প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
আধুনিক শিশুসাহিত্যে উজ্জ্বল নায়কের নাম আলী ইমাম। সুবিশাল অধ্যায় রচনা করেছেন শব্দের জাদু দিয়ে। বাক্যের বুননে চিনিয়েছেন বাংলার অপরূপ ভাষার সৌন্দর্য।
বৈচিত্রময় বিষয় তার সুলিখিত রচনাগুলো হয়ে উঠলো শিশুসাহিত্যের সম্পদ। এই সম্পদ আঁকড়ে ধরে আমরা আলী ইমামকে নিয়ে খুলছি শোক বইয়ের পাতা।
তিনি নেই। চিরতরে বিদায় নিলেন ২১ নভেম্বর ২০২২। সেদিনের সন্ধ্যা স্তব্ধ করে দিল আমাদের চারপাশ। কী বিষণ্ন এক মুহূর্ত আমাদের জাপটে ধরলো খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে।
১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তার গল্পগ্রন্থ ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’, ১৯৭৮ সালে উপন্যাস ‘অপারেশন কাঁকনপুর’ প্রকাশিত হয় এবং ধারাবাহিকভাবে আরও কিছু উপন্যাস লিখেছেন। তারমধ্যে রহস্য উপন্যাস ‘তিরিমুখীর চৈতা (১৯৭৯)’, গল্পগ্রন্থ ‘রুপোলী ফিতে (১৯৭৯)’, ‘শাদা পরী (১৯৭৯)’, কিশোর উপন্যাস ‘ভয়ঙ্করের হাতছানি (১৯৯০)’ উল্লেখযোগ্য।
কবিতা ‘ধলপহর (১৯৭৯)’, ‘হিজল কাঠের নাও (১৯৮৬)’, জীবনী ‘খেয়াল খুশির রাজা (১৯৯১)’, কিশোর উপন্যাস ‘ভয়াল ভয়ঙ্কর (১৯৮৭)’, ‘নীল শয়তান (১৯৮৭)’, রূপকথা, উপকথা ও লোককাহিনী ‘জাদুর তুলি’ বইগুলো চিনিয়ে দেয় তার স্বকীয়তা।
তিনি আর হাঁটবেন না। তিনি আর লিখবেন না। তিনি আর কথা বলবেন না, স্বাক্ষর দিবেন না। তাহলে তিনি কোথায় থাকবেন? থাকবেন পাঠকের অন্তরে, বইয়ের পাতায় এবং শিশুসাহিত্যের শাখা-প্রশাখায়।
শিশুসাহিত্যের প্রতি দরদমাখা স্পর্শ ছিল তার। যেমন তার ব্যক্তিত্ব, তেমনই তার লেখার শক্তি। দুয়ে মিলে আলী ইমামকে এমন এক লেখকসত্তা দিয়েছে যা তাকে বানিয়েছে শিশুসাহিত্যের রত্নখনি।গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণা, প্রকৃতি, পশুপাখি, চলচ্চিত্র—প্রতিটি বিষয় তিনি শিশু সাহিত্যের পাতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। সমৃদ্ধ করেছেন শিশুসাহিত্যের ভা-ার। যা কখনোই ফুরোবার নয়।
দৃঢ়চিত্তে বলতে দ্বিধা নেই বাঙালির যে ঘরে শিশুকিশোর রয়েছে সেই ঘরে আছেন আলী ইমাম। বুকসেলফের কোনো এক তাকে শোভা পায় তারই গ্রন্থ।
আলী ইমাম এমনই একজন অনিবার্য শিশুসাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন, যাকে পাঠ করতেই হবে। তার রচনার জাদুকরি শব্দ বুননের স্পর্শে বাংলার প্রকৃতি হেসে ওঠে।
বৈশাখ, নবান্ন, হেমন্ত, শিশির, ঘাসবিচালী, পাখণ্ডপাখালি, আকাশ-চন্দ্র-সূর্য, তারা-নক্ষত্র-গ্রহ কোনো কিছুই এড়ায়নি আলী ইমামের চোখ থেকে।
বাদুরের নীল নখ খুঁজে বেড়ানো কিশোরের কৌতূহলী মন তিনি যেমন ধরতে পেরেছিলেন, তেমনি ধরতে পেরেছেন কল্পবিজ্ঞানের যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্যমালা কিংবা রহস্যভরা গোয়েন্দাগিরির শ্বাসরুদ্ধকর অ্যাডভেঞ্চার।আলী ইমামের নিজস্ব একটা পাঠক মহল আছে। এই মহলে বাস করেন তরুণ থেকে বৃদ্ধরা। এই মহলে বসে স্বপ্নের রঙিন ঘুড়ি ওড়ায় কিশোর-কিশোরীর দল।
লোকজ ঐতিহ্য লালন করার মধ্য দিয়ে এদেশের শিশুকিশোর পাঠকদের জন্য আলী ইমাম নিষ্ঠার সঙ্গে রচনা করেছেন দেশ-মহাদেশের গল্প এবং ছন্দময় বিষয় আশয়।
বাঙালির আবেগঘন গর্বিত উচ্চারণে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি চেতনা, বারবার নতুন স্পন্দনে জেগে উঠেছে আলী ইমামের কলমে। বিদেশি শিশুসাহিত্যও পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার লেখনীর মধ্য দিয়ে।
তিনি জন্মেছেন ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। স্থায়ীভাবে তারা ঢাকায় আসেন। ঢাকা শহরে তার বেড়ে ওঠা। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
লেখকসত্তার বাইরে তিনি কর্মময় কাল প্রবাহিত রেখেছিলেন গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব হিসেবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের তিনি মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় এনে দিয়েছেন শুদ্ধ ভাষা ও উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান।
তার প্রযোজিত অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’, ‘হ্যালো’, ‘আপনাকে বলছি’, ‘কুইজ-কুইজ সুখী পরিবার’, ‘পুষ্টি তথ্য’, ‘শিশুর অধিকার নিশ্চিত এবং সুরক্ষা’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আনজীর লিটন ।। ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক