প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে- দেবী চণ্ডিকা বা দুর্গার পূজার মতো অন্য কোনও পূন্যকর্ম নেই। দক্ষিণাদানযুক্ত বৈদিক যাগযজ্ঞে যে পুণ্যফল লাভ হয়, তা দুর্গাপূজার ফলের লক্ষ ভাগেরও সমান নয়। কালিকাপুরাণে দেখি- শরৎকাল ভগবতীর দশভুজা দেবীমূর্তিতে আবির্ভাব কাল। মহিষাসুর বধের জন্যে ভগবতী শরৎকালে হিমালয়ে কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে দশভুজা-দুর্গারূপে আবির্ভুত হয়েছিলেন। এদিকে মহিষাসুর তিনকল্পে তিনবার জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমকল্পে ভগবতী অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডারূপে, দুর্গারূপে মহিষাসুরকে নিহত করেন। কাত্যায়ন আশ্রমে দেবতাগণের মিলিত তেজ থেকে দশভূজা মূর্তির আবির্ভাব হয়েছিলো। দেবতাদের এই মিলিত তেজকে কাত্যায়ন নিজের দূর্ধর্ষ তেজের দ্বারা উদ্দীপিত ও পূজা করেছিলেন এবং দেবী কাত্যায়নের কন্যাত্ব স্বীকার করেছিলেন। এই কারণে দেবীর এক নাম কাত্যায়নী। এখনকার দিকে প্রতিমা নির্মাণের ব্যাপারে যথেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপস্থিত। সন্দেশ-ঝিনুক-কাঁচণ্ডদিয়াশলাই কাঠি প্রভৃতির দ্বারা নির্মিত প্রতিমায় শিল্পনৈপুণ্য আছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো শাস্ত্রীয় উপরকণ নয়। বহুকাল আগে উত্তরপ্রদেশের অঞ্চলবিশেষে মহিষমর্দিনীর পাষাণমূর্তি নির্মাণ ও তার পূজার কথা জানা যায়। দেবীপুরাণে মৃত্তিকা, গাছ, পাষাণ, রত্ম বা যে কোনো বিশুদ্ধ ধাতুর প্রতিমা নির্মাণের নির্দেশ আছে (৩২/১৮। তবে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির পূজার বিধান দিয়েছেন। উক্ত পুরাণে দেবী স্বয়ং বলেছেন, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে সপ্তমী থেকে তিনদিন প্রতিটি মানুষের উচিত আমার মূর্তির পূজা করা। মাটি দিয়ে আমার প্রতিমা তৈরি করে পূজা করলে পূজকের পত্র, আয়ু ও ধনবৃদ্ধি হয়। মার্ক-েয়পুুরাণে উল্লেখ আছে, মহারাজ সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নদী-তীর দুর্গা দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে ফুল, ধূপ, হোম, তর্পণ প্রভৃতির দ্বারা পূজা করেছিলেন। পণ্ডিতদের মতে, এটিই সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা। দেবীপুরাণে সোনা, রূপা, ধাতু, মাটি ও কাঠের তৈরি প্রতিমার প্রশংসা করা হলেও এগুলোর মধ্যে মাটিই সহজলভ্য পবিত্রতম জিনিস, আর মাটির সাথে মানুষের প্রাণের যোগও বর্তমান। তাই দেবীপুরাণে বলা হয়েছে, নিজের বিত্তানুসারে মৃন্ময়ী প্রতিমাতে, অথবা প্রতিমা নির্মাণ সম্ভবপর না হলে বিল্বশাখাতে দেবীর পূজা করলে মৌলিক ফল লাভ হয়। কালিকাপুরাণের মতে, ষষ্ঠীর দিন বিল্বশাখা ও ফলের দ্বারা দেবীর পূজা করে সপ্তমীর দিন সেই বিল্বশাখা আহরণ করে আবার দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমার পূজা করতে হবে। দেবীর নিত্যাবাসস্থান কৈলাস পর্বত; তিনি মহিষাসুর বধের জন্য দশভুজারূপে হিমালয়ে এবং দেবীপুরাণের বর্ণানুসারে ঘোরাসুর বধের জন্য ওই দশভুজারূপেই বিন্ধ্যাচলে আবির্ভূত হন। বিন্ধ্যাচলে এবং হিমালয় থেকে দেবীকে আবাহন করা হয়। দেবীর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, “যে মূর্তিতে তুমি কৈলাসে অবস্থান র, এবং যে মূর্তিতে তুমি বিন্ধ্যাচলে ও হিমালয়ে আবির্ভূত হয়েছিল, সেই দশভুজা রূপে এই মৃন্মায়ী মূর্তিতে আবির্ভুত হও।” চিত্রাঙ্কিত প্রতিমায়, খণ্ডে কিম্বা শূলেও দেবীর পূজার বিধান আছে। বাঙালায় মৃন্ময়ী দেবীমূর্তির আকর্ষণ আমাদের কাছে