প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
মতলব দক্ষিণ উপজেলার নায়েরগাঁও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেহরন দালাল বাড়ি সবার কাছে পরিচিত। পুরো বাড়িটি নিয়ে একটি গ্রাম। ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। গ্রামটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২ কিলোমিটার ও প্রস্থ আধা কিলোমিটার। এ গ্রামে প্রায় ৭ হাজার লোকের বসবাস। ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার। সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী। বাসিন্দারা পেশায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ী। বিয়ে-শাদি বেশির ভাগই হয় নিজেদের মধ্যে। এ বাড়িতে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। এ বাড়িটি বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় বাড়ি বলে বাসিন্দারা মনে করেন।
মেহেরন দালাল বাড়ির নামকরণ কীভাবে হয়েছে তা জানে না সেখানকার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দারা। তবে জগন্নাথ মন্দিরের পূজারী বয়োবৃদ্ধ সচিন্দ্র চক্রবর্তী জানান, মেহেরন মূলত মহারণ ছিলো। মহা অর্থ বড় আর রণ অর্থ যুদ্ধ। অর্থাৎ বড় যুদ্ধ। কোনো এক সময়ে এখানে জাগতিক বড় যুদ্ধ হয়। তখন এর নাম হয় মহারণ। পরে আস্তে আস্তে লোকজন মহারণকে মেহেরন নামে ডাকতে শুরু করে। এখানে জমিদাররা বসবাস করতেন। এ এলাকায় কেউ জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটতো না।
নামকরণ সম্পর্কে জমিদারদের বংশধর সমীর দাস বলেন, দেড়শ’ বছর আগে কালাচাঁন দাস, গিরিশ চন্দ্র দাস ও তার আত্মীয়-স্বজন পশ্চিমবঙ্গ থেকে এখানে আসেন। এখানে তারা দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। এখন তাদের কেউ নেই। কেউ ভারতে চলে গেছেন, আবার কেউ অন্যত্র চলে গেছেন। এ বাড়িতে জেলেরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। জমিদারদের বৃটিশরা উপাধি দেয় দালাল বলে। এজন্যে এ বাড়ির নাম মেহরন দালাল বাড়ি। জমিদারদের দোতলা দুটি ভবন এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এ বাড়িতে রয়েছে প্রায় ১শ’ ১টি নলকূপ, ৮টি মন্দির, কাপড়ের দোকান, স্বর্ণের দোকান, কয়েকটি সেলুন, ফার্নিচারের দোকান, কয়েকটি মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের দোকান। দোকানগুলো তাদের ঘরেরই একটি অংশ।
নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে অবহেলিত এ গ্রাম অবস্থিত। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্যে পূর্বে নৌকা ছিলো একমাত্র বাহন। এখন নায়েরগাঁও বাজার থেকে পায়ে হেঁটে, রিকশা কিংবা অটোবাইকেও যাওয়া যায়। বাড়িতে প্রবেশের জন্যে পূর্ব ও উত্তর দিক দিয়ে দুটি মাটির রাস্তা রয়েছে।
মেহরন দালাল বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের রয়েছে চরম অভাব। এ গ্রামে রয়েছে ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রায় ৮শ’ শিশুর চারভাগের একভাগও স্কুলে যায় না। ছেলে-মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে কয়েক মাইল হেঁটে যেতে হয় নারায়ণপুর পপুলার উচ্চ বিদ্যালয়ে।
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নরেন্দ্র দাস জানান, বাড়ির ঘরগুলো গিজ গিজ করে। উঠোন, বারান্দা কিংবা বাগানবাড়ি বলতে কিছু নেই। কোথাও এক ঘরের মূল দরজার সামনেই আরেক ঘরের বেড়া। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, সূর্যের দিকে না তাকালে দিক নির্ণয় করা বড় মুশকিল। অধিকাংশ ঘর টিনের। রাস্তাগুলো সরু। বৃষ্টি হলে দুর্ভোগের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তবে বাড়ির সরু রাস্তাগুলো সরকারি অনুদানে পাকা হয়েছে। বাড়ির ভেতরে নতুন কেউ ঢুকলে আরেকজন পথ দেখিয়ে দেয়া ছাড়া তিনি বের হতে পারবেন না।
এ বাড়ির বাসিন্দা জয় গোপাল দাস জানান, অধিবাসীদের অধিকাংশেরই পেশা মাছ ধরা। বাড়িতে একটি পরিবার শুধু শীল বংশের। বাকিরা দাস বংশের। বিয়ে-শাদি বেশির ভাগই হয় নিজেদের মধ্যে। বিনোদনের জন্যে রয়েছে টেলিভিশন ও ডিস সংযোগ।
সাবেক ইউপি মেম্বার উত্তম দাস জানান, এ বাড়ির অধিবাসীদের সচ্ছলতা ও শিক্ষাদীক্ষা না থাকলেও নির্বাচনে কদর থাকে। তাদের ভোট ছাড়া কারও পক্ষে চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব হয় না। নিজেদের ভোটে বাড়ি থেকে মেম্বার পাস করিয়ে নেয় তারা। ভোটের সময় সবাই তাদের কাছে ধর্ণা দেয়। ভোট চলে গেলে কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। এ বাড়ির লোকদের বেশির ভাগ সমস্যায় পড়তে হয় গর্ভবতী নারী রোগীদের চিকিৎসার জন্যে। কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নেই এ বাড়িতে।
বীরেন্দ্র মাস্টার, অতীন্দ্র সাদু ও স্বর্ণ কুমার দাস তাদের বাড়ির বসবাসকারী ছেলে-মেয়েদের জন্যে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবার জন্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ও একমাত্র সড়কটি পাকাকরণের জন্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাহলেই অবহেলিত ও বিরল এ বাড়ির মানুষ নাগরিক সকল সুবিধার আওতায় আসবে।