প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:১৫
প্রবীণের লড়াই সীমানার বড়াই
প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে অনেকেই পরিচিতির সংকটে পড়েন। পদ পদবীর আগে পরে সাবেক, ভূতপূর্ব, অবসরপ্রাপ্ত ইত্যাদি লিখে বলে পরিচয় দিতে আগ্রহীর সংখ্যা অনেক। চিকিৎসক, উকিল, প্রকৌশলী, সাংবাদিকদের অবসর না থাকায় তাদের পরিচিতির সংকট তেমন একটা দেখা যায় না।
|আরো খবর
আমাদের শ্রমজীবী মানুষের প্রবীণ জীবনে পরিচিতির সংকট আছে বলে মনে হয় না। এদের কেউ নিজের পরিচয় দেবার সময় অবসরপ্রাপ্ত কৃষি শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, নির্মাণ শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, গাড়ি চালক, সেবা কর্মী, দোকান কর্মচারী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ইত্যাদি সাধারণত বলে না। কারণ এসব পদ- পদবী সমাজের চোখে সম্মান মর্যাদার বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় না।
মানুষ পরিচয় জানতে চায় কেন? মানুষ বুঝতে চায় ব্যক্তির শিক্ষা দীক্ষা, অর্থ বিত্ত, ক্ষমতা, দাপট কতোটা শক্তিশালী।যতোখানি শক্তিশালী ঠিক ততোখানিই সম্মান মর্যাদা গুরুত্ব দিতে চাইবে। ফলে মানুষ সম্মান, মর্যাদা গুরুত্ব পাবার জন্যে নামের শেষে সাবেক গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো লিখে থাকেন বা পরিচয় দেন। মানুষ যেহেতু পদ-পদবীগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেয়, সেহেতু পদ-পদবীর উল্লেখ খুবই স্বাভাবিক বিষয়। মানুষ হিসেবে একজন কতোখানি সৎ, দক্ষ, যোগ্য, ন্যায়পরায়ণ, বিবেচক, দয়ালু, মানবিক, কর্তব্যপরায়ণ এসব বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আমাদের উল্লেখযোগ্য শিথিলতা রয়েছে। আমরা ক্ষমতা, অর্থ বিত্তের ছায়ায় মায়ায় থেকে জীবনকে উপভোগ করার প্রেরণা লাভ করেছি। এর বাইরে থেকে জীবনকে উপভোগ করার মতো মানুষের সংখ্যা অনেক কম।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন আমরা সমাজের কাছ থেকে সম্মান মর্যাদা গুরুত্ব পেতে আগ্রহী। মানুষ মূলত শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অথবা আশেপাশে থেকে উত্তাপ নিতে আগ্রহী।
সামাজিক নানা পরিবর্তনের ফলে মানুষ ক্ষমতাবানদেরকেই এখন তেমন একটা আমলে নিচ্ছে না। প্রাক্তন ক্ষমতাবানদের আর কতোটুকু আমলে নিবে। সাবেক পদ- পদবী সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যক্তি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা গড়ে উঠতে সহায়তা করে মাত্র।
প্রবীণ জীবনে এসে মানুষ ক্রমেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন। পুরানো কর্মস্থলে আগের মতো খাতির- যত্ন পাওয়া যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে এড়িয়ে যাবার মতো ঘটনা ঘটে। ক্ষমতাহীন অবস্থায় পুরানো কর্মস্থলে খুব বেশি মনোযোগ পাওয়া মুশকিল। অনেকেই না ঠেকলে পুরানো কর্মস্থলে যেতে চান না।
কর্মজীবনে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবরা যতোখানি খোঁজ খবর রাখতো, অবসর জীবনে সেটুকু আর রাখে না। কম গুরুত্বপূর্ণ লোকের অবসরগ্রহণ অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার মতো। সংসারে পরিবার পরিজন, আত্মীয় স্বজনের জন্যে নানা রকমের ত্যাগ স্বীকার করে শরীর মনে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। শরীর আর আগের মতো চলে না। মনটা আহত পাখির মতো ছটফট করতে থাকে। কী পেলাম , কী দিলাম এসব হিসাব মেলাতেই মনটা হাহাকার করে উঠে।
