প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতি—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরো অঞ্চল—তীব্রভাবে মন্থর হয়ে পড়েছে এবং এমনকি ‘পরবর্তী বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি মাঝারি আঘাত একে মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।’
উন্নত দেশেগুলো যদি সম্ভাব্য আর্থিক মন্দায় কবলিত হয় তবে তার ঢেউ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে আঘাত হানবে এবং এটাই স্বাভাবিক। অধিকন্তু, মুদ্রা পাচার, মার্কিন ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও প্রাপ্যতা সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস, মূল্যস্ফীতির আস্ফালন, জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ বেকারত্বের হার, দুর্নীতি ইত্যাদির যৌথ প্রভাবে এমনিতেই আমাদের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, নাজুক অর্থনীতি আরও নড়বড় করে দেওয়ার জন্য অনেকগুলো কারণ এর মধ্যে রয়েছে। যে কারণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সংকট। ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রুখতে বিনিময় হার সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই অর্থ বছরে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজারে সরবরাহ করেছে।
তাছাড়া, প্রতি মাসে প্রায় গড়ে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হয়। ফলে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী অক্টোবর ২০২২-এ আমাদের মোট (এৎড়ংং) বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের পরিমাণ ছিল ৩৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে, আইএমএফের মতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে ইডিএফ (রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল)-সহ অন্যান্য বরাদ্দ ও ব্যয় বাদ দিলে নেট মজুদ প্রায় ২৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। ফলে, বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় মেটানো কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আসে মূলত রপ্তানি আয় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। কিন্তু উন্নত দেশের মন্দার কারণে তৈরি পোশাক খাতেও রপ্তানি ফরমাশের পরিমাণ ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে।
তাছাড়া, ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাপড়, সুতা ও অন্যান্য এক্সেসরিজ উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অধিকন্তু, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে পণ্য পরিবহন খরচও বেড়ে গিয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ফলে, এখাতে মুনাফাও সংকুচিত হচ্ছে দিন দিন।
বিশ্বব্যাংকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্রিফ ৩৭ অনুযায়ী, বৈশ্বিক মন্দার কারণে চলতি ২০২২ সালে দেশে প্রায় ১০০ কোটি ডলার সমপরিমাণ প্রবাসী আয় কম আসতে পারে। একই সঙ্গে, টাকার বিপরীতে ডলারের সরকারিভাবে নির্ধারিত হারের চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক বাজারে ডলার প্রতি ৩-৪ টাকা বেশি থাকায় প্রবাসীরা অপ্রাতিষ্ঠানিক বিকল্প ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স পাঠাতে বেশি পছন্দ করে। ফলে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেমিট্যান্স পাঠানো কমে যাওয়ার কারণে প্রতি মাসে সরকার প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়া, অবৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারত রয়েই গেছে।
বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ সংকটের কারণে অনেক জরুরি আমদানিও ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে, বিদ্যুৎ খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ তার গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জ্বালানি, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে পারছে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি বাড়ছে। চলমান লোডশেডিং এর কারণে উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে, বাণিজ্য ঘাটতি আরও প্রকট হিসেবে দেখা দেবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৫৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতিও ১.৫৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সংকটের কারণে একটি দেশের অর্থনীতি কী ধরনের চরম বিশৃঙ্খলার পতিত হয় তার একটি উদাহরণ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। যদিও আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের অবস্থা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান থেকে বেশ ভালো, তথাপি যেকোনো ধরনের ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলায় আমাদের সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে আইএমএফ কিছু শর্ত সাপেক্ষে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে।
