প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
একদিকে প্রচণ্ড কুয়াশা, অন্যদিকে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। সবকিছু মিলিয়ে আড্ডা যে জমে যাবে কে জানতো। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা, রাতভর বিশাল রান্নাবান্নার আয়োজন, উৎসবমুখর দিন। ফুলেল শুভেচ্ছা, ঘোড়া আর ব্যান্ড বাজিয়ে অতিথিবরণ! একসঙ্গে হাজার লোকের খাবার । এটা বুঝার আর বাকি নেই, বলছি এসো মিলি জলধারায় চাঁদপুরে প্রথম আলো বন্ধুসভার জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের পিকনিক আনন্দ আয়োজনের কথা। এক কথায় বলা চলে, এটি ছিল দেশের সর্ববৃহৎ দিনভর বন্ধু আড্ডা। এমন আড্ডা আর কেউ কখনো করেছে কি না বলতে পারবো না।
২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাত তখন আটটা। চাঁদপুরে প্রথম আলোর প্রতিনিধি আলম পলাশ ভাই জানালেন, চমক থাকছে, ব্যতিক্রম আয়োজন। পৌষের এই শীতের রাতে প্রায় ২০ কি. মি. মোটরবাইক চালিয়ে আমি পৌঁছালাম প্রিয় পলাশ ভাইয়ের বাসায়। সেখান থেকে আমরা ছুটলাম চাঁদপুরের পর্যটকদের আকর্ষণীয় স্থান তিন নদীর মিলনমেলা সংলগ্ন বড় স্টেশন মোলহেডে। ততক্ষণে চাঁদপুর বন্ধুসভার সদস্যদের উপস্থিতিতে ইলিশ কাটা, মুরগি কাটার বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। যেন এক বিশাল বিয়ের আসরের আয়োজন।
পলাশ ভাইয়ের বিচক্ষণতার জুড়ি নেই। বলেই ফেললেন হাজার কেন, এর চেয়ে অনেক বেশি লোকের আয়োজন করা মামুলি ব্যাপার। কী প্রাণবন্ত চাঁদপুর বন্ধুসভার সকলে। আয়োজনের দেখভালে যেন কোনো ত্রুটি নেই। চাঁদপুর বন্ধুসভার বিদায়ী সভাপতি তৌহিদুর রহমান জনি জানালেন, বিশাল এই কর্মযজ্ঞের হোস্ট হতে পেরে তার দল দারুণ আনন্দিত। ততক্ষণে পলাশ ভাইয়ের একটি অনুষ্ঠান করতে যত নির্দেশনা, পরিকল্পনা সব কিছু প্রণয়নে যেন একবিন্দুও কমতি নেই।
সব কিছু ভাল ভাবে সম্পন্ন করতে বন্ধুসভার বন্ধুদের আন্তরিকতার শেষ নেই। এই শীতের রাতে বেশ ক'জন ছেলে ও মেয়ে বন্ধু সেখানে তাঁবু টানিয়ে থেকে গেছেন। একদিকে প্রচণ্ড শীত, অপর দিকে পদ্মা-মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর জলছোঁয়া ঠাণ্ডা হাওয়া।
পরের দিন সকাল সাড়ে নয়টা। পলাশ ভাই আর আমি গেলাম বন্ধুদের বরণ করার ফুল কিনতে। বড় স্টেশন মোলহেড পৌঁছাতেই ভাই বললেন, অতিথিদের ঘোড়ায় চড়িয়ে বরণ করবো । বললাম, চমৎকার উদ্যোগ। বিশাল রিজার্ভ লঞ্চে চড়ে অতিথিরা আসবেন, আমরা অপেক্ষায়। কিন্তু তারা বহুদূর। কারণ ভোরের কুয়াশায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চ স্বাভাবিক গতিতে চলছিলো না। এদিকে ঘড়ির কাটায় বারোটা বাজতেই বাস বোঝাই করে হাজির চাঁদপুর শিশুপরিবারের ৮০ জন শিশু মেয়ের একটি দল। পলাশ ভাই বললেন, এই একটা দিন তো আমরা সুবিধা বঞ্চিত এসব এতিম শিশু মেয়ের সাথে আমাদের আনন্দ ভাগ করতে পারি। বন্ধুসভার