প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
ভোরের শিশিরে পড়া সূর্যরশ্মি মুক্তার মতো আলো ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে, শীত আসছে। অনেকের কাছে হিম হিম এ শীতের আমেজটা উপভোগ্য ও রোমাঞ্চকর। তবে অনেকের জন্য এটি বেদনার কারণও হচ্ছে। কারণ, শীত তার সঙ্গে করে নিয়ে আসে ঠাণ্ডাজনিত অনেক রোগ-বালাই। বিশেষ করে শিশুদের রোগ-ব্যাধি এ সময় বেশি হয়। শীত ঝুঁকি বাড়ায় শিশুদের প্রাণ-সংহারি নিউমোনিয়া রোগের। প্রতিবারের মতো এবারও হাসপাতালগুলোতে এখনই দেখা যাচ্ছে নিউমোনিয়া-আক্রান্ত শিশুদের ভিড়।
মরিয়ম আক্তার, দুই বছরের কন্যাশিশু নিয়ে ভর্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। নিউমোনিয়া-আক্রান্ত এ শিশুই তার প্রথম সন্তান। মরিয়ম বলেন, চিকিৎসকরা বলছেন আমার বাচ্চার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ) প্রয়োজন। দুদিন ধরে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তির জন্য চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। কোনো শয্যা খালি নেই।
দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি হাজারে ৩৬১ জন শিশু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর বছরে মৃত্যু হচ্ছে ২৪ হাজার শিশুর। হাসপাতালে ৪৫ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এ রোগে সেবাগ্রহীতার ৪২ শতাংশের রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি (হাইপোক্সেমিয়া) দেখা যায়। অথচ দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই।
মরিয়ম আক্তারের মতো এমন অনেক উদ্বিগ্ন অভিভাবক সন্তানকে ঢাকা মেডিকেলের এনআইসিইউতে ভর্তির আশায় আবেদন জমা দিয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র জানা গেছে, এনআইসিইউতে মাত্র ৪২টি শয্যা আছে। সবই রোগীতে পরিপূর্ণ। শিশুদের একটি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ৩০ জনের ১১ জনই নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি।
তাদের ১৩ শতাংশের মৃত্যু ঘটে প্রয়োজনের সময় অক্সিজেন-স্বল্পতার কারণে, যা শঙ্কার কারণ হবে এই শীতেও।
১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যুর শঙ্কা
দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের একটি বড় অংশের শিশুর জন্য এনআইসিইউ প্রয়োজন হয়। তবে চাহিদার তুলনায় এর স্বল্পতা রয়েছে। এ সংকট নিরসন না হলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইউনিসেফ।
সবচেয়ে দরিদ্র ও বঞ্চিত শিশুরা নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ধনী পরিবারের শিশুদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সেবা পাওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেক। এমনকি পঞ্চম জন্মদিনের আগেই তাদের মারা যাওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি বলছে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু অক্সিজেন-স্বল্পতায় ভুগছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয় না। রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা ও মেডিকেল অক্সিজেনের অপ্রতুলতা শিশুদের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পালস অক্সিমিটার দিয়ে এটি মাপা যায়। কিন্তু শিশুদের পরিস্থিতি মাপার জন্য এ যন্ত্র পাওয়া দুষ্কর। তাই শিশুর মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে যাওয়া, দ্রুত শ্বাস নেওয়া, গলার মাংস ফুলে যাওয়া ও বুকের খাঁচার নিচের অংশ দেবে যাওয়া দেখে অক্সিজেন স্বল্পতা নির্ণয় করে চিকিৎসা দেন চিকিৎসকরা।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের যদি হাইপোক্সেমিয়া (রক্তে অক্সিজেন ঘাটতি) হয় এবং তারা যদি সময় মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন না পায়, তাহলে মৃত্যু হতে পারে। দ্রুত অক্সিজেন জোগান দিলে মৃত্যুর হার কমতে পারে। সরকারকে এ বিষয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফ প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, নিউমোনিয়ার কারণে ‘শিশুমৃত্যু বন্ধের সম্ভাবনা’র অগ্রগতি সেভাবে ত্বরান্বিত হয়নি। এজন্য স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, স্বাস্থ্যবিধি ও বায়ুদূষণসহ আন্তঃখাত সমন্বয়ে প্রকল্প প্রয়োজন। ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা যৌথভাবে বাংলাদেশ সরকারকে নিউমোনিয়া মোকাবিলায় সহায়তা করে।
অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত জরুরি
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর ২০২০ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬০টি জেলা সদর হাসপাতালের মধ্যে ৭২ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন মাপার ‘পালস অক্সিমিটার’ যন্ত্রটি আছে। মাত্র ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইসিসের (রক্তে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, অক্সিজেনের ঘনত্ব ও অ্যাসিড-ক্ষারের ভারসাম্য ইত্যাদি পরিমাপ করার পরীক্ষা) ব্যবস্থা পাওয়া যায়। মাত্র ১৮ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর যন্ত্র, ২ শতাংশ হাসপাতালে বাল্ক স্টোরেজ ট্যাংকে (একত্রে বিপুল মজুত) তরল অক্সিজেন সংরক্ষণ ও ৩ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট ছিল।
