প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
রাজধানীর ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিয়াতুন বাহা নোভা। করোনার আগে চতুর্থ শ্রেণিতে থাকা এই শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের গড় ছিল নব্বইয়ের ওপরে। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর বাসাতেই গাইড করেছেন বাবা-মা। পড়িয়েছেন সমাপনী পরীক্ষার জন্য। সে কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া পরীক্ষায় অন্য সব বিষয়ের মতো গণিতেও পেয়েছিলেন নব্বইয়ের বেশি নম্বর। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী পূর্ণ সিলেবাসে হওয়া ৬ষ্ঠ শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেছে গণিতে।
নোভার মা শারমিন আক্তার বলেন, করোনাকালীন নোভার মধ্যে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস আসক্তি জন্মাতে দেইনি। সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকলেও পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার জন্য বাসায় নিজে পড়িয়েছি। পরবর্তী সময়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা হলে সে প্রতিটি বিষয়ে নব্বইয়ের বেশি নম্বর পায়। গণিতে পায় ৯৪ নম্বর। কিন্তু ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
তিনি বলেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পূর্ণ সিলেবাসে ক্লাস শুরু হওয়ার পর ফের করোনার ধাক্কায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ক্লাস চালু হলে রমজান সহ দুই ঈদের ছুটি। এতগুলো ব্রেকের পর মানসিকভাবে পরীক্ষায় মন বসাতে পারেনি সে। যে কারণে গণিতে ফেল করে বসে।
একই স্কুলের ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ হোসেন। এই শিক্ষার্থী ৭ম শ্রেণিতে থাকতে শুরু হয় করোনা। তখন অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে পাস করে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠে। এই শ্রেণিতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বার্ষিক পরীক্ষা ও অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয় সে। কিন্তু নবম শ্রেণিতে পুরোদমে ক্লাস শুরু হলে তার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। মাথা ব্যথা, পায়ে ব্যথা, পড়া প্রস্তুত হয়নি বিভিন্ন অজুহাতে ক্লাস ফাঁকি দিতে থাকে সে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৯ম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় এই শিক্ষার্থী ফেল করেছে ৫ বিষয়ে।
আলিফের বড় বোন নিশাত জাহান বলেন, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে অনলাইনে ক্লাস করতে হয়েছে তাকে। এই সময় সে অনলাইনে ক্লাস করলেও পড়ায় মনোযোগী ছিল না। দেখা যেতো, ক্লাসে যোগ দিয়ে সে অন্য কাজ করছে। সে কারণে তার মধ্যে শিখন ঘাটতি দেখা দেয়। আবার অনলাইনে ক্লাস করায় সে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে। স্কুল বন্ধ থাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় টিভি দেখতে দেখতে এই কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় স্কুল খুললেও পড়াশোনায় আগ্রহ দেখা যায়নি আলিফের। ৭ম ও ৮ম শ্রেণির শিখন ঘাটতি তো আছেই, তার ওপর নবম শ্রেণিতে বেশি বই বেশি পড়া; চাপটা সে নিতে পারছে না। এর পাশাপাশি করোনাকালীন অভ্যাস টিভি দেখা ও মোবাইল চালানোতে বেশি সময় ব্যয় করছে। আবার আজ হাতে ব্যথা তো কাল ঘাড়ে ব্যথা, বিভিন্ন অজুহাতে স্কুল ফাঁকি দেয়। তার মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটেছে। পড়তে বললে সে এখন খারাপ আচরণ করে।
কেন খারাপ করছে শিক্ষার্থীরা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় এবং অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিভাইস আসক্তি তৈরি হয়েছে। এই আসক্তি থেকে বের হতে পারছে না অনেক শিক্ষার্থী। যে কারণে তাদের মধ্যে পড়ার আগ্রহ কমেছে। নানান অজুহাতে স্কুলে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। এর বাইরে বারবার করোনার ধাক্কা, ঈদের ছুটির কারণে পড়ায় মনোযোগী হতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। অনেক প্রতিষ্ঠান সিলেবাস শেষ করার আগেই ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়েছে। এসব কারণে চলতি বছরের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থীই অকৃতকার্য হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে সব বিষয়ে পাস করে আসা শিক্ষার্থীরাও ফেল করেছে এই পরীক্ষায়। সবচেয়ে বেশি সমস্যা রয়ে গেছে গণিতে। শুধু রাজধানী নয়, গ্রামাঞ্চলেও একই অবস্থা।
