সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক

যোগাযোগ ব্যবস্থায় যতগুলো মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে রেল সিস্টেম সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। পুরো পৃথিবীতে ব্যাপক জনপ্রিয় এই মাধ্যম অল্প সময়ে ও কম খরচে অনেক যাত্রী পরিবহন করতে পারে এবং চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালনা করা যায়। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে রেল তার প্রচলিত ধারণা ভেঙে আকার, আকৃতি, স্পিড, চলার পথ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে যার সর্বশেষ আধুনিক সংস্করণ হলো মেট্রোরেল।

১৮৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডনের কয়েকটা জায়গায় মাটির নিচ দিয়ে টানেল করে রেল চলাচলের মাধ্যমে যে সিস্টেম চালু হয়েছিল, সেই সিস্টেম ১৮৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন, ১৯১৯ সালে মাদ্রিদ, ১৯৩৫ সালে মস্কো, ১৯৫৪ সালে টরেন্টোসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও শহর ঘুরে ১৯৮৪ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা হয়ে ২০২২ সালে ডিসেম্বরে বাংলাদেশে প্রথম চালু হতে যাচ্ছে যা আমাদের জন্য একটি মাইলফলক।

সাধারণত কোনো একটি শহরের জনসংখ্যা ২০ লক্ষ বা তার বেশি হলে সেই শহরের জন্য ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেম পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সেই হিসেবে ঢাকার যানজট কমানোর জন্য এই ব্যবস্থা অনেক আগেই পরিকল্পনায় নিয়ে আসা প্রয়োজন ছিল। মেট্রোরেল একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প হলেও এর সুবিধা অনেক। প্রথমত মেট্রোরেলের সাহায্যে যাত্রীরা দ্রুত ও সহজে যাতায়াত করতে পারে। মেট্রোরেল এক সাথে অনেক যাত্রীকে বহন করতে পারে। সাধারণত ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট সিস্টেমে সক্ষমতা বোঝানোর জন্য Passenger Per Hour Per Direction (PPHPD) (প্রতি ঘণ্টায় এক দিকে কতজন যাত্রী পরিবহন করতে পারে তার হিসাব) ধরা হয়। সেই হিসাবে মেট্রোরেলের যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা প্রায় ৬০ হাজার চচঐচউ, যা বিআরটি সিস্টেমের চেয়ে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি।

দ্বিতীয়ত, মেট্রোরেল যানজট কমানোর মাধ্যমে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে। মেট্রোরেলে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার সুবিধার কারণে অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে দেবে যা রাস্তার উপর থেকে চাপ কমাতে সাহায্য করে।

রাস্তার উপর থেকে গাড়ির চাপ কমানো গেলে পথচারীদের হাঁটার জন্য বাড়তি জায়গা পাওয়া যাবে যা একটি পথচারীবান্ধব শহরের জন্য প্রয়োজন।

তৃতীয়ত, মেট্রোরেল যাতায়াতের খরচ কমাতে সাহায্য করে কারণ যানজটে যে পরিমাণ জ্বালানির অপচয় হতো তা এক্ষেত্রে হবে না। যাতায়াতের খরচ ও সময় কমে যাওয়ার কারণে পণ্য ও সেবার উৎপাদন ব্যয় ও কমে যাবে যা একটি প্রতিযোগিতামূলক নগরায়নের জন্য প্রয়োজনীয়। মেট্রোরেলের একটি অন্যতম সুবিধা হলো, পরিবেশ দূষণ কমানো। পরিবেশ দূষণ কমানো সম্ভব হলে মানুষের স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকবে তেমনি জীবনের উৎকর্ষতা আসবে।

মেট্রোরেল সিস্টেম আমাদের দেশে অনেক পরে শুরু হওয়াতে একটা সুবিধা হলো, আমরা চাইলেই এখন আধুনিক ব্যবস্থাপনা যা পৃথিবীতে ইতিমধ্যে পরীক্ষিত সেগুলো সরাসরি আমাদের মতো করে ব্যবহার করতে পারি।

যাতায়াত ব্যবস্থায় মেট্রোরেলের সুবিধা কতটুকু টেকসই হবে তা নির্ভর করে এই সিস্টেমের কয়েকটি টেকনিক্যাল বিষয়ের উপর। তার মধ্যে প্রথমেই আসবে স্টেশন ও টিকেটিং ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয়ত হলো, মেট্রোরেলে কোচ ও যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থাপনা এবং তৃতীয়ত হলো পরিচালনা পদ্ধতি এবং সবশেষে যাত্রী আগমন ও নির্গমন ব্যবস্থাপনা।

পৃথিবীর যেসব শহরে মেট্রো রয়েছে সেখানে স্টেশনগুলোর নকশা ও চিহ্নিত করার পদ্ধতি প্রায় এক রকম। যে কেউ নকশা বা মেট্রো সাইন দেখে স্টেশন বুঝতে পারে। তাই আমাদের স্টেশনগুলো যেকোনো ভাষাভাষীর জন্য সহজে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করা দরকার।

