সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

মাতৃরূপে দেবী দুর্গা
অনলাইন ডেস্ক

মা মানেই পরম পবিত্র। মা মানেই পরম মমতাময়ী। দুর্গা যতটা না দেবী তার অধিক মা। দুর্গাকে দেবীরূপের চেয়ে মাতৃরূপে ফুটিয়ে তোলে অধিক তার চারধারের চরিত্রগুলো। ‘পূজা’ বিষয়টি অনেকেই সাদা চোখে দেখে নেতিবাচক মন্তব্যের ঝড় তোলেন। পূজা মূলত তা নয়। পূজা মানে হলো অনন্য শ্রদ্ধা যাতে পবিত্রতার শতভাগ পূর্ণ থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে ক্ষমতায়িত করে বিশ্বকল্যাণের মূলবিন্দুরূপে চিন্তা করা ও প্রতিষ্ঠা করাই হলো শারদীয়ার পূজায় মুখ্য বিষয়। কারও সমকক্ষ করে তোলার জন্যেই নারীরূপে শারদীয়ার আগমন নয়। শারদীয়ার আগমন সে কোন রক্ত ক্ষরণের জন্যও নয়। শারদীয়া সবাইকে অভয় দিয়ে 'মা'রূপেই আসেন। যিনি প্রকৃত মা তিনি সন্তানদের মধ্যে ভেদবুদ্ধি কখনো করেন না। আগেকার দিনে বাঙালি যৌথ পরিবারে কোন মা বড় এক থালায় খাবার নিয়ে নিজের সন্তানদের পাশাপাশি ছোট ছোট সন্তানতুল্য দেবরপুত্র ও ভাসুরপুত্রদের নিজের হাতে অন্ন তুলে দিয়ে লালন-পালন করেছেন। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে খুব চমৎকারভাবে এই সম্প্রীতির ছবিগুলো ফুটে উঠেছে। সেইসব মায়েরা

একাধারে দেবী ও স্নেহশীলা মমতাময়ী । মায়ের কাছে তাঁর সন্তানের বর্ণ নেই। মার কাছে তাঁর সন্তানের জাতও নেই। মায়ের পায়ের নীচে সন্তানের স্বর্গ। মা তাই পরমারাধ্যা। দুর্গাও পরমারাধ্যা। দুর্গা যেমন দুর্গতি নাশেন তেমনি প্রতিটি মা-ও তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁর সন্তানের দুর্গতি নাশের চেষ্টা করেন। দুর্গা তাই কোন সম্প্রদায়ের মা নন। তিনি সকলের কাছেই মা, তিনি সকলের জন্যেই সন্তান বৎসল।

শরৎ বাংলার প্রকৃতিতে আনে সম্প্রীতির বন্ধন। শরতে গরম যেমন প্রকট তেমনি বৃষ্টিও প্রতাপমণ্ডিত। ভোরের ঘাসের গায়ে শিশিরের পরশ শীতের আমেজ যেমন আনে তেমনি মনে মনে বাসন্তী প্রশান্তির প্রবাহ বিরাজ করে। শরৎ ষড়ঋতুর একটা সম্প্রীতি তৈরির উপায় বলেই অনুমিত হয় প্রকৃতির কাছে।

শরৎ সম্প্রীতিকে নিছক নিসর্গের সৌন্দর্য দিয়েই ধারণ করে না। শরৎ সম্প্রীতিকে সংস্কার দিয়েও সমুন্নত রাখে। এখনও লোকায়ত বাঙালির ঘরে ঘরে নায়-নাতকুর নিয়ে বিবাহিতা মেয়ে বাপের বাড়িতে নায়র আসে শরৎকালে। বর্ষার বন্যার প্রকোপ এসময় থাকে না। থাকে না হেমন্তের নতুন ধানের চাপ। তাই শরতেই কন্যা আসে পিতৃগৃহে বাৎসরিক ভ্রমণানন্দে। মেয়েকে নতুন শাড়ির উপহার দিয়ে বাবা শ্বশুরবাড়ি পাঠান। এই সংস্কার আজও চর্চিত হয় শারদীয়ার আগমনকে কেন্দ্র করে।

শরৎ কেবল প্রকৃতিকে সংস্কার ও সম্প্রীতির সমাবেশে আপ্লুত করে না। মানুষকেও শরৎ সম্প্রীতির সম্মিলনে চমকিত করে। শরৎ তার ঋতুর বাহনে নিয়ে আসে শারদীয়াকে। শারদীয়া মানে কেবল ঢাকের বাদ্য আর বেলপাতার অঞ্জলি নয়। শারদীয়া মানেই সম্প্রীতির সমাবেশ। শারদীয়ার দশ হাতের সমাবেশ যেন দশদিকের আয়োজন। দশদিক হতে দশ রকমের লোকজন এসে সম্মিলন ঘটায় শারদীয়ার উৎসবে। নবকন্যার ঘরের মাটি না হলে গড়া যায় না প্রতিমা। আর এ নবকন্যার মধ্যে সম্মিলন হয়েছে রূপোপজীবীনি, ব্রাহ্মণী, শূদ্রানী, নাপতানী এঁদের। অর্থাৎ সকল বর্ণের মানুষের সম্প্রীতিকে সুনিশ্চিত করেই শারদীয়া আসেন বাঙালির মা হয়ে। এখানে কুমোর, কামার, ঢাকী, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র সকলেরই সমান অংশগ্রহণ জড়িয়ে আছে।