কেন্দ্রীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়ের পরামর্শে আমরা আমন্ত্রণ জানাই শিশু পরিবারের শিশুদের। কী অসাধারণ চিন্তা। শিশু পরিবারের শিশুরা লাল সবুজে সজ্জিত হয়ে আমাদের এই আয়োজনকে আলোকিত করেছে দারুণভাবে। তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচণ্ডগানে পুরো বড়স্টেশন মোলহেড এলাকাকে আরও আলোকিত ও আনন্দিত করে তোলে। শিশু পরিবার কর্তৃপক্ষ এসব শিশুকে এতোটাই দায়িত্বের সাথে যোগ্য করে তুলছে সেটা প্রমাণ করে এই অসাধারণ প্রতিভা দেখে। এরপর বন্ধুসভার পক্ষ থেকে সকলের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দেওয়া হয় একটি করে স্কুল ব্যাগ। এগুলো পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিল। তারপর তাদের নিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ। এদিকে ঘড়ির কাঁটায় তখন ৩টা ছুঁই ছুঁই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেলো দূরে একটি লঞ্চ মোলহেডের দিকে ছুটে আসছে। যদিও শীতকালে মেঘনায় স্রোত থাকে না, কিন্তু বড় কিছুর যে বড় হুংকার এ তো নতুন কিছু নয়। লঞ্চ এসে ভিড়লো তীরে, তবে নোঙ্গর ফেলতে পারলো না মূল জায়গাতে। যেখানে আমরা ব্যতিক্রম ভাবে বরণে একটা মুগ্ধতা ছড়াতে পারতাম। সারেং-এর ভুলে সব যেন ভেস্তে যাওয়ার অবস্থা। চাঁদপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা এসময় দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে লাগলো। কাঙ্ক্ষিত গন্তেব্যে এসেও যেন ছুঁয়ে দেখা হলো না। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী পলাশ ভাই তো নাছোড়বান্দা। চাঁদপুরের পুরানো সেই লঞ্চ ঘাটে এসে ভিড়লো লঞ্চ। সেখান থেকে জনে জনে প্রায় নয়শ’ বন্ধু যেন এক জনস্রোতে আস্তে আস্তে পায়ে হেঁটে মোলহেডে মিলিত হন। তাদের নেতৃত্বে আমাদের প্রিয় উত্তম রায় দাদা। ইলিশ ভাস্কর্যের সামনে আসার পর যেন রাজকীয় সংবর্ধনা। দুটি ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ফুল হাতে বন্ধুসভার বন্ধুরা। যেন উষ্ণ অভ্যর্থনা। সবাই দারুণ উল্লসিত। যেন প্রাণের স্পন্দনে শিহরিত চারপাশ। সানাইয়ের সুর আর ঢাকের তালে মিলন মেলা যেন উৎসবের নতুন এক মাত্রা যোগ করেছিলো। দাদা ঘোড়ায় চড়ে মোলহেডের একবারে শেষ প্রান্তে ছুটে গেলেন। বাঁধভাঙা উল্লাস, চারিদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। যেন খুশিতে আত্মহারা সব বন্ধু। হয়তো সেজন্যই দাদা বলছিলেন, "অসাধারণ লাগছে। আমি যেটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে চাঁদপুরের আয়োজন ছিল অসাধারণ, অবিশ্বাস্য। চাঁদপুর বন্ধুসভার বন্ধুরা যেভাবে আমাদের স্বাগত জানালো সত্যি আমি আবেগাপ্লুত। আমি নিশ্চিত করে বলতো পারবো, এমন আয়োজন কেউ করতে পারবে না।” যেন স্বাগত জানানোর ভাষাটাই ব্যতিক্রম ছিল দাদার। দাদা বললেন, চাঁদপুর বন্ধুসভা, চাঁদপুর প্রতিনিধি এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য আমার ভালবাসা।
