প্রকাশ : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
সাম্প্রতিক সময়ে ফরিদগঞ্জ এআর পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে বিরিয়ানির সাথে গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় চলছে ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই মনে করেন এ ঘটনাটি উপজেলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা। বিশেষ করে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মত বক্তব্যটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। হিন্দু শিক্ষার্থীদের গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনাটি প্রধান শিক্ষককে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানালে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘আজকাল অনেক হিন্দুই গরুর গোশত খায়, তোমরা খেয়েছো, তাতে কী হয়েছে?’ প্রধান শিক্ষকের এমন বক্তব্য ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার নামান্তর বলে মনে করছেন উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। প্রধান শিক্ষকের এমন বক্তব্যে নিন্দা জানিয়েছেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দও।
গত ২১ নভেম্বর বিষয়টির বিচার চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদনও করেন উপজেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদগঞ্জ এআর পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অতীতে বহু হিন্দু ব্যক্তিকে জোর পূর্বক গরুর মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন। যারা খেতে চাননি তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হিন্দু ধর্ম নিয়ে করেছেন হাসি-ঠাট্টা।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা হিন্দু নেতারা মনে করেন, প্রধান শিক্ষকের কাছে এটি একটি কমেডি মাত্র। অতীতে ফরিদগঞ্জ এআর পাইলট হাই স্কুলের একাধিক হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষককে জোরপূর্বক গরুর মাংস খাওয়াতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ওই শিক্ষকদের গরুর মাংস খাওয়াতে রাজি করানোর জন্যে উপজেলার পরিচিত কয়েকজন হিন্দু ব্যক্তি গরুর মাংস খাচ্ছেন বা তার সাথে খেয়েছেন বলে মিথ্যাচার করেছেন বলে চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান উক্ত নেতৃবৃন্দ।
এআর হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষক ও উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি হিতেষ চন্দ্র শর্মা চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, ‘আমি স্কুলে চাকরি করাকালীন চাঁদপুর ডিসি অফিসে একটি কাজ শেষে প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিনসহ ডিসি অফিসের সামনে একটি হোটেলে ভাত খেতে যাই। সেদিন তিনি আমাকে গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে জোর করেন এবং ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে গরুর মাংস কেন খাই না সে সম্পর্কে কথা বলতে থাকেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী কাউকে গরুর মাংস খাওয়াতে পারলে তিনি খুব আনন্দ পান এবং পেছনে এসব নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন। এটি তার সহজাত প্রবৃত্তি। প্রধান শিক্ষকের সেদিনের ধর্মবিরোধী কুপ্রস্তাব আমি আজও ভুলতে পারিনি। যে কারো সামনে আমি এর সাক্ষী দিতে পারবো।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কৌশলে গরুর মাংস খাওয়ানোর পরিকল্পনা রফিকুল আমিন কাজলের বহু পুরানো বলে দাবি করেন ফরিদগঞ্জ প্রত্যাশী আরএ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক তপন কুমার। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ’৯৭ সালের দিকে কাজল মাস্টার তখন সহকারী শিক্ষক। আমরা এসএসসি পরীক্ষার কন্ট্রোল রুমে এক সাথে দায়িত্ব পালন করি। কন্ট্রোল রুমে প্রতিদিন দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। একদিন বাজার থেকে খাবার আনার দায়িত্ব দেয়া হয় রফিকুল আমিন কাজলকে। কন্ট্রোল রুমে আমরা তিনজন হিন্দু শিক্ষক আছি এটি জানার পরও তিনি আমাদের জন্য ভাতের সাথে গরুর মাংস নিয়ে আসেন। আমরা প্যাকেট খুলে গরুর মাংস দেখে যখন প্রতিবাদ জানাই তখনও তিনি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, খেলে অসুবিধা নাই, এখন অনেক হিন্দুই গরুর মাংস খায়। আমি অনেককেই খাইয়েছি।
