প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা?’ মাতৃভাষা সমাসবদ্ধ পদ। ব্যাকরণের দিক দিয়ে ৬ষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। অভিধানে লেখা আছে স্বদেশের ভাষা। ভাষা খেলা করে জিভের ডগায়। ঘোষিত হয় গলার মধ্য দিয়ে। প্রাণ লাভ করে ফুসফুসে। আসলে ওর জন্ম বুকের মধ্যে। উৎস মানুষের মন। আমাদের মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্প চূর্ণকারী আরাকানের রাজসভায় মণিময় অলঙ্কার। বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহ্বান। মাইকেল মধুসূধন দত্ত, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষা আমার মাতৃভাষা, আমাদের মাতৃভাষা, বাঙালির মাতৃভাষা। প্রতিটি শিশুর জন্য মায়ের দুধ যেমন পুষ্টিকর ঠিক তেমনি প্রতিটি মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য মাতৃভাষা পুষ্টিকর। ভাষা যে কোন জাতির সৃজনশীল ধী শক্তির অপূর্ব সৃষ্টি। জাতির মেধার অনন্য লালন ক্ষেত্রে। জাতির মননের আকর্ষণীয় স্থাপত্য। সারাবিশ্বে প্রায় সবক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা এ রকমই হয়ে থাকে। আজ মহান একুশে ফ্রেরুয়ারি-বাঙালির ভাষার মাস। শুধু বাংলা ভাষাই নয়, পৃথিবীর ছোট-বড় সব জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা আর গুরুত্ব তুলে ধরার মাস। কৃষ্ণচূড়ার রক্ত লালে রাঙ্গানো বসন্তে আবার ফিরে এসেছে সেই ফেব্রুয়ারি মাস। মাতৃভাষাকে চির অম্লান করে একটা সংগ্রামের জাগ্রত চেতনার মাস। একটা লাল তারিখের অণু-পরমাণুতে গড়া নবচেতনার মাস, জীবন দর্শনের মাস। স্বার্থসিদ্ধির কালো মেঘের বক্ষ বিদীর্ণ করে সূর্য ওঠার মাস। বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবি তথা বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপানের মাস। আর্থ-সামাজিক অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতি তার সকল বঞ্চনাকে এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মূর্ত করতে চায়। ফলে দেখা যায় যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার পরও এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ দিবস ও শহীদ মিনারের আবেদন এতটুকু কমেনি। ইতিহাস গড়ে উঠে, ইতিহাস রচিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস এমনিভাবে প্রাণ পেয়েছে যদিও তার প্রতি বাঁকে বাঁকে রয়েছে নির্মল রক্ত কণিকার মণিমুক্ত। পাকিস্তানের শাসকেরা বাংলাভাষাকে কোনোদিন সু-নজরে দেখেননি। তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, বাংলা হিন্দুর ভাষা, হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাই শাসক গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান গণপরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে একটি ‘মূলনীতি কমিটি’ গঠন করেন এবং পাকিস্তানের সংবিধান রচনার মৌল বিষয়বস্তু নির্ধারণের ভার এই কমিটির ওপর ন্যাস্ত করা হয়। ১৯৫০ সালে ‘মূলনীতি কমিটির’ রিপোর্ট প্রকশিত হয়। এই রিপোর্ট পূর্ব বাংলার জনমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ এতদিন যা দাবি করে এসেছে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তার কোনোটিতে তা স্থান পায় নি। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। তিনি ঢাকায় এসে ১৯৫২ সালের প্রথম দিকে ভাষার প্রশ্নটি আবার উত্থাপন করেন এবং পল্টন ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তিটি আবার ঘোষণা করেন ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এবার কিন্তু প্রতিবাদের ঝড় তুমুল আকার ধারণ করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রাদেশিক পরিষদের আসন্ন অধিবেশনকে সামনে রেখে দেশব্যাপী আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বে কয়েকটি পথসভা, পতাকা দিবস পালন এবং সর্বত্রই জনগণের উৎসাহ উদ্দীপনা প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা জনগণের ভাষার এই মৌলিক দাবিটি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে তা ব্যাপক ভিত্তিক এক আন্দোলনের পত্তন করেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল সরকার এই আন্দোলনকে চেয়েছিলেন বানচাল করতে। যদিও আন্দোলনের যৌক্তিকতা ছিল সন্দেহাতীত। পাকিস্তানের শতকরা আটজন লোক উর্দুতে কথা বলে। অথচ তা হবে রাষ্ট্রভাষা এবং যে ভাষার দেশের শতকরা ৫৬ জন লোক কথা হলে তা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করবে না-এই যুক্তি একমাত্র নির্বোধ ছাড়া সকলেই