অনেক বেশী। বাঙালীর কাছে মাটি একটি পবিত্র জিনিস এবং দেবতুল্য। তাই মাটির প্রতিমা চিন্ময়ীরূপে প্রতিভাত হন। মাটি, ধাতু, শিলা, ঘট, জল অস্ত্র প্রভৃতিতে সকল আধারে দুর্গাপূজা করা যেতে পারে। কিন্তু মোটামুটি সকল পুরাণরচয়িতা ও নিবন্ধকার মৃন্ময়ী মূর্তিকেই বিশেষ প্রশস্ত বলেছেন। তিনি মনোরম ত্রিভঙ্গিগতে অবস্থান করে মহিষাসুরকে মর্দন করছেন; তিনি পদ্মের মতো কোমল অথচ আয়ত দশবাহুযুক্ত ; ঐ দশ বাহুর মধ্যে ডান দিকের পাঁচ বাহুতে উপর থেকে নীচে যথাক্রমে যে অস্ত্রগুলি আছে সেগুলি হলো- ত্রিশূল, খড়ুগ, চক্র, তীক্ষèবান ও শক্তিনামক অস্ত্র; বাম দিকের পাঁচ বাহুতে নীচ থেকে উপরের দিকে যথাক্রমে আছে খেটক (গোলাকার চামড়া বা ঢাল), জ্যাযুক্ত ধনু, নাগপাশ, অঙ্কুশ এবং সব থেকে উঁচু হাতটিতে ঘণ্টা বা পরশু। দেবীর পদপ্রান্তে ছিন্নমস্ত মহিষ দেখতে পাওয়া যায়। ঐ মহিষের শিরচ্ছেদ হওয়াতে ছিন্ন স্থানটি থেকে একটি অসুর উৎপন্ন হয়েছে; তার হাতে খড়ুগ: তার বক্ষঃস্থল দেবীর হস্তস্থিত শূলের দ্বারা বিদ্ধ; অসুরের শরীর মহিষের নাড়ি-ভূঁড়ির দ্বারা লিপ্ত এবং মহিষের রক্তে রক্তবর্ণ; তার চোখদুটিও রক্তবর্ণ ও বিস্ফোরিত; দেবীর হাতে ধরা নাগপাশ অসুরের কটিদেশ বেষ্টন করে আছে; অসুরের মুখ ভ্রুকুটির ফলে কুটিল; দেবী পাশযুক্ত বাম হাতের দ্বারা অসুরের চুলের মুঠি ধরে আছেন এবং অসুরের মুখ দিয়ে রক্ত ভ্রমন হচ্ছে। দেবীর পদতলে অসুরের দিকে ধাবমান সিংহের অবস্থান। সিংহের ছিঠের উপর দেবীর ডান পা বিন্যস্ত; সিংহপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উঁচুতে মহিষের উপর দেবীর বাম পায়ের অঙ্গষ্ঠমাত্র অবস্থিত। চারদিকে দেবগণ এবং উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী, চামু-া এবং চা-িকা - এই আটটি শক্তি দেবীমূর্তিতে পরিবেষ্টন করে আছে। (কারিকাপুরাণে ৫৯.১১-১২)। দেবীর এই ধ্যানমন্ত্র বা অঙ্গমন্ত্র দুর্গাতন্ত্র নামেও প্রসিদ্ধ। এই ধ্যানমন্ত্রটি মৎস্যপুরাণে এবং কালীবিলাস তন্ত্রেও পাওয়া যায়। দেবীর এই রূপবর্ণনা বাঙলার মৃৎশিল্পীরা মোটামোটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর মৃন্ময়ী প্রতিমায় ফুটিয়ে তোলেন। আমরাও প্রধানতঃ এই রূপটির সাথে পরিচিত। এই রূপের সাথে বাঙালী মানস এতই পরিচিত যে, দেবীর এই মূর্তিকল্পনার ব্যতিক্রম হলে আমরা অন্তরে অহত হই। দুর্গাপূজা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানষের উৎসব। বাংলাদেশের দুর্গাপূজায় যে পুরাণের প্রভাব সব থেকে বেশী সেই কালিকাপুরাণে বলা হয়েছে- দুর্গাপূজার অধিকারী সকল শ্রেনীর মানুষ। এখানে জাতিধর্মবর্ণের কোনও বাছ-বিচার নেই। এই পূজা সকল প্রকার মানুষের একটি সংঙ্ঘবদ্ধ উৎসবরূপে পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। মার্ক-েয়পুরাণে (৮৯.১১-১২) দেবী নিজেই বলেছেন- যদি যে কোনও মানুষ আমার মহাত্ম্যকথা শুনে প্রতি বৎসর শরৎকালে আমার উদ্দেশ্য ভক্তিভরে এই মহপূজা করে, তাহলে সে আমার অনগ্রহ সকল বাধা অতিক্রম করে ধনধান্যে পরিপূর্ণ হবে। ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, স্লেচ্ছ, দস্যু, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গবাডিসগণ, কিন্নর, বর্বর ও কিন্নরজাতীয়েরা গ্রামে, শহরে, বনে এবং প্রতিটি গৃহে ভক্তিযুক্ত হয়ে দেবীর পূজা করতে পারে। এই পূজার অন্যতম শর্ত হল- আড়ম্বর থাক বা না থাক, ভক্তিপরায়ণ হয়ে এই পূজা করতে হবে। দুর্গাপূজা যে আজ জাতীয় উৎসবরূপে প্রতিষ্ঠিত তার প্রধান কারণ- ‘এটি সকল মানুষের উৎসব। ভবিষ্যপুরাণ স্ত্রীলোকদেরও স্বতন্ত্রভাবে এই পূজা করার অধিকার দিয়েছে।