মোবাইল শিক্ষার্থীদের নষ্ট হওয়ার বড় কারণ। করোনার সময় তারা অনলাইনে ক্লাস ঠিকমতো না করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় দিয়েছে বেশি। অটোপাস বা সিলেবাস কমিয়ে দেবে এই আশায় সে পড়াশোনা করে না। স্কুলে যেতে চায় না, গেলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে চলে আসে।
শিক্ষার্থীর বাবা
ডিভাইস আসক্তিতে স্কুল ফাঁকি দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা
করোনার কারণে চার দেয়ালের ঘরে শিক্ষার্থীদের কাছে সহজলভ্য ছিল মোবাইল ফোন। অনলাইন ক্লাসের কারণে তাদের হাতে ফোন তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন অভিভাবকরা। এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও মোবাইল আসক্তি জেঁকে বসেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের স্কুল শাখায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদ আহমেদ। করোনার আগে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী থাকাকালীন সব বিষয়ে পাস ছিল তার। কিন্তু করোনার সময় অষ্টম শ্রেণিতে পান অটোপাস। শিখন ঘাটতি চরমভাবে দেখা দেয় তার মধ্যে।
করোনার সময়ে অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় ডিজিটাল ডিভাইসেও আসক্ত হয়ে পড়ে এই শিক্ষার্থী। যে কারণে স্বশরীরে পুরোদমে ক্লাস শুরু হওয়ার পর আগের মতো ক্লাসে আগ্রহ পায় না সে। তার আজিমপুরের বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটারের মতো। কিন্তু এরপরও নানান অজুহাতে সে ক্লাসে যাওয়া থেকে দূরে থাকে। চলতি বছরের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় এক-দুটি নয়, গণিত সহ ৮টি বিষয়ে ফেল করেছে এই শিক্ষার্থী।
মাহমুদের বাবা মোস্তাক আহমেদ বলেন, অনলাইন ক্লাসের কারণে শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল তুলে দিতে হয়েছে। এই মোবাইল শিক্ষার্থীদের নষ্ট হওয়ার বড় কারণ। করোনার সময় তারা অনলাইনে ক্লাস ঠিকমতো না করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় দিয়েছে বেশি। অটোপাস বা সিলেবাস কমিয়ে দেবে এই আশায় সে পড়াশোনা করে না। স্কুলে যেতে চায় না, গেলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে চলে আসে।
তিনি বলেন, আমার ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে গোল্ডেন ‘এ প্লাস’ পাওয়া ছাত্র। ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতেও সব বিষয়ে পাস ছিল তার। অষ্টম শ্রেণিতে অটোপাসের পর থেকে সে এমন হয়ে গেছে।
বকাঝকা করলেই আত্মহত্যা করছে
করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সময় কেটেছে চার দেয়ালের মধ্যে। স্কুল খোলা থাকলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা হতো, করোনার সময় সেই সুযোগ ছিল না। স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরের মধ্যেও কাজ ছিল না। এই সময়ে অনেক শিক্ষার্থীরা মধ্যেই তাই ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি ভর করে। অনেকে আবার অলস সময় কাটাতে কাটাতে ডিপ্রেশনে চলে যায়। এর ফলে পড়াশোনার কথা তাদের ক্ষুদ্র মস্তিস্ক নিতে পারেনি। অনেকেই পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যতিক্রম। তীব্র মানসিক চাপে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও না পড়ার অভ্যাসের কারণে তারা বই থেকে দূরেই থেকেছে। করোনা পরবর্তী সময়েও পড়াশোনার কথা বলায় আত্মহত্যা করেছে অনেক শিক্ষার্থী।
গত ১১ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়ের বকা দেওয়ায় অভিমান করে ঐশী চন্দ্র ভৌমিক (১৬) নামে এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। সে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাইস্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
চলতি বছরের ৫ জুলাই আত্মহননের পথ বেছে নেয় শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী কানিজ ফাতেমা কাশমি। অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, পদার্থ ও জীব বিজ্ঞানের সৃজনশীল পরীক্ষায় ফেল করে সে। এমন ফলাফলে রাগান্বিত হয়ে বকাঝকা করেন তার মা। এই কারণে আত্মহত্যা করে কাশমি।
গত বছরের ৭ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষার ভয়ে আত্মহত্যা করে এক স্কুলছাত্র। সে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের কমলপুর জহির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী মনিরুজ্জামান রুপক।
এছাড়া করোনাকালীন সময়েও পড়তে বলায় অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অনেকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন। অনেক শিক্ষার্থী আত্মহননের চেষ্টা করেছেন।
