সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’; মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান/ জীবন দিয়ে এই ভাষার রাখব সম্মান।’ মূলত ভাষাপ্রেমেই রয়েছে দেশপ্রেম। মাতৃভাষা মহান আল্লাহর বিশেষ এক নেয়ামত। মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা ও টান যেমন, মাতৃভাষার প্রতিও প্রত্যেকের টান ও ভালোবাসা তেমন। ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষ জন্মলগ্ন থেকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে তা তার সহজাত প্রবৃত্তি ও জন্মগত অধিকার। আল্লাহ তায়ালার অগণিত নেয়ামতরাজির মধ্যে ভাষা অন্যতম। ভাষা সম্পর্কে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। (সুরা রূম, ২২)

আল্লাহ তায়ালা আরও ইরশাদ করেন, ‘দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। সৃজন করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা।’ (সুরা রাহমান, ১-৪)।

ভাষাবিশারদগণের পরিসংখ্যান মতে, পৃথিবীতে আড়াই হাজারেরও বেশি ভাষা রয়েছে। তন্মধ্যে বাংলা সপ্তম। এ ভাষায় পঁচিশ কোটির অধিক মানুষ কথা বলে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা অতি প্রাচীন ভাষা। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষাও বাংলা। আমরা এ ভাষা নিয়ে গর্বিত-পরিতৃপ্ত। কোনো জাতিকে সফল হতে হলে তার মাতৃভাষাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। মাতৃভাষার চেতনা যে-কোনো জাতিকে উন্নতির সিঁড়িতে পৌঁছাতে পারে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মধ্যে ভাষাগত যে বিভিন্ন রূপ, তা মহান রবের অশেষ রহমতের অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত এক বাগানসদৃশ। আর আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলা সেই রহমতেরই একটি ফুল। আল্লাহ অন্তর্যামী। তিনি সব ভাষা বোঝেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে জাগতিক সব মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা অপরিসীম। সব ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। যে-কোনো ভাষায় তাঁকে ডাকা যায় এবং অন্তরের অব্যক্ত নিবেদন ব্যক্ত করা যায়। তাই মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনয় ও মিনতিপূর্বক প্রার্থনায় দেহ, মন ও আত্মায় এক অনাবিল স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। আর এতেই মাতৃভাষায় বান্দার সার্থকতা নিহিত।

মহান আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসূলকে আসমানি কিতাবসহ স্বজাতির ভাষায় পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক নবিকে তাদের স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি তাদের সম্প্রদায়ের কাছে, যাতে তারা জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হয়।’ (সুরা ইবরাহিম, ০৪)। যেমন আল্লাহর নবি হজরত মুসা (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল ইবরানি বা হিব্রু। তাই এ ভাষায় তাওরাত নাজিল হয়। হজরত দাউদ (আঃ)-এর গোত্রের ভাষা ছিল ইউনানি। তাই যাবুর ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। অন্যদিকে মহান আল্লাহ হজরত দাউদ (আঃ)-কে দান করেছিলেন সুমধুর কণ্ঠস্বর। ফলে তাঁর ওপর নাজিলকৃত কিতাব পাঠ করার সময় তাঁর কণ্ঠের মোহনীয় সুরের মূর্ছনায় আল্লাহর বাণী শোনার জন্য সাগরের মৎস্যপ্রজাতি কিনারে এসে ভিড় জমাত। আবার সোলায়মান (আঃ)-কে মহান আল্লাহ পশুপাখির ভাষাসহ সব জীবের ভাষা বোঝার জ্ঞানদান করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি তাদের শাসনও করেছেন এবং তাদের কথাবার্তা শুনে অত্যন্ত সুচারুভাবে বিবদমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিতেন। ইনজিল কিতাব নাজিল হয় সুরিয়ানি ভাষায়। আর শেষনবি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে আরবি ভাষায়।

আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আল্লাহ তায়ালা অন্তর্নিহিতভাবে জীবকুল, বৃক্ষলতা এবং জড়পদার্থের কথা শ্রবণ ও অনুধাবনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। যদিও তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা ছিল পবিত্র আল কোরআন। তাই মহাগ্রন্থ আল কোরআন তাঁর মাতৃভাষা আরবিতে নাজিল হয়। নবি করিম (সাঃ)-এর ওপর অবতীর্ণ ঐশীগ্রন্থের ভাষার প্রাঞ্জলতা দেখে সমকালীন কবি-সাহিত্যিকরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তখন আরবদের মাতৃভাষায় অবতীর্ণ আল কোরআনের ভাষার লালিত্য ও নৈপুণ্য দেখে দার্শনিক ও সাহিত্যিকরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে প্রশান্তির পরশ লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ নবি ও রাসুল মুহাম্মদ (সাঃ)-কে যদিও তাঁর জাতির ভাষায় কোরআন নাজিলসহ পাঠিয়েছিলেন তবে তিনি অন্য নবিদের মতো নন। তিনি হলেন সর্বজনীন নবি। তিনি সারা বিশ্বের সব মানুষের নবি ও রাসুল এবং মানবমুক্তির অগ্রদূত। আর তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনকে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর কাছে সুন্দর কণ্ঠস্বর, সুললিত ভাষায় এবং বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন। যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর শিক্ষক ছিলেন।

বিশ্ব মুসলিমের জন্য সুসংবাদ এবং সান্ত¡নার বাণী এতটুকুই যে, আজ সারা বিশ্বে অনেক ভাষায়ই পবিত্র কোরআনের অনুবাদ হচ্ছে। এমনকি যে কেউ ঘরে বসেই তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কোরআনের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত কপি সহজেই হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে বহু অমুসলিম এ পবিত্র গ্রন্থের অনুবাদ পড়ে বহুত্ববাদের ধারণা পাল্টে আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয় পাচ্ছে এবং মুসলমান হচ্ছে ও পারলৌকিক জীবনে মুক্তির পথে নিজেকে খুঁজে নিচ্ছে।

মাতৃভাষা হলো ইসলাম প্রচার-প্রসার, দ্বীন ও জাতির খেদমতের অন্যতম মাধ্যম। দাওয়াতে দ্বীনের অন্যতম কৌশলও হলো বোধগম্য ভাষায় দাওয়াত উপস্থাপন করা। তাই একজন মানুষের বড় গুণ হলো, তার মাতৃভাষায় যথার্থ পারদর্শিতা অর্জন করা।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মাতৃভাষায় অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কুরআন-হাদিস তথা ইসলাম প্রচারে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। সে হিসেবে প্রত্যেক বাঙালি মুসলমান, বিশেষ করে আলেমণ্ডওলামাদের কর্তব্য হলো, মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগী হওয়া। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) তার সন্তানকে অশুদ্ধ ভাষার জন্য শাসন করতেন। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশ আলেমই বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চায় অনেক পিছিয়ে।

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে অমানিশার ঘোর থেকে আলোর পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য সত্যের বার্তাবাহক তথা নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের ওপর যেসব আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল, সেগুলোর ভাষাও ছিল ওইসব নবি-রাসূলের স্বজাতির মাতৃভাষা। প্রিয়নবি (সাঃ) মায়ের ভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। নবি করিম (সাঃ) সবচেয়ে উন্নত ও মার্জিত ভাষায় কথা বলতেন। কারণ তিনি শিশুকালেই আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্রে লালিতপালিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি প্রমিত আরবি ভাষা রপ্ত করেছেন। এ কারণেই তিনি বলতেন, ‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত।’

সুতরাং মাতৃভাষা মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার সেরা দান বা অনুগ্রহ। তাইতো মাতৃভাষার চর্চা ও একে উন্নত করার অধিকার সবার একান্ত কর্তব্য। মাতৃভাষা চর্চা ও রক্ষাও প্রত্যেকের নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব।

ইসলাম জাতি, গোষ্ঠী, বর্ণ, আঞ্চলিকতা ও ভাষার সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে ধর্মপ্রচারে জোরালো নির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেছে- ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে মানুষকে হেকমত (বিজ্ঞানসম্মত) ও সদুপদেশ দিয়ে আহ্বান করো এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আলোচনা করো। (১৬ : ১২৫) তাই জনগণকে মাতৃভাষায় বিশুদ্ধ ও সুন্দর উচ্চারণে বোঝানোর জন্য সকলের দক্ষতা অর্জন করা অপরিহার্য।

১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে যাঁরা বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করেছে, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমাদের ভাষা দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে, তাদের প্রত্যেকের অবদানকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন-এই কামনা করি।

লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়