প্রধান শিক্ষক ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ইতোমধ্যে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছেন বলে জানা যায়। তদন্ত কমিটির সদস্যগণ এসএসসি পরীক্ষা শেষে হিন্দু শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে এ ঘটনার জন্য স্কুল দায়ী নয় মর্মে জোরপূর্বক লিখিত বক্তব্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের চলমান এসএসসি পরীক্ষার বোর্ড রোল নম্বরসহ নাম লিখে স্বাক্ষরও গ্রহণ করেছেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীর বাড়িতে তদন্ত কমিটির শিক্ষকগণ গিয়ে কোনোক্রমেই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন-এমন অভিযোগও পাওয়া যায় অভিভাবকদের কাছ থেকে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা বক্তব্যের বিষয়ে ফরিদগঞ্জ এআর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিন কাজল জানান, আমি কথাটা এভাবে বলিনি। বলেছি, খেয়েই যখন ফেলেছো তাতে কী হয়েছে? অনেক হিন্দুইতো খায়। তবে আমার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সুমন পাল বলেছেন, গরুর মাংস খেয়ে ফেললে নাকি হিন্দুদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। ও তাদের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করতে হয় তা শিখিয়ে দিবেন।
জেলা প্রশাসককে লিখিত অভিযোগ দেয়ার বিষয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ডাঃ পরেশ পাল আর আমার স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক হিতেষ চন্দ্র শর্মা বিষয়টা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঘোলাটে করছেন। মূল নটের গুরু হিতেশ শর্মা। আমার স্কুলের এক শিক্ষিকা যার বাড়ি গোপালগঞ্জ, তাকে ধমক দিয়ে হিতেষ শর্মা বলেছেন, কোনো তদন্ত যেন না করে। নইলে তাকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়ে দিবে।
যদিও এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হিতেষ চন্দ্র শর্মা বলেছেন, এগুলো মিথ্যাচার। আমি একজন শিক্ষিকাকে গোপালগঞ্জ পাঠানোর কে? কাজল আমার ছাত্র, আমি জানি সে কোন্ স্বভাবের। এমন মিথ্যা কথা সে সচরাচরই বলে থাকে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার বিষয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডাঃ পরেশ চন্দ্র পাল জানান, আমি বিষয়টি জানতে পেরে প্রচ- রকমের আহত হই। বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানোর পরও কোনো প্রতিউত্তর পাইনি। পৌর মেয়র মহোদয়কে জানানোর পরও কোনো সুরাহা পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে আমরা উপজেলা হিন্দু নেতৃবৃন্দ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে বিচার চেয়ে আবেদন করি। আশা করি জেলা প্রশাসক মহোদয় এর বিচার করবেন। আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হোক তা আমরা চাই না বলেই ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরিচয় দিচ্ছি। রফিকুল আমিন কাজলের এমন বক্তব্য এই প্রথম নয়, বিগত দিনে তিনি বহুভাবে হিন্দুদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে গরুর মাংস ভক্ষণ করাতে চেয়েছেন। একজন মানুষ দায়িত্বশীল পদে থেকে বারবার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে যাবেন আর আমরা চুপ থাকবো তা হতে পারে না। জেলা প্রশাসক ন্যায্য বিচার না করলে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবো।
অভিযোগের বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, আমি রোববার চট্টগ্রামে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযোগটি হাতে পাইনি। হয়তো তার পরে জমা দিয়েছেন। আমি অভিযোগ হাতে পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করবো।
একজন প্রধান শিক্ষক ফরিদগঞ্জের ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার প্রচেষ্টা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার বিষয়ে চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। আমরা যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার কথা বলছি তখন এমন ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। আমি আশা করবো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনবেন।
উল্লেখ্য, ফরিদগঞ্জ এআর পাইলট মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল আমিনের বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সন্তান পরিচয়ে বিশেষ সুবিধাগ্রহণ, শিক্ষা সনদপত্র ও পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি করে প্রধান শিক্ষক হওয়া এবং তথ্য গোপন করে শিক্ষা বোর্ডের সাথে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পৃথক একটি আবেদন করা হলে তৎকালীন জেলা প্রশাসন থেকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। ২ বছর পর একই ব্যক্তির নামে জেলা প্রশাসক বরাবর করা আবেদনটি আলোর মুখ দেখবে কি-না, সেই প্রশ্ন ফরিদগঞ্জের সাধারণ মানুষের।