বোঝে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ছিল বলদর্পী ও ক্ষমতালোলুপ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির হরতালকে বানচাল করার জন্য শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রফিক, জব্বার, শফিউর রহমান প্রমুখ অকালে ঢলে পড়লো, ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হলো এবং সবকিছই শুধুমাত্র মাতৃভাষার দাবিতে। পরবর্তী ১৯৫৩ সালের কমিটির রিপোর্টের আলোকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে মর্যাদা দানের সুপারিশ করা হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দুর সঙ্গে বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে আমাদের মাতৃভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ আরো ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। লেখক, কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রমুখ প্রত্যেকে মাতৃভাষায় তাদের কাব্য, সাহিত্য ও মতবাদ রচনা করেছেন এবং সম্মানিত হয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় বাংলা ভাষায় লিখে আবার সম্মানিত হয়েছেন। বর্তমানে পৃথিবীতে ৭০০০-এর বেশি ভাষা আছে। একমাত্র বাংলা ভাষার জন্যই মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছে। বিশ্বে ৬ষ্ঠ সর্বাধিক উচ্চারিত বাংলা ভাষায় ২০ কোটি লোক কথা বলেন। এ দুনিয়ায় কেবল মাত্র ২০০টি ভাষায় বই, টিভি, সংবাদপত্র, সিনেমা কিংবা বেতারে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভাষার দেশ পাপুয়া নিউগিনি, সেখানে ৮০০টির বেশি ভাষা রয়েছে। এর পরে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, সেখানে ৬৭০টি ভাষার চল মানুষের মুখে। প্রতি দুই সপ্তাহে একটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে পৃথিবী থেকে আনুমানিক ২৩১টি ভাষা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর পৃথিবী জুড়ে প্রায় ২৪০০টি ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। আমরা চাই আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা দিনে দিনে আরো সম্প্রসারিত হোক। সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলা ভাষার অনেক উন্নতি বা পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান সরকারে দক্ষ এবং আন্তরিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে সাধারণ অধিবেশনে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাকে যথার্থ স্থানে স্থান দেয়ায় ১৮৮টি দেশের সমর্থনে সারাবিশ্বে আজ যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে দিবসটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। শুধু এখানেই শেষ বলা যাবে না, যারা সেদিন ভাষা শহীদদের বুকে গুলি চালিয়েছিল, তাদের দেশেও আজ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। অত্যন্ত আনন্দের সাথে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক একটি অর্জনের কথা লিখছি। নিউইয়র্ক সিটির ১৮০০ পাবলিক স্কুলে বাংলা শিশুদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১১ লাখ স্কুল ছাত্র-ছাত্রীর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষায় সুযোগ পাবে। নিজেদের বাবা মায়ের ভাষার সঙ্গে আরও সুন্দরভাবে পরিচিতি হওয়ার সুযোগ মিলবে। এজন্যে অভিনন্দন জানাই নিউইয়র্ক স্কুল চ্যান্সেলর কংগ্রেসম্যান নিদিয়া ভ্যালেসকুয়েজকে। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে যে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল এবং পরের দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের শহীদ শফিউর রহমানের গর্বিত পিতার হাতে উদ্বোধনের পরে আজ সেই ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি চির প্রবহমান নদীর ধারার মত দেশ ও বিদেশে অবস্থিত সকল শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভে আবাল বৃদ্ধবণিতার মাধ্যমে ফুলে ফুলে বা ভালবাসার মালায় মালায় সিক্ত হয়ে শ্রদ্ধা আর ভক্তিতে ভরে উঠেছে। আর অন্তরের অন্তস্থল হতে হৃদয়ের সমস্ত অনুভুতি দিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং প্রয়াত সুরকার আলতাফ মাহমুদের সুরে কালজয়ী গানটি দলে দলে গাইছে ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি.......................................।’
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, ০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, [email protected]