শ্রমজীবী মানুষ বার্ধক্যের সংকটকে নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়। তারা তেমন রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, ঘৃণা প্রকাশ করতে চায় না। জীবনে বড়ো কিছু পাননি, বড়ো কিছুর স্বাদ কেমন তাও বুঝতে পারেননি। কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন মাত্র। ভয় পেয়ে, ঘৃণায়, হতবিহ্বল হয়ে হয়তো বড়ো কিছু দেখেছেন। জানতেন ইহ জনমে এসব পাওয়া সম্ভব নয়। বরং নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন সকল কিছু পরজন্মে পাওয়ার আশায়। ফলে অর্থবিত্ত, সহায় সম্পদ, ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণের আকুলতা ছিলো না। যারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কিংবা আশেপাশে থেকে উত্তাপ গ্রহণ করেছেন তারা ক্ষমতার বাইরের শীতলতায় কিছুটা কাবু হয়ে পড়েন। আয় রোজগারে ভাটা পড়ে, জমা টাকা ভেঙ্গে খেতে কষ্ট হয়।আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের প্রতি অভিযোগ-অনুযোগ বাড়তে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে জমিজমা, সহায় সম্পদের বিলি বন্টন, হেফাজত নিয়ে নানা রকমের সংকট মোকাবিলা করতে হয়। সহায় সম্পদের ওপর নিরংকুশ আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। কারো কারো ক্ষেত্রে উল্টোটি ঘটে, যেমন--সহায় সম্পদের প্রতি অনীহা, বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। এ রকম ঘটনা খুব কমই ঘটে।
অনেক প্রবীণ নিজের ব্যাপারে অতি সতর্কতা অবলম্বন করেন। নিজের সীমানার বাইরে অন্য কাউকে ঢুকতে দিতে চান না। যাপিত জীবনের গল্প করতে বেশি পছন্দ করেন।মানুষের কল্যাণে কতো কাজ করেছেন তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। অকৃতজ্ঞ মানুষ যেসব ভুলে যায় সেই বয়ান অব্যাহত রাখেন। ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতায় থাকাকালীন ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার অনেক সময়ই করতে পারেন না। ব্যক্তিগত লাভালাভ, সুবিধা ও স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করতে করতে ডুবতে থাকে। কতোখানি সম্পদ অর্জন করলে থামতে হবে এই পরিমিতি বোধ পর্যন্ত কারো কারো মাথায় জেগে উঠতে দেখা যায় না। প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে সবারই খানিকটা কষ্ট হয়। কষ্টকালীন সময়ে অনেকেই মনে করতে থাকেন ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। প্রবীণ জীবনে উপনীত হয়ে কেউ কেউ নিজেরা সীমানা অতিক্রম করেন কিংবা অতিক্রম করতে চান। তাদের চলন বলন, কথাবার্তা, আচার আচরণে খানিকটা অহংকারী ভাবসাব পরিলক্ষিত হয়।ওনারা বুঝতে চান না যে, তাদের সময় কাল অতীত হয়েছে। কবে কোথায় কী ছিলেন, কী কী কাজ করেছেন, কতোটা দাপটের সাথে কাজ করেছেন এসব ভুলতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো হবে। আপনার অতীত যদি বর্তমানে কোনো কাজে না লাগে তবে সেসব লালন করে কোনো লাভ হবে না। কেউ আগ্রহ করে আপনার অতীত শুনতে না চাইলে আপনি আগ বাড়িয়ে নিজের অতীত বলার মধ্যে কোনো গৌরব আছে বলে মনে করি না। প্রবীণদের মধ্যে একটি অংশ খাবার দাবারের ক্ষেত্রে সীমানা অতিক্রম করতে থাকেন।অতিরিক্ত ক্যালরি, তৈলাক্ত, শক্ত খাবার গ্রহণে উৎসাহী হন।
অন্যের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অহেতুক কৌতূহল প্রদর্শন নিজের সীমানা অতিক্রম করার সামিল। নিজের সীমানা বহাল রাখতে শক্তি প্রয়োগ বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। সীমানার মধ্যে থেকে অন্যের বিরক্তি তৈরি কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্যকে ছোট করা, বিব্রত করা অপরাধমূলক কাজ। ঘরবাড়ি, জমি জমার সীমানা সামলানোর কাজ বিবেচনার সাথে করতে হবে।
পৃথিবীতে আমাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি নিয়ে আমজনতার কিছু যায় আসে না। নিজের জীবনকে সীমানার মধ্যে রেখে উপভোগ করাই আনন্দের।