করোনা ও ছুটির ধাক্কায় বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীরা
শিক্ষকরা বলছেন, করোনাকালীন দীর্ঘ দুই বছর স্কুল বন্ধ ছিল। এরপর স্কুল খুললেও স্বল্প পরিসরে ক্লাস হয়েছে। পুরোদমে ক্লাস শুরুর পরপর আবার করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেল। এরপর রমজান সহ দুই ঈদের ছুটি। সব মিলিয়ে করোনা ও ছুটির ধাক্কায় শিক্ষার্থীরা বিপর্যস্ত।
রাতারাতি শিখন ঘাটতি পূরণ হবে না। আমরা যদি ডিভাইস থেকে দূরে রেখে তাদের পড়াশোনার দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত করাতে পারি, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো ব্রেক ছাড়া ধারাবাহিকভাবে ক্লাস চালু রাখা যায়, তাহলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব
তারা বলছেন, করোনার মধ্যে দুটো শ্রেণি টপকে আসা শিক্ষার্থীরা তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। সব শিক্ষার্থীর মেধা সমান নয়। একবার বুঝালেই অনেক শিক্ষার্থী বুঝে যায়, কাউকে কয়েকবার বুঝালে বুঝে। কেউ আবার বারবার বুঝানোর পরও বুঝে না। সেজন্য তাদের মানসিক চাপে না রেখে ধীরে ধীরে পড়াশোনার রাস্তায় নিয়ে আসতে হবে।
ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক তপন কুমার বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকা, ক্লাস পুরোদমে শুরুর পর আবার ফেব্রুয়ারিতে ব্রেক। এরপর দুই ঈদের ছুটি। ঈদুল আজহার পর সরকার নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, ১০০ নম্বরের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। অথচ, অষ্টম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী করোনার কারণে পঞ্চম শ্রেণির পরে আর সেভাবে বই পড়তে পারেনি। তাদের মধ্যে বিশাল শিখন ঘাটতি রয়ে গেছে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষা নিতে হয়েছে, সে কারণে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব পড়েছে।
তিনি বলেন, রাতারাতি শিখন ঘাটতি পূরণ হবে না। আমরা যদি ডিভাইস থেকে দূরে রেখে তাদের পড়াশোনার দিকে ধীরে ধীরে ধাবিত করাতে পারি, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো ব্রেক ছাড়া ধারাবাহিকভাবে ক্লাস চালু রাখা যায়, তাহলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ সম্ভব। আমাদের প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে শিখন ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে। ক্লাসের নির্ধারিত সময়ে পড়া শেষ করতে না পারলে ছুটির পরে তাদের সেই পড়া আদায় করছি, কোনো ধরনের মানসিক চাপ প্রয়োগ না করেই।
শিক্ষার্থীদের ওপর করোনার প্রভাব স্পষ্ট
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে মূল কারণ করোনা।
ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঈদুর রহমান জেম বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর করোনার প্রভাব স্পষ্ট। তাদের মধ্যে ডিভাইস আসক্তিও চরম। এর ফলে তাদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা খারাপ হয়েছে।
রাজধানীর উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে শহুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা অনলাইনে ক্লাস নিয়েছে, তাদের তো শিখন ঘাটতি আছেই, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরও শিখন ঘাটতি রয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ঘাটতি থেকে যাওয়ায় গণিত, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় তারা বুঝতে পারছে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গেলেই দেখা যাবে, অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল কিন্তু ভালো হয়নি। এর মাধ্যমে তাদের ঘাটতির পরিমাণ বুঝা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, শিখতেই হবে এমন কিছু অধ্যায় দিয়ে আমরা সিলেবাস অর্ধেক করে দিলাম। এতে অনেক শিক্ষকই শিখন ঘাটতির কথা তুললেন। কথা হচ্ছে, সে যদি পাস করে, তাহলে তাকে পুশ করে সামনে এগিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা হলে সে ফেল করবে। এতে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। তাকে টেনে তোলা সহজ হবে না। এত কিছু করার পরও তারা ততটা ভালো করেনি। তাহলে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কী অবস্থা! কোভিডের কারণে পড়াশোনার গ্যাপ হয়েছে, সেই জায়গায় তাদের সামনে নিয়ে আসতে আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে।
মানসিক অবসাদের কারণে বেড়েছে স্কুল ভীতি
