সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক

যে কোনো জাতির প্রধান অবলম্বন, উন্নয়ন ও বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। তা সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত পাকিস্তানের পূর্বাংশের অধিবাসীগণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন সেই ১৯৪৮ সালেই। বিশ্বে খুব কম ভাষাভাষিই আছে যারা তার মাতৃভাষার অস্তিত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে বা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। ১৯৫২ সালের ‘একুশের’ আন্দোলন সংগ্রামের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৭ দিন পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা) প্রতি স্বৈরাচারী পাকিস্তানী পাঞ্জাবী শাসক শ্রেণীর বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে অহিংস নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে অধ্যক্ষ আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিস’। প্রথমেই উক্ত সংগঠনের পক্ষ হতে পাকিস্তানের সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর (৭%) মাতৃভাষা ‘উর্দু’র পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর (৬৩%) মাতৃভাষা বাংলা'কে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার এবং ‘উর্দু’কে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা নাকরার পক্ষে আন্দোলন ও কর্মসূচি ঘোষণা করে।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এসে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে (ছাত্র সমাবেশে) ঘোষণা করলেন, উর্দু, উর্দুই হবেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। সেখানে প্রতিবাদী ছাত্রনেতা আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ছাত্রগণ জোরালো প্রতিবাদ জানান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান, ঢাকায় নবাব নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আমীনসহ তাদের এদেশীয় দোসরগণ অনুরূপ ঘোষণা দান করেন। সে সময়ের উঠতি ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের তারুণ্যদৃপ্ত কণ্ঠে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদী সেচ্চার না...... না। সেই কণ্ঠের সঙ্গে হাজারো কণ্ঠে না...... না ...... না ধ্বনির প্রতিধ্বনিতে ঢাকার পল্টন ময়দান ও আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলো। এই একটি প্রতিবাদী সোচ্চার ‘না’-ই পরবর্তীকালে বাংলার ইতিহাসে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বীজ বপন করে, যা বাঙালি মাত্রই সকলেই অবগত। সেদিন রাতেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হলো বাংলার প্রাণপ্রিয় বিপ্লবী সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’।

শেখ মুজিব ও অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দের মাতৃভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার এ ন্যায্য প্রতিবাদ মেনে নিতে পারেনি স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শাসকগণ। ঐ সময়ে সংঘটিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনের পক্ষে কথা বলার জন্য ও মাতৃভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ন্যায্য প্রতিবাদ করার জন্য প্রথমেই অন্যায়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব হারাতে হলো তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে। তাতেও রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন-সংগ্রাম হতে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতাকে বিরত করতে না পেরে এবং 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'-এর দাবি নস্যাৎ করার জন্য তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (কুমিল্লা) উর্দুর সাথে বাংলাকে সমমর্যাদা প্রদানের জোর দাবি রাখেন। মাতৃভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ন্যায্য প্রতিবাদ করার জন্য ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি নেতাকে তার চরম খেসারাত দিতে হয় নিজের জীবন দিয়ে।

স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এ দেশীয় দোসর চক্রান্তকারীরা বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অঙ্কুরেই ধ্বংস করার মানসে শুরু করলো বাঙালিদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে তৈরি হওয়া ‘ভাষা সংগ্রাম কমিটি’ সাংগঠনিকভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মীগণ আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহাবুব (সরু কাজী), গাজীউল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, কবি মোফাখখারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার স্বতঃর্স্ফুত অংশগ্রহণে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'-এর দাবির আন্দোলন সারা পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' এ দাবি শুধু শ্লোগানেই পরিণত হয়নি, শেষ পর্যন্ত দখলদার পাকিস্তানিদের জিন্দানখানা হতে শৃংখলিত নিরীহ অসহায় বাঙালি জাতির মুক্তিই ছিল সেদিনকার লড়াকু প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার 'মাথা নত না করা'র প্রতিজ্ঞা বা দীক্ষা।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুবলীগের নেতা অলি আহাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আব্দুল মতিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি গোলাম মাওলা, কাজী গোলাম মাহাবুব (সরু কাজী), গাজীউল হক প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ রাজনীতি সচেতন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভা-সমাবেশ-মিছিল করে যাচ্ছিলেন।

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হতে পরবর্তী ২ সপ্তাহে সংঘটিত আন্দোলন সংগ্রামের দৃঢ়তা ও গতিশীলতার চালচিত্র পর্যবেক্ষণ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালি ছাত্র-জনতার স্বতঃর্স্ফুত আন্দোলন, দেশাত্মবোধ ও সাহস পাকিস্তানিদের মিথ্যা অহংবোধকে পদাঘাত করেছিল। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ আইন সভার প্রথম বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। সে কথা স্মরণে রেখেই ছাত্র নেতৃবৃন্দ ২১ ফেব্রুয়ারি সকালেই প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার ন্যায্য দাবিতে শান্তিপূর্ণ সাদামাটা কর্মসূচি নস্যাৎ করার জন্য স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে। পরবর্তী এক মাসের জন্য ঢাকায় সভা-সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ করে। শাসকগোষ্ঠী ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বিকেলেই ঢাকা শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল এলাকায় মাইকে ঐ অন্যায় নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা বারবার প্রচার করতে থাকে। নিষেধাজ্ঞার সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে প্রবল বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয়।

ঐ অন্যায় নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা শুনে রাজনীতি সচেতন সাধারণ ছাত্র-জনতা অবাক হয়ে যায়। শেখ মুজিবসহ অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দ তখন জেলে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির জন্য ঐদিন ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অধিকাংশই ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গার বিপক্ষে ছিলেন। এমনকি 'সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের' সভাপতি আবুল হাশিম সাহেবও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের গৃহীত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেননি। তবে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গার বিপক্ষে ১১-০৩ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হলেও বাঙালি তরুণ ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণের দাবি 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' এ অভিমতকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি।

২০ ফেব্রুয়ারি'৫২ রাত্রেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ সারারাত পরবর্তী দিনের (২১ ফেব্রুয়ারি) কর্মসূচি সফল ও সার্থক করার জন্য নিজেদের মধ্যে অবিরাম শলা-পরামর্শ করতে থাকেন। একুশের ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় পূর্ব নির্ধারিত সভায় উপস্থিত হওয়ার, ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল নিয়ে অ্যাসেম্বলী হাউজ ঘেরাও এবং 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা'র পক্ষে প্রস্তাব নিতে এমএলএদেরকে বাধ্য করতে একে অপরকে অনুরোধ করেন।

ঢাকার রাজপথে ২১ ফেব্রুয়ারি'৫২-এর সকালে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছাত্র-জনতা এমনকি ছাত্রীবৃন্দ মিছিল বের করেন। মায়ের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে নিরস্ত্র নিরীহ ছাত্র-জনতার মিছিলে বেপরোয়া লাঠি চার্জ এবং সর্বোপরি নির্মমভাবে গুলি চালালে রফিক, সালাম, বরকত, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা বাংলা মায়ের অনেক বীর সন্তান প্রাণ হারান, আহত হন অনেক অগণিত ছাত্র-জনতা। এই জঘন্য নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে সারা বাংলায় বিক্ষোভ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তিনদিন লাগাতার হরতাল পালিত হয়। শত বাধা আর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জীবনকে বাজি রেখে কয়েকজন মেডিকেল ছাত্র কাঁচা হাতে গড়ে তুলেন একুশের মহান শহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। নির্মাণের ৬০ ঘন্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতার দাপটে স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়।