আবহমান কাল হতে বাঙালির পরিবারে যেমন ছেলেমেয়ের সমন্বয়ে পরিবার আদর্শ ও পূর্ণ হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি মা-ও কৈলাশ হতে দু'মেয়ে আর দু'ছেলের সমন্বয়ে বেড়াতে আসেন মর্ত্য।ে এ আগমনে শাশ্বত বাঙালি পরিবারের বন্ধনকে সম্প্রীতি বিনির্মাণে রূপায়িত করে তোলা হয়েছে। দুর্গার সাথে ত্রা পুত্র-কন্যারূপে যাঁরা আসেন তাদের কেউ সিদ্ধিদাতা, কেউ বরদাতা, কেউ ধনের দেবী আর কেউ বিদ্যামাতা। অর্থাৎ জীবনে সকল কিছুর সমন্বয় না হলে জীবন পরিপূর্ণ হয় না। জীবন হচ্ছে বিদ্যা ও ধন এবং সংগ্রাম ও সিদ্ধির সম্প্রীতি। মায়ের ললাটে তৃতীয় যে নয়ন আছে তাণ্ডও সম্প্রীতির সম্মেলনের বিষয়। কেননা, কেবল চর্ম চক্ষু দিয়ে জগৎ চলে না। দিব্যচক্ষু না থাকলে পার্থিব জগতে কেবল চর্মচক্ষু দিয়ে অপ্রমাদে জীবন চালানো যায় না। তাই দেবী দুর্গার মধ্যে পার্থিব জ্ঞান আর দিব্য জ্ঞানের সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বর্গ-মর্ত্যের সম্প্রীতি টানা হয়েছে।

কেবল যে পেশা, ধর্ম ও বর্ণের সম্প্রীতি নয়, শারদীয়া এলে বয়সেরও সম্প্রীতি হয়। তিনি নিজে তাঁর বিভিন্ন বয়সের লীলা নিয়ে জনমানসে তৈরি করেন এক স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্প্রীতি। ছোট্ট শিশুর তিনি যেমন মা তেমনি নবতিপর বৃদ্ধেরও তিনি মা। অর্থাৎ তিনি এলে সবার মনে আসে আনন্দদোলা। আবার তিনি যেমন দুষ্টের দমন করেন তেমনি দুষ্ট তার ভুল বুঝে ক্ষমা চািলেও তিনি ক্ষমা করে দেন। যে অসুর মানুষ ও দেবের ক্ষতি করেছে, সে অসুরকেই তিনি নিজ পায়ে ঠাঁই দিয়ে যজ্ঞভাগ দিয়েছেন। তিনি তাঁর সন্তানদের বলেননি, অসুরের প্রতিমাকে পাথরাঘাত করতে। তিনি তাঁর সন্তানদের শিখিয়েছেন ক্ষমা আর উদারতা। ফলে একদা অরি অসুরও মায়ের কৃপায় বরিত হয় পূজার বেদীতে। অসাম্প্রদায়িকতার এ এক অনন্য নিদর্শন।

বাঙালির সম্প্রীতি শুধু আজকের নয়। আবহমান কালের। এই কারণে এখানে এসেছেন চণ্ডীদাস, এখানে এসেছেন লালন। এখানে এসেছেন হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শারদীয়ার আগমন আমাদের সেই সম্প্রীতিকে নবায়ন করিয়ে দেয় মাত্র। যুগে যুগে অসুর বা অসুরের মতো লোকের অভাব ছিল না। তারা মানুষের সম্প্রীতিতে আঘাত করে গেছে। কিন্তু শারদীয়ার আগমন সে আঘাতকে তুচ্ছ করে মানুষের মনে ও আচরণে সম্প্রীতির সেতু বিনির্মাণ করে গেছে। বাঙালির সম্প্রীতির শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। এ শেকড় সহজে উপড়াবার নয়। কালে কালে ফরাসী, ইংরেজ, ওলন্দাজ, তুর্কী ও আরবীয়রা চেষ্টা করে গেছে বাঙালির বাঙালিয়ানাকে ধ্বংস করে দিতে। পশ্চিম পাকিস্তানীরাও চেয়েছিল বাঙালিকে ভাষাহীন করে, সম্প্রীতিহীন করে রক্তক্ষরণকারী এক জাতিতে পরিণত করতে। কিন্তু বাঙালির হাজার বছরের সম্প্রীতির টান সে অপপ্রয়াসে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালি শাশ্বত সুন্দরকে লালন করে বলেই শারদীয়ায় ধর্মকে নয় উৎসবকে বড় করে তোলে। এ উৎসব বাঙালির, এ উৎসব মর্ত্যবাসী অমর্ত্য প্রাণের।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়