এদিকে মনোবিজ্ঞানী ও শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক অবসাদের কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ভীতি বেড়েছে। সে কারণে তাদের পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মন না বসার পেছনে একমাত্র কারণ কোভিড-১৯। দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে না যাওয়া, একটানা বাসায় থাকা, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় মানসিকভাবেই তারা অনেকটা অবসাদগ্রস্ত ছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষকদের উদ্যোগী হতে হবে। স্কুলগুলোতে নিজস্ব সাইকোলোজিস্ট বা অন্য কাউকে দিয়ে শিক্ষার্থীদের পার্ট টাইম বা ফুল টাইম কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও কাউন্সেলিং করাতে হবে। এজন্য সরকার ও স্কুল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
শিশু বিশেষজ্ঞ ঢাকা শিশু হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, দীর্ঘদিন ক্লাসের বাইরে থেকে হঠাৎ করেই আনুষ্ঠানিক ক্লাস শুরু, এরপর পরীক্ষা, এতে শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ পড়েছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী অন্য সবার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। ডিপ্রেশনের কারণে অনেকেই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে, সুইসাইডের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তও নিচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনার সময়ে সকালবেলা ঘুমিয়ে কাটাতো শিক্ষার্থীরা। এখন স্কুলে যাওয়ার জন্য তাদের খুব সকালে উঠতে হচ্ছে। যে ছেলে বা মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে, হঠাৎ করেই ৯-১০টা বই পড়ায় সে চাপ অনুভব করছে। ডিভাইস আসক্তি কমানোও চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। সপ্তাহে এক/দুই দিন যাওয়ার পর তারা আর স্কুলে যেতে চাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুল ভীতি বাড়ছে। এই অবস্থার উত্তরণে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করতে হবে। তবে, পড়াশোনার জন্য বেশি চাপ দেওয়া যাবে না।
প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল, চাপ ছিল, সেজন্যই পরীক্ষায় অকৃতকার্য
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়ার পেছনে মানসিক চাপ মস্ত বড় একটা কারণ। তবে, এটাই একমাত্র কারণ নয়। এখানে তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কোভিডের কারণে একটা বিচ্ছিন্নতা চলে এসেছে। স্কুল হয়তো শেখার জায়গা, তবে পরীক্ষা দিতে গিয়ে তাদের পাস করতেই হবে, এ ধরনের একটা চাপও তাদের ছিল। দ্বিতীয়ত, যারা টিউটরের কাছে পড়তো, তারা কোভিডের সময় সেই সুযোগটা পায়নি। সেজন্য তাদের প্রস্তুতির ঘাটতি ছিল। তৃতীয়ত, তারা ক্লাসে যাওয়া শুরু করলেও প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়নি।
তিনি বলেন, শিক্ষার ওপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব এখনও না পড়লেও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেলে অনেক পরিবারের হয়তো স্বাচ্ছন্দ থাকবে না, দুশ্চিন্তা থাকবে। সেটাও ছেলে-মেয়েদের স্পর্শ করবে। স্কুল পুরোদমে চললে পরের ক্লাসে তারা অবশ্যই ভালো করবে। কারণ, শিক্ষার্থীরাও তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো জানে। শতভাগ ঘাটতি পূরণ হয়তো সম্ভব না। তবে ছেলে-মেয়েদের ওপর আস্থা থাকা উচিত। তারা চাইলেই পারবে। ক্লাসে তারা নিয়মিত হলে এই সমস্যা থাকার কথা নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা শুধু শিক্ষা নয়, সব ক্ষেত্রেই দায় এড়াতে চাই। কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, করোনার কারণে শিখন ঘাটতি হয়েছে এটাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এটা বিশাল আকারে হয়েছে। সবার আগে এটা স্বীকার করে নিতে হবে।
তিনি বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের এক থেকে দেড় বছরের একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। যে কারণে চতুর্থ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী শিখন ঘাটতি নিয়েই ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছে। এই শ্রেণিতে এসে সে আর তাল মেলাতে পারছে না। কারণ, চতুর্থ শ্রেণির সিঁড়ি আর ৬ষ্ঠ শ্রেণির সিঁড়ি সমান হবে না। যে শিক্ষার্থী যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে পারে না, সে সরল অংক কীভাবে করবে? ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, ঘাটতি পূরণে পর্যাপ্ত গবেষণা করা দরকার ছিল। সেটি প্রথমত প্রতিটি বিদ্যালয়ভিত্তিক এবং দ্বিতীয়ত জাতীয়ভাবে। বিদ্যালয়গুলোতে তাদের গ্যাপ চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু কেউ হয়তো নিজ উদ্যোগে করেছে, সেটা দৃশ্যমান নয়। উচিত ছিল সপ্তাহে একদিন বা প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে ক্লাসে কার কোন জায়গায় ঘাটতি আছে, তা চিহ্নিত করে একটা ক্যালেন্ডার করা গেলে বিষয় ধরে পুরোনো ঘাটতিগুলো পূরণ করা যেতো।
তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে দৃশ্যমান কিছুই দেখা যায়নি। আমাদের ঘাটতি পূরণ এবং বর্তমান ক্লাসের পড়া দুটোই একসঙ্গে চালাতে হবে। এসব করা গেলে আমাদের কোয়ালিটি এডুকেশনের টার্গেট পূরণ সম্ভব হবে।
শিখন ঘাটতি পূরণে কাজ করছে কিছু স্কুল, চায় সরকারি উদ্যোগ
এদিকে, শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণে উদ্যোগী হয়েছে কিছু স্কুল। কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মূল ক্লাসের ফাঁকে আগে ক্লাসের পড়া পড়াচ্ছে। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ক্লাস শেষে সময় দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। তবে তাদের মতে, এটাই যথেষ্ট নয়। শিখন ঘাটতি পূরণে সরকারি উদ্যোগও জরুরি।
ব্রাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঈদুর রহমান জেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শিখন ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নিচ্ছি। তবে, শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপ দিয়ে নয়। তাদেরও কিন্তু বিশ্রাম দরকার। সময় দিয়ে তাদের সামনে এগিয়ে নিতে পারলে সেটা হবে সর্বোত্তম।
তিনি বলেন, দুটো বছর তাদের গ্যাপ গেছে। অর্ধবার্ষিকেও তারা সময় পেল না। ফলে তাদের ফাউন্ডেশন তো দুর্বল হয়ে গেছে। চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৬ষ্ঠ শ্রেণির বই পড়তে হচ্ছে। এটা তাদের জন্য কষ্টের। ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে, তবে চেষ্টা করলেই সেটা পারা যাবে।
উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জহুরা বেগম বলেন, শিখন ঘাটতি পূরণে আমরা স্কুল ছুটির পরে বাড়তি ক্লাস নিচ্ছি। আমরা ব্যবহারিক ক্লাসের বদলে এক-দুই মাস ঘাটতি পূরণের ক্লাসগুলো করাচ্ছি। তবে, প্রত্যেক ক্লাসে এভাবে করাতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তারপরও শিক্ষকরা যখন পারছেন, ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, এই প্রজন্ম ভয়াবহ অবস্থায় আছে। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিদিনই আমাদের মিটিং করতে হচ্ছে। ঘাটতি পূরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। তবে, এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস, ইউনিসেফ ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গ্লোবাল এডুকেশন এভিডেন্স অ্যাডভাইজরি প্যানেলের (জিইইএপি) এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। এতে শিশুদের পড়াশোনা ও সামগ্রিক কল্যাণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে, যার পরিণাম আগামী কয়েক দশক ধরে অনুভূত হবে।
‘কোভিড-১৯-এর সময় পড়াশোনাকে অগ্রাধিকার প্রদান’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিশুদের ওপর স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাব সম্পর্কিত সর্বশেষ উপাত্ত তুলে ধরে। প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করে যে, মহামারি চলাকালে তৃতীয় গ্রেডের যে শিশুটির স্কুলে যাওয়া এক বছর ব্যাহত হয়েছে, জরুরি পদক্ষেপ না নিলে দীর্ঘমেয়াদে ওই শিশুটি পড়াশোনার ক্ষেত্রে তিন বছরের সমপরিমাণ ক্ষতির শিকার হতে পারে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ এবং নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থাকা শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চণ্ডআয়ের দেশগুলোর তুলনায় স্কুলগুলো গড়ে বেশি দিন বন্ধ ছিল, স্কুল বন্ধের সময় শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ বলতে গেলে পায়নি বা পেলেও খুব কম পেয়েছে এবং সংকটের চ্যালেঞ্জগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে অভিযোজন প্রক্রিয়াও ছিল কম। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে শিক্ষাখাতে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তার বৃদ্ধি কেবল শিশুদের অধিকারজনিত সমস্যা নয়; শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন শিক্ষার স্তর শিক্ষকদের জন্য পড়াশোনার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে সবচেয়ে প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের সাহায্য করা আরও কঠিন করে তোলে। সূত্র : ঢাকা পোস্ট।