প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
দার্শনিক তত্ত্ব, পৌরাণিক কাহিনী ও আনুষ্ঠানিকতা। এ তিন নিয়েই সমগ্র ধর্মশাস্ত্র। ধর্মের অনুষ্ঠানের পিছনে থাকে মহাপুরুষদের জীবনের উদাহরণ অথবা পুরাণের কাহিনী। মহাপুরুষদের উপলব্ধি বা দর্শন অনুসারেই তাঁদের আচরণ হয়ে থাকে।
তরু মানে গাছ। পুরাণের বর্ণনায় কল্পতরু এমন এক গাছ যার নিচে গিয়ে যে যা চিন্তা করে তা ফলে যায়। এক বনে এমন এক গাছের নিচে গিয়ে এক লোক ভাবল কী সুন্দর বাতাস, যদি এখানে কোনো বিছানা থাকতো, বেশ হতো। অমনি এক সুন্দর বিছানা সেখানে এসে গেল। লোকটি ভাবলো, এ তো কল্পতরু! যা ভাববো তা-ই হবে! যদি খুব উপাদেয় খাবার চলে আসে, তবে মজা করে খাওয়া যেত। অমনি সুন্দর সুস্বাদু খাবার এসে গেল। খাবার খেয়ে সে বিছানায় শুয়ে ভাবছে---এখন কোনো মেয়েমানুষ যদি তার সেবা করতো তাহলে খুব আনন্দ হতো। সেখানে এক মেয়েমানুষ এসে তার সেবা করতে লাগল। তখন আবার মনে হলো---এটা তো বন, যদি বাঘ এসে যায়! সত্যিই বাঘ এসে গেল। তার প্রাণও গেল। তাহলে আমাদের মনকে সংযত করে আমাদের জন্য যা মঙ্গলজনক তা-ই প্রার্থনা করতে হয়। নইলে যা ইচ্ছা তা-ই চাইলে শেষে দুঃখপূর্ণ মৃত্যুকেই বরণ করতে হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ কেমন কল্পতরু? কলকাতার কাশীপুরে এক বাগানবাড়িতে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেখানে তাঁর অসুস্থ শরীরের চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু সর্বদা ঈশ্বরীয় ভাবনা, কথা। ভক্তরা তাঁর কাছে আসেন, কথা বলেন, প্রাণের শান্তি নিয়ে ফিরে যান। প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশ ঘোষ শ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত। তাঁর বিশ্বাস ‘পাঁচশিকে পাঁচ আনা’ যে, শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার। তিনি সকলকে যুক্তি দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে বুঝিয়ে দেন। গিরিশ বলেন---মাতাল পাপী গিরিশকে উদ্ধার করতেই শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ গুরুতর অসুস্থ। সকলেই তাঁকে দেখতে আসছেন। সেদিন ১লা জানুয়ারি ১৮৮৬। বেশ ক’জন ভক্ত সমবেত হয়েছেন বাগানবাড়িতে। বিকালে শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ সুস্থ বোধ করছেন। দোতলার কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে তিনি পায়চারি করছেন। ভক্তরা দেখতে পেয়ে সকলে ঘিরে তাঁর সঙ্গেই হাঁটছেন।
গিরীশ ঘোষের শ্রীরামকৃষ্ণকে অবতার বলে বিশ্বাস। কাশীপুর উদ্যানে বেড়ানোর সময় ভক্তদের সাথে কথা বলছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। গিরীশ ঘোষকে হঠাৎ বললেন---“গিরীশ, তুমি যে সকলকে এত কথা (আমার অবতার সম্পর্কে) বলিয়া বেড়াও, তুমি (আমার সম্বন্ধে) কী দেখিয়াছ ও বুঝিয়াছ?’’ গিরীশ এতটুকু বিচলিত না হয়ে বললেন---“ব্যাস বাল্মিকী যাঁহার ইয়ত্তা করিতে পারেন নাই, আমি তাঁহার সম্বন্ধে অধিক আর কী বলিতে পারি।” মানে, সপ্তকাণ্ড রামায়ণ লিখে বাল্মিকী মুনি রামরূপী ভগবানের মহিমা বর্ণনা করে শেষ করতে পারেননি, অন্যদিকে লক্ষশ্লোকী বিশাল মহাভারত লিখে, ভাগবত ইত্যাদি পুরাণ লিখেও ব্যাসদেব শ্রীকৃষ্ণরূপী ভগবানের মহিমা বর্ণনা করে শেষ করতে পারেন নি। সেই ভগবানই এখন শ্রীরামকৃষ্ণরূপ ধারণ করেছেন---সেই ভগবানের মহিমা গিরীশের মত লোক কিভাবে বর্ণনা করতে পারেন! গিরীশের অন্তরের সরল বিশ্বাস প্রতি কথায় ব্যক্ত হওয়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে উপলক্ষ করে সমবেত ভক্তদের বললেন, ---“তোমাদের কি আর বলিব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক।” যুগ-যুগান্তরের সর্বশ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ সকল ভক্তদের জন্য। মানুষ তো ঈশ্বরকে ভুলেই আছে। আর তাই কষ্ট পাচ্ছে। চৈতন্য হলেই সব হলো। মানুষ তখন হবে মানহুঁশ। শ্রীরামকৃষ্ণ সকলকে স্পর্শ করে তাদের ভেতর চৈতন্য জাগিয়ে দিচ্ছেন। ঘুমে অচেতন হলেই মানুষ নানা দুঃস্বপ্ন দেখে কষ্ট পায়। এ কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের জেগে উঠতে হবে। যিনি আমাদের জাগিয়ে দিয়ে দুঃস্বপ্নের ভয় ও কষ্ট থেকে মুক্ত করে দিতে পারেন, তিনিই আমাদের প্রকৃত বন্ধু। ঈশ্বর আমাদের সব দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের চাইতে হবে সেই সব যা আমাদের ঘুম থেকে, অজ্ঞান থেকে জেগে উঠতে সহায়তা করে।