করোনাকালে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়াতে সরকার বেশ ক’টি বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নিলেও সেগুলো মোটেই যথেষ্ট নয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ডা. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের যদি হাইপোক্সেমিয়া (রক্ত অক্সিজেন ঘাটতি) হয় এবং যদি তারা সময় মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন না পায়, তাহলে মৃত্যু হতে পারে। দ্রুত অক্সিজেনের যোগান দিলেই কেবল তাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে। সরকারকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
অপর্যাপ্ত সেবা, অপুষ্টি এবং বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আক্রান্তের অধিকাংশই শিশু। ভ্যাকসিনের চাহিদা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ব্যবহৃত ভ্যাকসিন নিউমোভ্যাক্স ২৩-এর চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক সীমিত।
আইসিডিডিআর,বির নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের সিনিয়র বিজ্ঞানী (হাসপাতাল) ডা. মোহাম্মাদ জোবায়ের চিশতি বলেন, যখন করোনা মহামারি বিশ্বে আঘাত হানে, তখন হাসপাতালে রোগীদের একটি বড় অংশ মারা গিয়েছিল অক্সিজেনের অভাবে। সারা বিশ্বেই সব আকার-আকৃতির স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলো অক্সিজেনের আকাশচুম্বী চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছিল। যদিও ওই সময় বেশকিছু বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে পালস অক্সিমিটার ও বাবল সি-প্যাপের মতো স্বল্প মূল্যের উদ্ভাবনমূলক পদক্ষেপসমূহ গ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।
শীতের শুরুতে বাড়ে, গরমে কমে
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার বলেন, প্রতি বছর এই সময়টাতে ডেঙ্গু বাড়ে। শীত এলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসে। এবার ডেঙ্গু রোগীর চাপে নিউমোনিয়া অনেকটা এলোমেলো হয়ে আছে। এবার নিউমোনিয়ার পাশাপাশি ব্রংকিওলাইটিসও বেশি দেখা যাচ্ছে। এটিও অনেকটা নিউমোনিয়ার মতো, তবে এটি ভাইরাল নিউমোনিয়া।
তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালে যত শয্যা আছে তার ১৫ শতাংশ শয্যায় এখন নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে। এখন কোনো বেড ফাঁকা নেই। নিউমোনিয়ার জন্য আমাদের আলাদা একটি ইউনিট করা হয়েছে। তারপরও প্রায় প্রতিটা ওয়ার্ডে নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে।
এ বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সবার আগে করণীয় হলো সময় মতো টিকা দেওয়া। পরবর্তীতে বাচ্চার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে স্তন্যপান করানো অপরিহার্য। সেই সঙ্গে ঘরের পরিবেশ শুষ্ক, উষ্ণ গরম রাখা এবং ঘরে ভালো বায়ু চলাচল থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি সর্দি, ফ্লু বা অন্য সংক্রমণ রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা বলেন, অপর্যাপ্ত সেবা, অপুষ্টি এবং বায়ুদূষণের কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্তের অধিকাংশই শিশু। ভ্যাকসিনের চাহিদা বাড়ছে। দেশে বর্তমানে নিউমোনিয়া প্রতিরোধে ব্যবহৃত ভ্যাকসিন নিউমোভ্যাক্স ২৩-এর চাহিদার তুলনায় জোগান অনেক সীমিত।
তিনি বলেন, সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড ভ্যাকসিন তৈরি করে। কয়েক বছর এ ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ রেখেছে তারা। তবে বিভিন্নভাবে দেশে ফাইজারের তৈরি নিউমোনিয়া প্রতিষেধক আরেকটি ভ্যাকসিন বাজারে আসছে। তবে কয়েক বছরে প্রায় পাঁচ গুণ বেড়েছে দাম। ২০১৯ সালে এর দাম ছিল এক হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে পাঁচ হাজার ৫৭০ টাকা গুণতে হচ্ছে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা জরুরি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন পরিচালক (মা, নবজাতক শিশু ও কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য) মো. শামসুল হক বলেন, শীত যেহেতু আসছে, নিউমোনিয়া রোগী কিছুটা বাড়বেই। তবে নিউমোনিয়ায় সবচেয়ে ভয়ের কারণ হলো অক্সিজেনের ঘাটতি। যত শিশুর মৃত্যু হয় অধিকাংশেরই অক্সিজেনের কারণে হয়।
তিনি বলেন, সরকার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে। দেশের ৪৪টি জেলায় নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিট (স্ক্যানু) চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি জেলাগুলোতেও এ সেবা চালু করা হবে।
শামসুল হক বলেন, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা খুবই জরুরি। শিশুদের মায়ের দুধ খাওয়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঠাণ্ডা থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। সেইসঙ্গে পুষ্টিকর খাদ্যে গুরুত্ব দিতে হবে। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।