বন্ধুসভার নির্বাহী সভাপতি মৌসুমি মৌ আপা তো বলেই ফেললেন, "চাঁদপুর এসে মনে হয়েছে যেন রূপকথার রাজ্যে এসেছি। আমরা লঞ্চ থেকে নামলাম, ব্যান্ড বাজিয়ে আমাদের বরণ করা হলো। দুটো ঘোড়া দাঁড়িয়েছিলো। অসাধারণ! আসার সময় প্রেসিডেন্ট এসব বলছিলো। আমার মনে হয়েছিলো বোধয় প্রেসিডেন্ট আমাদের ইমপ্রেস করতে এসব বলছে। কিন্তু নেমে মনে হলো, আলটিমেটলি ঘটনাটা সত্য ঘটেছে। এখানকার পরিবেশ চমৎকার। নদীর পাড়ে বসে ইলিশ খাবো, অন্যরকম আনন্দ। সংস্কৃতিমনা শিল্প সাহিত্যের মধ্যেই চাঁদপুরের মানুষ জীবন-যাপন করে। নদীর সাথে সখ্যতা তাদের।
বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিক ভাই তো খুশিতে টইটম্বুর। তিনি এর আগেও চাঁদপুর এসেছিলেন। চাঁদপুরকে ভালবাসেন সে কথা বলছিলেন। গুণগান গাইতে একবিন্দু কৃপণতা ছিল না। রক্তধারার সামনে দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করলেন। প্রশংসায় পঞ্চমুখ করলেন প্রথম আলো বন্ধুসভার চাঁদপুরের কমিটিকে।
চাঁদপুর ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক শহর। এখানে মিশেছে পদ্মা-মেঘনা আর ডাকাতিয়া। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী বন্দর। বিখ্যাত ইলিশের জন্য তাই নাম দেয়া হয়েছে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। হানিফ সংকেত তো এই মোলহেডে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, রৌদ্রোজ্জ্বল রূপালি ইলিশ নয় নয় বেশি দূর, এখানে এলেই দেখা পাবে তার, এই সেই চাঁদপুর। ভাঙনের মুখে বিপন্ন, তবুও হৃদয়ে আশার সুর, এই সেই চাঁদপুর। শিল্প, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটেছে চাঁদপুরে। অতিথিপরায়ণ চাঁদপুরের বন্ধুরা সে কথা আবার জানান দিলেন। কবিগুরুর ছন্দে তাল মিলিয়ে বলতে চাই, "প্রশ্ন যদি শুধায় কোনো-কিছু/নীরব থেকো মুখটি করে নীচু/নম্র দু-নয়নে / কাঁকন যেন ঝংকারে না হাতে, পথ দেখিয়ে আনবে যবে সাথে অতিথিসজ্জনে।"
পুরো সময়টাতে এত বিশাল বহরের অতিথি আপ্যায়নে হয়তো কিছুটা ভুলত্রুটি হতেই পারে, কিন্তু আপ্যায়নে ঘাটতি করেনি বন্ধুরা। স্বাগতিক হিসেবে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে বন্ধুসভা চাঁদপুরের প্রতিটি বন্ধু, আলোকিত করতে এই আয়োজন। এসো মিলি জলধারায় যেন সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মিলন মেলার সাক্ষী হলো চাঁদপুর।
বিদায়ের ক্ষণে যেন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। আবার আমন্ত্রণ হে বন্ধুগণ। জীবনানন্দের কবিতার মতই আসুক ফিরে এমন ক্ষণ। আমরাও বলতে চাই, আবার আসিব ফিরে, এই (মেঘনা) ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়। হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে। লেখক : রিফাত কান্তি সেন, বর্তমান সভাপতি-বন্ধুসভা, চাঁদপুর।