আমাদের জীবনেও যেন আমরা ঘুমিয়ে আছি। দুঃস্বপ্ন দেখছি---ও আমার বন্ধু, সে আমার শত্রু। কিন্তু মহাপুরুষদের বসুধৈব কুটুম্বকম্---জগতের সকলেই আত্মীয়। কেউ পর নয়। কিন্তু আমরা তা বুঝতে না পেরে ছল চাতুরি করে অন্যকে ঠকিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিই। অহঙ্কারে পূর্ণ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করি। মহৎ ব্যক্তিদের অবজ্ঞা করে বসি, সামান্য বিষয় নিয়ে রেগে গিয়ে এমন কাজ করে বসি যে সারা জীবন আমাদের অনুশোচনা করে কাটাতে হয়। আমাদের শরীর চিরদিন থাকবে না, কিন্তু ভ্রমে পড়ে শরীরকে চিরদিন রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা করে থাকি। এমন মোহগ্রস্ত যে, আমাদের চারিদিকে প্রাণিগণ মারা যাচ্ছে, কিন্তু আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা মনে করি আমরা কোনোদিন মরব না। শরীরে থাকে রক্ত, মাংস, মল, মূত্র, কফ---নানা দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ, এ শরীরকে আমরা সুন্দর ও পবিত্র মনে করি। এই শরীর মন ব্যবহার করে আমরা জীবনসমস্যার সমাধান করতে পারি, কিন্তু তা না করে জীবনের সমস্যাগুলোকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে চলেছি। বেশি ভোগ করতে গিয়ে রোগে পড়ে যেতে হয়। সেইজন্য আমাদের চৈতন্য হওয়া উচিত---কী করলে জীবনটা ধন্য হবে। আমাদের সমস্ত বাসনা পূর্ণতা পাবে। সেটাই আমাদের ভাবতে হয়। যাকে লাভ করলে আর জীবনের কোনো লাভকে বড় বলে মনে হয় না, তাকেই লাভ করতে হবে।
আমাদের চৈতন না হওয়াতে আমরা ব্যর্থ জীবন যাপন করে এই জগৎ রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিই। কিন্তু জীবনকে কী করে সার্থক করা যায়। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী করে পরিপূর্ণ হয়---এটাই ভাবনার বিষয়। এই জীবনটা আনন্দময় হয় যাতে তা-ই আমাদের করা কর্তব্য। জগৎ ও জীবনকে আনন্দময়ের খেলা দেখতে পাওয়া এবং এ খেলায় আমরা প্রত্যেকেই অংশগ্রহণ করছি---এ ধারণা হলেই এটা সম্ভবপর। চৈতন্য হলে আমাদের কী হয়? শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেই বলে দিচ্ছেন, যার চৈতন্য হয়েছে সে দেখে তিনিই সব হয়েছেন। তার চেষ্টা করে পাপ ত্যাগ করতে হয় না। সে যা করে তাই সৎকর্ম হয়।
আমাদেরও চৈতন্য হলে আমরা সৎকর্ম ছাড়া অসৎ কর্ম করতে পারব না। ফলে আনন্দ পাব ও অভয় হবো। আর বোধ হবে যে, ঈশ্বরই একমাত্র কর্তা, আমরা সব অকর্তা। কিন্তু কর্তৃত্বের এমনই রকম যে, যদি চোর ধরে তাহলে তো প্রথমে খুব পেটায়, পরে জেলে দেয়, আর বলে----‘জানে না, কার টাকা চুরি করেছে?’ আবার বাবু লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি উঠছে, হঠাৎ বুকে ব্যথা। ধর ধর। গেল। বাবুর হৃদ্যন্ত্র বিকল। বাবু আর নেই। এই শরীরের এত অভিমান? এই শরীরই হাতিতে চড়ে রাজা হয়। এই শরীরই কালের কবলে পড়ে মৃত্যু হলে শিয়াল-কুকুরের খাবার হয়ে হয় বিষ্ঠা, এরা না খেলে হয় কৃমি, পুড়িয়ে ফেললে হয় ভস্ম। যে দেহের এই পরিণতি তাকে ‘আমি আমি’ মনে করে লোকে কর্তা সাজে। আসলে ঈশ্বরই কর্তা। কর্মফল অনুসারে তিনি সকল প্রাণীকে পরিচালনা করছেন। এইজন্যই তিনি ঈশ্বর বা নিয়ন্ত্রণকারী। আমরা ভুলে মনে করি আমরাই কর্তা। যাদের চৈতন্য হয়েছে তাদের সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন যে, “তারা জানে যে, ঈশ্বরই একমাত্র কর্তা, আর সব অকর্তা।” চৈতন্য হলে আরও ধারণা হয় যে, আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী। আমি গাড়ি, তিনি ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর হাতের যন্ত্র হতে পারলে আমরা মায়ের কোলে শিশুর মতো নিরাপদ। চৈতন্য হলে আমরা বলতে পারব---তোমার যা ইচ্ছা তা-ই পূর্ণ হোক, আমি কিছু চাই না।
লেখক : স্বামী স্থিরাত্মানন্দ, অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ আশ্রম, চাঁদপুর।