যে টিকেটিং ব্যবস্থা করা হয়েছে তা অত্যন্ত মানসম্মত। এখানে দুই ধরনের টিকেট যেমন সিঙ্গেল বা একবার ব্যবহার করা যায় এমন টিকেটের পাশাপাশি মেট্রো পাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই টিকেট ছাড়া কেউ মূল প্লাটফর্মে প্রবেশ করতে পারবে না এবং যাত্রার শুরু এবং শেষে টিকেট ইলেক্ট্রনিক সিস্টেমে যাচাই করা হবে। এর ফলে স্বচ্ছতা ও মান দুটোই বজায় থাকবে। টিকেট কাটার জন্য যে মেশিন রয়েছে (কিয়স্ক) সেখানে কীভাবে ধাপগুলো সম্পন্ন করতে হবে এবং কত টাকার নোট ব্যবহার করা যাবে সেই বিষয়ে যাত্রীদের জন্য বাংলা ও ইংরেজিতে নির্দেশনা থাকতে হবে।

এছাড়াও মেশিনে খুচরো টাকার পর্যাপ্ত সরবারহ থাকতে হবে যাতে করে টিকেটের অবশিষ্ট অর্থ ফেরত পেতে যাত্রীদের সমস্যা না হয়। মেট্রোরেলের ফলে এই প্রথম আমরা একই সাথে বিদ্যুৎচালিত ট্রেন সিস্টেমেও প্রবেশ করলাম। তাই যেকোনো দুর্যোগ বা জরুরি পরিস্থিতিও যেন পাওয়ার সাপ্লাই থাকে তার কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বিশেষ করে যেহেতু মেট্রোরেলের ট্রাক সম্পূর্ণটাই খোলা আকাশের নিচে থাকছে তাই রক্ষণাবেক্ষণ, পানি নিষ্কাশন ও পরিছন্নতা বজায় রাখা খুব জরুরি। মেট্রোরেলের কোচ ও যাত্রী পরিবহন পরিকল্পনায় একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এখানে বসে যাওয়ার চাইতেও দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এর একটা সুবিধা হলো অনেক যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব।

তবে এর একটা সমস্যা হলো, আমরা যদি ব্যাক্তগত গাড়ির ব্যবহারকারীদের মেট্রোরেলে তুলতে চাই তাহলে তাদের কথা মাথায় রেখে কিছু কোচে আসন সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ যিনি এতদিন নিজের গাড়ি করে যাতায়াত করতেন তাকে যদি ৯ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থের একটি কোচে প্রায় ৩০০ এর বেশি মানুষের সাথে দাঁড়াতে হয় তখন তিনি হয়তো বেশিদিন সেটা উপভোগ করবেন না।

আমাদের মনে রাখতে হবে, যতবেশি আমারা ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীদের মেট্রোতে তুলতে পারবে ততবেশি ঢাকার নিচের রাস্তা ফাঁকা হবে আর যানজট কমবে। প্রয়োজনে, একটি কোচে বেশি আসন বসিয়ে ভাড়ার হার কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। তবে এখানে মহিলাদের জন্য আলাদা একটা কোচ রাখা হয়েছে যা প্রশংসনীয়।

মেট্রোরেলে যাত্রী উঠাণ্ডনামার জন্য একই সাথে দরজা খুলবে ও বন্ধ হবে। একটি হলো মেট্রোর দরজা আরেকটি হলো স্টেশনের নিরাপত্তা দরজা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই মেট্রোরেলের দরজা খুব অল্প সময়ের জন্য খুলে এবং এই সময়ের মধ্যে যাত্রী উঠা ও নামা সম্পন্ন করতে হয়।

আমাদের যাত্রীদের একটি বিশেষ আচরণ হলো, দূরের স্টেশন গন্তব্য হলেও দরজার কাছাকাছি জটলা করে থাকে এবং সহযোগিতার মনোভাব অনেক সময় থাকে না। এখন অন্যান্য দেশের মতো যদি আমাদের এখানেও খুব অল্প সময়ে, ৩০ সেকেন্ডের জন্য দরজা খোলা হয় তখন একটি কোচের প্রায় ৩০০ জন যাত্রী অতিক্রম করে অনেকেই সময়মতো নামতে পারবে না এক্ষেত্রে শিশু বা বয়স্কদের সমস্যা আরও বেশি হতে পারে।

তাই দরজা খোলা ও বন্ধ হওয়ার সময় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় না করে প্রাথমিকভাবে ম্যানুয়াল বা একজন সাহায্যকারী রাখা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে মেট্রোরেল শুধুমাত্র একটা এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য রেল যোগাযোগ নয় বরং এটা একটা সিস্টেম। অর্থাৎ এই যে, প্রতি ঘণ্টায় দুইদিকে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে এই মেট্রোরেল দিয়ে তারা কীভাবে আসবে, কীভাবে তাদের গাড়ি পার্কিং করবে, কীভাবে তারা গন্তব্যে যাবে সেই বিষয়ও মাথায় রাখা জরুরি।

মেট্রো স্টেশনের আশেপাশে যাতে কোনো অবৈধ দোকান, পার্কিং, রিকশার জটলা বা অন্যকোনো সমস্যা না থাকে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে একজন যাত্রী তার ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল বা সাইকেল নির্দিষ্ট জায়গায় নিরাপদে রেখে মেট্রোতে করে কর্মস্থলে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে না পারলে আমরা দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল ধরে রাখতে পারব না।

মেট্রোরেলের মতো একটি আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য যাতায়াত ব্যবস্থার যে যাত্রা হতে যাচ্ছে তা ঢাকার যানজট দূর করে যাতায়াতের স্বাধীনতা এনে দিবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

কাজী মোঃ সাইফুন নেওয়াজ : সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়