২১ ফেব্রুয়ারি' ১৯৫২ ঢাকার রাজপথে মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে নিরস্ত্র নিরীহ ছাত্র-জনতার মিছিলের ওপর পুলিশের বর্বরোচিত অত্যাচার ও নির্মম গুলিবর্ষণের জন্য সর্বমহলের ধিক্কারের ফলে বিব্রত স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার তার পক্ষাশ্রিত বিচারপতি এলিসকে দিয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট 'তদন্ত কমিশন' গঠন করে। 'তদন্ত কমিশন' অর্থাৎ চাটুকার বিচারপতি এলিস তদন্ত শেষে সরকারের কাছে যে একপেশে প্রতিবেদন পেশ করে, তা ছিল মিথ্যা, পক্ষপাতদুষ্ট এবং নৈতিকতা বিরোধী। বাঙালি জনমত বিচারপতি এলিসের এ ধরনের প্রতিবেদন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এ ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাথে শুধু অবাঙালি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ মাহামুদ, চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমেদই সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, বাঙালি ডিআইজি ওবায়দুল্লাহ এবং মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনও সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

২১ ফেব্রুয়ারি'৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সারাদেশে স্বৈরাচারী পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও মুসলিম লীগ বিরোধী গভীর ক্ষোভ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমান্বয়ে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। যার ফলে ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে হক-ভাসনী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন গঠিত যুক্তফ্রন্ট পূর্ববাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগকে উৎখাত করতে সমর্থ হয় এবং সরকার গঠন করে। একই সাথে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিখ্যাত ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ১৬ নম্বর দফা মোতাবেক মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন 'বর্ধমান হাউজ' (বর্ধমানের মহারাজা স্যার সমীন্দ্রচন্দ্রের ঢাকার বাগানবাড়ি) বর্তমান বাংলা একাডেমীতে রূপান্তরিত হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলেই ১৯৫৫ সালে সংবিধানের ২১৪ অনুচ্ছেদে আমাদের মাতৃভাষা 'বাংলা'কে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করা হয়। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের আবু হোসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রীত্বের আমলে বর্তমান স্থানে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ গেট সংলগ্ন) একুশের মহান শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও ভাষাশহীদ বরকতের মা হাসিনা।

এরপর ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রখ্যাত শিল্পী হামিদুর রহমানের নক্সানুযায়ী 'শহীদ মিনার' তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে স্বৈরশাসক আইউব খান ক্ষমতা দখল করে বাঙালির প্রাণের দাবি 'শহীদ মিনার'-এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। ১৯৭১ সালেও স্বৈরাচারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ কালো রাতে যেমন বাঙালি জাতির ওপর নির্মম হামলা চালায় তেমনি 'শহীদ মিনারটিও গোলার আঘাতে ও বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে এ 'শহীদ মিনার' আজ বাঙালি জাতির হৃদয়ের মিনার হিসেবে স্থায়ীরূপ লাভ করে হয়ে উঠেছে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আদর্শিক কেন্দ্রবিন্দু।

২১ ফেব্রুয়ারি ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে '৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় বাঙালি জাতিকে দাবি ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এবং মাথা উঁচু করে বাঁচবার পথ দেখিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় '৫৮-এর স্বৈরশাসক আইউবের সামরিক শাসন বিরোধিতায়, '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৬ বাঙালির বাঁচার দাবি 'মুক্তির সনদ' ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করতে অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছে। স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণার অপরাধে শেখ মুজিব ও তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদসহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। তাঁদের মুক্তির দাবিতে ৬৬ সালের ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। এ হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁওয়ে শ্রমিকনেতা মনুমিয়াসহ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১১ জন শ্রমিক অকাতরে জীবনদান করেন।

পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইউব বাঙালিদের দমন না করতে পেরে তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী বাঙালি রাজনীতিক ও পেশাজীবী নেতৃবৃন্দকে ঐতিহাসিক 'আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায়' গ্রেফতার করে প্রহসনের বিচারে মৃত্যুর দ্বারস্থ করেন। বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের সীমাহীন শোষণ-বঞ্চনা-অন্যায়-অত্যাচার-অবহেলা-নিপীড়নের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়ালে আইউব বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধে, সূচনা হয় বাঙালির নবজাগরণের। প্রকৃত প্রস্তাবে মধ্য ষাট দশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখ্য অবলম্বন হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির পুনর্জন্ম ঘটে।

ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ও বাঙালির স্বাধিকার দাবি রূপলাভ করে গণঅভ্যুত্থানে। এজন্যে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হতে এ দেশে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শুরু হয়েছিল যে জীবন দানের মিছিল, তাতে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সংযোজিত হয়েছে সার্জেন্ট জহুরুল হক, ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ, কিশোর মতিউর, প্রখ্যাত শিক্ষক ড. শামসুদ্দোহা (ড. জোহা)সহ শত শত দেশপ্রেমিক বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইউব-মোনেমশাহী বাঙালির আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্য জাতীয়তাবাদী বাঙালি রাজনীতিক ও পেশাজীবী নেতাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হন। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার গণমানুষের কাছে বাঙালি জাতির মুক্তির দূত 'বঙ্গবন্ধু' রূপে আবির্ভূত হলেন। তারপর এলো ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধিকারের নৌকা প্রতীকে ৯৮% ভাগ ভোট দিল।

স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তা বিজয়ী বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করলো। পশ্চিম পাকিস্তান হতে আরেক মীরজাফর জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব বাংলায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা 'প্রলোভনের টোপ' দিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দৃপ্ত কণ্ঠে জানালেন, আমার বাংলার মানুষ বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে রায় দিয়েছেন, তার সাথে আমি বেঈমানি করতে পারি না। আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না; আমি বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তি চাই।’

আলোচনার নামে অযথা সময়ক্ষেপণ করে নরঘাতক ইয়াহিয়া খান ও হানাদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান হতে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য আনতে শুরু করলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ৭১ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে বললেন, এবারের সংগ্রাম ... ... স্বাধীনতার সংগ্রাম। এরপর ২৫ মার্চ ৭১ মধ্য রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হানাদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে তাঁরই সহকর্মীগণের সুযোগ্য পরিচালনায় দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী জীবনমরণ সংগ্রামে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণের এক সাগর রক্তের এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে আমাদের হারানো স্বাধীনতার সূর্য পুনরায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়। মহান একুশ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক মহান বিপ্লব, যার ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। ৫২ সালের একুশের মাতৃগর্ভ হতেই পুনর্জন্ম লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৫২ সালের একুশের প্রতিবাদী চেতনা বাঙালি জাতির মেধা ও মননে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে আছে। যখনই শোষণ-বঞ্চনা-অন্যায়-অত্যাচার-অবহেলা-নিপীড়ন বা অধিকার হরণের ঘটনা ঘটে, তখনই শোষক ও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠে লাখো লাখো কণ্ঠে গগন বিদারি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আওয়াজ।

একুশের প্রতিবাদী চেতনা বাঙালি জাতির জীবনে এমন এক উত্তরাধিকার, যা আমাদের প্রেরণা দেয় সর্বক্ষণ, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। ৫২ সালে একুশের ভাষা আন্দোলন এক পর্যায়ে গিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করলেও আজো অর্ধ শতাব্দীর পর অধিকার বঞ্চিতদের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে মহান একুশের চেতনা। এমনকি যেখানেই শোষণ-বঞ্চনা-অন্যায়-অত্যাচার-অবহেলা-নিপীড়ন বা অধিকার হরণের ঘটনা ঘটে সেখানেই ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়ায় মহান একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে একুশ আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়ে গেছে। একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে দিতে পারে। পারে দেশ থেকে অপসংস্কৃতি, ধর্মান্ধতা ও কলুষতার বিষবাষ্প চিরতরে মুছে দিতে। গড়ে তুলতে পারে এক সাম্প্রদায়িক, ডিজিটাল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। একুশ মানেইতো মাথা নত না করা।

লেখক : মোঃ নূর ইসলাম খান অসি। নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও সংগঠক। ছাত্র জীবনে দীর্ঘদিন (১৯৭০-১৯৮৭) মুজিবাদর্শের ছাত্র সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরিচালক- ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মোবাইল ফোন : ০১৭১১-৫৮৫৮৭৫

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়