প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
ইতিহাস সত্যের বাহক। ইতিহাস মহাকালের প্রকৃষ্ট সাক্ষী। ইতিহাস অনাগত ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক। ইতিহাস কখনো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় না। অতীত ইতিহাস বর্তমানের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করে ভবিতব্য সৃষ্টি করে।
১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন পলাশীর আম্র কাননের এক পাশে বাংলার স্বাধীনতা সূর্যকে জোরপূর্বক অস্তাচলে নিয়ে গিয়েছিল একদল বিপথগামী নরপশু। আম্র কাননের ঠিক বিপরীত পাশে প্রাকৃতিক নিয়মে এমন একটি বীজ উপ্ত হয়েছিল, যা ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ অঙ্কুরোদ্গমিত হয়েছিল। যা আজ বিশাল মহীরূহ রূপে মহীতে অনুপম রূপে শীর্ষে অবস্থান করছে।
ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি অবশ্যই ঘটাবে। এটা তার জন্মগত রীতি। ইতিহাস নিয়তির অধীন। নিয়তি আবার কর্মের অধীন। পলাশির যুদ্ধের যত ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র হয়েছিল সবক'টিই লর্ড ক্লাইভকেন্দ্রিক। নবাব পরিবারের ভিতরে বাহিরে অনেক কূট ষড়যন্ত্র পলাশীর যুদ্ধের করুণ পরিণতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। ফলস্বরূপ দুই শত বছরের জন্য বাংলার বুকে পরাধীনতার জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল।
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবদ্দি খাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি একমাত্র দৌহিত্র সিরাজউদৌল্লাহ বাংলার স্বাধীন নবাব হিসাবে পদায়িত হন। প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ এই পদায়ন স্বাভাবিক ভাবে বরদাস্ত করতে না পারায় পরস্পরের মধ্যে বিরোধ চির বৈরিতায় রূপ নেয়।
‘মীর জাফর' এই নামটি বাংলার মানুষের কাছে এখন একটি গালি, বেঈমানের প্রতিশব্দ। কোনো বাঙালিই তার সন্তানের নাম এটা রাখে না। সে ইরানী বংশোদ্ভূত ছিল। বিহারের নায়েব আলীবর্দী খাঁর অধীনে তার চাকুরি শুরু হয়। ইরানী ভাষায় মীর জাফর খুব সুন্দর গান গাইতে পারতো।
মীর জাফরের আশা ছিল আলীবর্দী খানের পর সে-ই হবে নবাব। কিশোর সিরাজউদ্দৌলার কাছে নিজের নবাব হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হওয়ার পর সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্ণধার লর্ড ক্লাইভের সাথে নবাবকে সিংহাসন চ্যুত করার এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ক্ষমতার মোহান্ধে মূঢ় সেই মীর জাফর জানে না ইতিহাস যথারীতি তার পুনরাবৃত্তি ঘটাবেই। ভারত সম্রাট আকবর মাত্র তের বছর বয়সে বৈরাম খাঁর দক্ষ অভিভাবকত্বে মহামতি ভারত সম্রাট হয়েছিলেন। মীর জাফর তার নীচতা সহ নীচ ষড়যন্ত্রে যাদেরকে সক্রিয় শরিক করেছিলেন তারা হলো (১) ইয়ার লতিফ (২) জগতশেঠ (৩) রায় দুর্লভ (৪) উঁমি চাঁদ প্রমুখ। পলাশির প্রান্তরে যুদ্ধ চলাকালীন এদের অধীনস্থ সেনাবাহিনী গুলো ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। বরং দূরে দাঁড়িয়ে অবলোকন করছিল নবাব বাহিনীর করুণ পরাজয় দৃশ্য।
এই করুণ নাটকীয় দৃশ্যগুলোর প্রোম্পটার ছিল ঐ পাঁচ মানবীয় অবয়বের বাতাবরণে পৃথিবীর ঘৃণ্য, কুৎসিত এবং নকৃষ্টতম বেঈমান গুলো। অর্ধ দিবস তুমুল সম্মুখ সমরের পর রণে ভঙ্গ দিয়ে নবাবকে সন্ধি প্রস্তাবে অযথা কাল ক্ষেপণ করে পেছন থেকে তীব্র আক্রমণে নবাব বাহিনীকে পরাভূত করেছিল এবং সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে।
যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ইংরেজ পরিকল্পনা সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করে। এটা ছিল বাংলার অভ্যন্তরীণ সমস্যা, যা অবশ্যম্ভাবীভাবে ইংরেজদের জড়ায়। এবং বাংলায় ইংরেজ বিজয় ছিল প্রায় সম্পূর্ণ আকস্মিক। ইংরেজরা তাদের ষড়যন্ত্রের জোরে ও সিরাজউদ্দৌলার সভাসদদের বিশ্বাসঘাতকতার দরুণ পলাশীতে বিজয়ী হন। নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক, সামরিক নয়।
নবাব বাহিনীর ৬৫ হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র মোহন লাল এবং মীর মদনের অধীনস্থ দুই প্লাটুন সৈন্যই মরণ-পণ যুদ্ধ করেছিল পলাশির প্রান্তরে মাত্র তিন হাজার ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে।
মীর জাফরদের বেঈমানির পরিণতির যে উদাহরণ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে, মোহন লাল এবং মীর মদনের আনুগত্যের নিষ্কলুষ স্বীকৃতিও প্রশংসার যোগ্য। এই স্বীকৃতি শুধুই ইতিহাসসিদ্ধ।
যুদ্ধের পর বাংলার মসনদের ভাগ্য বিধাতা হয়ে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। প্রথমেই বসানো হলো বেঈমান মীর জাফরকে বাংলার পবিত্র মসনদে। কিন্তু ইংরেজদের দেয়া পূর্বশর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়ে মসনদ ছেড়ে দিতে হলো। বসানো হলো তদীয় জামাতা মীর কাশেমকে। ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকারে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে বকসারের যুদ্ধে মীর কাশেমকে হত্যা করা হয়। পলাশীর যুদ্ধের বেঈমানরা সকলেই একে একে বিশ্বাসঘাতকের প্রতীক হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
ক্লাইভ দেশে ফিরে গিয়ে হয়তো অনুশোচনার আত্মোপলব্ধিতে বাথরুমে ঢুকে নিজের গলায় নিজে ক্ষুর চালিয়ে আত্মাহত্যা করে।
মীরনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রাঘাতে।
ঘসেটি বেগমকে বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবিতে মারা হয়েছে।
মহারাজ নন্দ কুমারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়।
মীর জাফর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
জগতশেঠকে মুঙ্গের দুর্গের চূড়া থেকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়।
রায় দুর্লভ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়ে মারা যায়।
উঁমি চাঁদ ক্লাইভ কর্তৃক প্রতারিত হয়ে উন্মাদ অবস্থায় মারা যায়।
রাজা রায় বল্লভ পদ্মার পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।
ইয়ার লতিফকে গোপনে কে বা কারা হত্যা করেছে জানা যায় নি।
মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদৌল্লাকে নিজ হাতে হত্যা করে নিজে কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
দানিশ শাহ্ নবাব সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে বিষাক্ত সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়।
মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের বসবাসের বাড়িটি পথচারী মানুষ এখনো নিমক হারামের দেউড়ী নামেই চিনে।
ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতোটা অন্ধ করে দেয়, বেঈমান বানিয়ে দেয় তার উদাহরণ মীর জাফর, যে বিশ্বাস ঘাতকের প্রতীক হয়ে ছিল ও আছে এবং মূর্ত হয়ে থাকবে।
লেখক : বিমল কান্তি দাশ, কবি-প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।