সামরিক ও অর্থনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে স্বাবলম্বী কার্যশৃঙ্খলার ভিত্তিতে এবং পঞ্চায়েতী শাসনের মাধ্যমে মুক্তিকামী জীবন যাপন শৃঙ্খলার দুর্গ গঠনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ 'ভিত্তিফৌজ' বাহিনীর নির্দেশনা পত্র দেয়া হয়। দেশের ভিতরে ও বাইরে যাতে নির্বিঘ্নে চলতে পারে তজ্জন্য এদেরকে পরিচয়পত্রও দেয়া হয়।

লিবারেশন কাউন্সিল পূর্বাঞ্চলীয় জোনের যুব ত্রাণশিবিরে ভিত্তিফৌজের ৪০ দিনের ট্রেনিং সিডিউল তৈরি করা হতো। ১ম হতে ৩য় দিবস রেজিস্ট্রেশন ও সাব গ্রুপিং, ৪র্থ হতে ১৭তম দিবসে মোটিভেশন ট্রেনিং, ১৮তম ও ১৯তম দিবসে মুক্তিবাহিনীতে নিয়োগ, ২০ তম দিবসে শপথ, ২১ তম হতে ৩৪তম দিবসে ভিত্তিফৌজের পদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ, ৩৫ তম হতে ৩৭ তম দিবসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্রিফিং, ৩৮তম হতে ৩৯ তম দিবসে ভিত্তিফৌজের অ্যাসাইনমেন্ট রেজিস্ট্রেশন ও সার্টিফিকেট প্রদান এবং ৪০ তম দিবসে পার্সিং আউট।

তথ্য সূত্র : আবুল কাসেম রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা, কুমিল্লার ইতিহাস’ : ৪র্থ খণ্ড, প্রথম প্রকাশ- ২০০৯।

লেখক পরিচিতি : ভারতীয় ভিত্তিফৌজ বাহিনীর নং- ২৪১০৭৭ তারিখ : ১১/১২/১৯৭১; সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও সাবেক সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি। জন্মস্থান : উপজেলা- হাজীগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়