আগামী চার বছরে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২৬ এর মধ্যে সাত কিস্তিতে ঋণ বিতরণ করা হবে। আশা করা যাচ্ছে, ৪৪৭.৭৮ মিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যাবে। বাকি প্রতিটি কিস্তির পরিমাণ হবে ৬৫৯.১৮ মিলিয়ন ডলার। ঋণের সুদের হার ম্যাচুরিটির সময় বাজারের হারের উপর নির্ভর করবে। তবে অনুমান করা হচ্ছে যে, এই ঋণের সুদের হার দাঁড়াবে প্রায় ২.২ শতাংশে।
আইএমএফের ঋণের শর্তগুলো যদিও জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়নি, তথাপি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন আলোচনায় যতটুকু অনুমেয় তা হচ্ছে—জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সারসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি ভর্তুকি কমে যাবে। বড় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ভর্তুকি প্রত্যাহার ও আর্থিক খাতের সংস্কার। তাছাড়া, আরও বেশকিছু শর্তের কোথাও আলোচনায় উঠে এসেছে, যেমন সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ভ্যাট আইন পাস করা এবং বাস্তবায়নের জন্য কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ। কর ছাড় হ্রাস এবং জ্বালানির জন্য একটি সুষ্ঠু মূল্য নির্ধারণের সূত্র তৈরি করা যাতে স্থানীয় পণ্যের দাম বিশ্ব বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়।
আইএমএফের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টস এবং ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের হিসাবায়ন দেখান। সত্যিকারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তন ও সুদের হারের গ্যাপ প্রত্যাহার। খেলাপি ঋণ কমানো ও রাজস্ব আদায় বাড়ানো ইত্যাদি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে চারটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে আইএমএফের ঋণ সহায়তা নেওয়া হচ্ছে-বাহ্যিক খাত স্থিতিশীল রাখা, আর্থিক খাত স্থিতিশীল করা, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গ্র্যাজুয়েশনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়া।
সম্প্রতি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে সরকার ইতিমধ্যে আইএমএফের কিছু শর্ত পূরণ শুরু করে দিয়েছে। যেমন—সরকারি ভর্তুকি ও ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানি। তাছাড়া, আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের হিসাবায়ন শুরু করে দিয়েছে বাংলাদেশে ব্যাংক।
সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ঋণ নেওয়া যেতেই পারে। তবে, লক্ষ্য রাখতে হবে ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সংকট যেন আরও ঘনীভূত না হয়। আইএমএফ থেকে গৃহীত ঋণের অতীত অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ দেশগুলোর জন্য খুব একটা সুখকর নয়।
১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়া সংকটের সময় আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব আরও তীব্রতর হয়েছিল। ২০০১ সালে আর্জেন্টিনা উদ্ধারেও ব্যর্থ হয় আইএমএফ। বাংলাদেশও ২০১২ সালে আইএমএফের কাছে থেকে ৯৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ নিয়েছিল।
আইএমএফের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে, শর্ত পূরণ করতে গিয়ে ঋণ গ্রহীতা দেশগুলো ঝামেলায় পড়ে ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ভর্তুকি হ্রাস, কর মওকুফ সুবিধা প্রত্যাহার, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, সুদের হারের সীমানা তুলে দেওয়া, বিনিময় হারের নমনীয়তা, ইত্যাদির কারণে আমাদের অর্থনীতি আরও দুর্দশায় পতিত হতে পারে।
বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কষ্ট আরও বাড়বে। সরকার আগস্ট মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে প্রায় দেড় গুণ এবং এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণও হ্রাস করছে। অচিরেই গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও হয়তো বাড়বে আরও একধাপ।
মুদ্রাস্ফীতির আস্ফালন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা ও জ্বালানি তেলের মজুত হ্রাস, ইত্যাদি নিয়ে মানুষ এমনিতেই শঙ্কায় আছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফের ঋণ আমাদের এই শঙ্কা আরও বাড়াবে, নাকি স্বস্তি দেবে। এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার উপর।
সরকার যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সময়মত ও কৃচ্ছ্রতার সাথে সঠিক খাতে এটা ব্যবহার করতে পারে তবে আমরা অবশ্যই স্বস্তিতে থাকব। তাছাড়া, আইএমএফের ঋণ অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং ডলারের অস্থিরতা কিছুটা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক খাতগুলোর সংস্কার আশু জরুরি। বিশেষ করে সংশোধিত কোম্পানি ও ভ্যাট আইনের সেঠিক বাস্তবায়নসহ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ ও পুঁজিবাজারে দক্ষতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খেলাপি ঋণ হ্রাস শুরু করা অর্থনীতির জন্য একটা খুব ভালো উদ্যোগ। অর্থনীতির স্বার্থে দুর্নীতি ও মুদ্রা পাচার রোধেও সরকারের অচিরেই কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।